করোনাভাইরাস প্রতিরোধী তিন ডোজ টিকা নেয়ার অভিযোগ তোলা ওমর ফারুক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) থেকে নারায়ণগঞ্জের বাড়িতে ফেরার পর হালকা জ্বরে ভুগছিলেন বলে জানিয়েছেন স্বজন।
অসুস্থ বোধ করায় তাকে খেতে দেয়া হয় ডাবের পানি ও দুধ। এরপর বুধবার দুপুর ১২টার দিকে দুটি মাইক্রোবাসে লোকজন এসে চিকিৎসার কথা বলে তাকে নিয়ে যায়।
স্বজনরা জানান, বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়ার পর সারাদিন তার কোনো খোঁজ না থাকলেও সন্ধ্যা ৭টার দিকে মা রহিমা বেগমের মোবাইল ফোনে কথা বলেন ফারুক। মাত্র ছয় সেকেন্ডের ফোনকলে তিনি মাকে জানান, সুস্থ আছেন, হাসপাতালে আছেন। তাকে চিকিৎসার জন্য বিএসএমএমইউতে নেয়া হয়েছে, তখনও চিকিৎসক আসেননি।
অবশ্য ফারুককে নিজেদের পর্যবেক্ষণে নেয়ার কথা স্বীকার করেনি বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ।
পরিবারের সদস্যরা জানান, ওমর ফারুক বুধবার সন্ধ্যায় ফোন করার পর তার খোঁজে ঢাকা গিয়েছেন বাবা জামাল হোসেন প্রধান। তবে সবশেষ অবস্থা জানতে নিউজবাংলা জামাল হোসেনকে একাধিকবার ফোন করলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
ওমর ফারুককে নিজেদের কাছে রাখার দাবি অস্বীকার করেছে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ। ফারুক কোথায় আছেন, জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়া কো-অর্ডিনেটর সুব্রত বিশ্বাস সন্ধ্যায় নিউজবাংলা প্রতিবেদককে বলেন, ‘আপনি এমনভাবে বলছেন যেন আপনি জানেন, তিনি আমাদের হাসপাতালেই আছেন। সাংবাদিকদের মতো আমরাও ওমর ফারুককে খুঁজছি। আপনার কাছে যদি ওনার বাবার নম্বর থাকে, তাহলে আমাদের দেন, আমরা ওনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব।’
তবে ফারুকের স্বজনদের অভিযোগ, বুধবার দুপুর ১২টার দিকে দুটি মাইকোবাসে আসা লোকজন নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ভুঁইগড় এলাকার বাড়ি থেকে তাকে ঢাকা নিয়ে যায়। ফারুকের সঙ্গে যান তার ভগ্নিপতি গোলাম সারোয়ার নাহিদ। এরপর বিএসএমএমইউতে পৌঁছে ফারুককে হাসপাতালে ভর্তির টিকেট কাটতে নাহিদকে কাউন্টারে পাঠানো হয়। তিনি ফিরে এসে ফারুক বা ওই মেডিক্যাল টিমের কাউকেই খুঁজে পাননি।
গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলছেন ওমর ফারুকের স্বজন ও প্রতিবেশীরা। ছবি: নিউজবাংলাএসব তথ্য নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন ওমর ফারুকের বোন ফারজানা আক্তার।
তিনি জানান, কিছুদিন আগে তার ভাই সৌদি আরবের ভিসা পেয়েছেন। প্রবাসী অ্যাপ থেকে অনলাইনে নিবন্ধন করে ২৬ জুলাই সকালে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে টিকা নেয়ার জন্য যান। সেখানে প্রথমে একটি বুথে তাকে এক ডোজ টিকা দেয়া হয়। ওমর ফারুক ওই বুথের স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে পরবর্তী করণীয় জানতে চাইলে তাকে সামনের বুথের দিকে যেতে বলা হয়। পরের বুথে গেলে তাকে আবার টিকা দেয়া হয়, এরপর সামনের আরেকটি বুথ থেকে দেয়া হয় টিকার আরেকটি ডোজ।
এ ঘটনা নিয়ে বেসরকারি একটি টেলিভিশনে প্রতিবেদন প্রচারের পর ব্যাপক আলোচনা শুরু হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ মঙ্গলবার বিকেলে নিউজবাংলা বলেন, ‘ওমর ফারুক সুস্থ আছেন এবং তিনি সাত দিন পর্যবেক্ষণে থাকবেন।’
তবে এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে উপাচার্য তার বক্তব্য পরিবর্তন করে দাবি করেন, একজনকে তিনবার টিকা দেয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি। ওমর ফারুক নামে কেউ তাদের পর্যবেক্ষণে নেই বলেও দাবি করে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ।
আরও পড়ুন: ‘৩ ডোজ টিকা’ নেয়া সেই ওমর ফারুক কোথায়?
তবে ফারুকের পরিবার জানায়, ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরেও তিনি তিন ডোজ টিকা নেয়ার কথা স্বজনদের জানিয়েছেন। ওমর ফারুকের বোন ফারজানা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তিন টিকা নেয়ার পর আমার ভাইয়ের থেমে থেমে একটু জ্বর ও শরীরে ব্যথা হয়েছে। এছাড়া তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। বাড়ি আসার পর তাকে ডাবের পানি, দুধ ও ডিম খাওয়ানো হয়েছিল। তিন টিকা নেয়ার বিষয়টি জানাজানি হলে তাকে পিজি (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে নেয়ার জন্য মোবাইল ফোনে অনেকবার কল এসেছিল।’
ফারজানা জানান, তার ভাই ভয়ে হাসপাতালের ফোন ধরেননি এবং যেতে চাননি। পরে তিনি ফোন বন্ধ করে রাখেন। বুধবার দুপুর ১২টার দিকে মেডিক্যাল টিম পরিচয়ে হাসপাতাল থেকে লোকজন এসে তার ভাইকে তুলে নিয়ে যায়।
তিনি জানান, ভাইয়ের সঙ্গে তার স্বামী গোলাম সারোয়ার নাহিদকে দেয়া হলেও হাসপাতালে তিনি ফারুককে হারিয়ে ফেলেন। নারায়ণগঞ্জের বাড়িতে যাওয়া টিমের সদস্যদের মধ্যে একজন নিজেকে নিজেকে সহযোগী অধ্যাপক পরিচয় দিয়েছিলেন।
ফারজানা বলেন, ‘আমার ভাই টিকার বিষয়টি বুঝতে পারেনি। কিন্তু তার শরীরে যারা তিন ডোজ টিকা পুশ করল তারা কীভাবে ইনকেজশন পুশ করল? যারা ওই বুথের দায়িত্বে ছিলেন, তাদের ভুলের কারণে তিনি তিন বার টিকা নিয়েছেন।’
ওমর ফারুকের প্রতিবেশী ও এলাকাবাসী দাবি করেন, ওমর ফারুককে মেডিক্যাল টিম পরিচয় দিয়ে নিতে আসা দুটি গাড়ির একটির লোকজনের কাছে অস্ত্র ছিল।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রতিবেশী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা চাই, ওর চিকিৎসা হোক। তবে ওমর ফারুককে কোথায় রাখা হয়েছে, সেটি পরিবারের লোকজনকে জানানো হোক। ওর কারণে তার বাবা-মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে।’
স্বজনরা জানান, ওমর ফারুকের চার বছর বয়সী এক ছেলে রয়েছে। তার বাবা পেশায় অটোরিকশা চালক।
ফারুকরা তার চাচা আলাউদ্দিনের তিন তলা বাড়ির নিচ তলায় ভাড়া থাকেন। চার বছর আগে তিনি ভুঁইঘর মিছির আলী মাদ্রাসা থেকে হেফজ বিভাগে পড়াশোনা শেষ করেন। এরপর থেকে বেকার ছিলেন ওমর ফারুক। সম্প্রতি তার সৌদি আরব যাওয়ার ভিসা হয়।
প্রতিবেশী আবুল হোসেন জানান, ফারুককে নিতে আসা গাড়িগুলো তার বাড়ির সামনের রাস্তা পর্যন্ত এসেছিল। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যে লোকজন ফারুককে নিয়ে চলে যায়।
এদিকে ওমর ফারুকের তিন ডোজ টিকা নেয়ার বিষয়টি নারায়ণগঞ্জের প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের কেউ জানে না। জেলা সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ইমতিয়াজ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওমর ফারুককে ভূঁইঘর থেকে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি আমাদের জানা নেই। কেউ আমাদেরকে বিষয়টি জানায়নি।’