অগ্নিদগ্ধ কোনো রোগীর শরীর বা মুখের কোনো অংশ পুড়ে গিয়ে আগুনের ক্ষত যদি সহজে না সারে, সংরক্ষিত কোনো টিস্যু দিয়ে সে ক্ষত সারিয়ে তোলা যায়। আবার দুর্ঘটনায় কারও শরীরের হাড় ভেঙে গিয়ে যদি জোড়া না লাগে, হাড়ের টিস্যু দিয়ে তা জোড়া লাগানো দ্রুততর করা যায়।
এভাবে মানব টিস্যুর ব্যবহার চিকিৎসা শাস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। এ জন্য সরকার দেশে একটি পূর্ণাঙ্গ টিস্যু বা কোষ ব্যাংক স্থাপন করতে যাচ্ছে। এতদিন এ কার্যক্রম হয়েছে সীমিতভাবে। এখন তার ব্যাপ্তি বাড়বে। তা ছাড়া এ দিয়ে হবে উচ্চতর গবেষণাও।
এ জন্য একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার, যেটির নাম ‘ইনস্টিটিউট অব টিস্যু ব্যাংকিং অ্যান্ড বায়োমেটেরিয়াল রিসার্চের সেবা ও গবেষণা সুবিধাদির আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ’।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের এ প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা। প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য বুধবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় তোলা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকাল ১০টায় এ সভায় সভাপতিত্ব করবেন। এটির বাস্তবায়নে কাজ করবে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন।
সেবা ও গবেষণা কার্যক্রমের আওতায় ইনস্টিটিউট অব টিস্যু ব্যাংকিং অ্যান্ড বায়োমেটেরিয়াল রিসার্চ (আইটিবিবিআর) টিস্যু নিয়ে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রস্তুত করা মানব টিস্যু গ্রাফট দেশের শতাধিক হাসপাতাল ও ক্লিনিকে পুনর্বাসন শল্য চিকিৎসায় ব্যবহার হচ্ছে।
আইটিবিবিআর টিস্যু গ্রাফট গবেষণাগারে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন অনুসরণ করে টিস্যু প্রক্রিয়াজাতকরণ, রেডিয়েশন স্টেরিলাইজেশন, মাইক্রোবায়োলজিক্যাল কোয়ালিটি কন্ট্রোল এবং টিস্যু গ্রাফট সংরক্ষণ করা হয়।
এ ছাড়া চলমান টিস্যু গ্রাফট সরবরাহ সেবা দেয়ার পাশাপাশি নতুন নতুন কী সেবা যুক্ত করা যায়, তা নিয়েও গবেষণা করছে আইটিবিবিআর।
আইটিবিবিআর বলছে, তারা বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে সংগৃহীত নিউরো-ক্রেনিয়াল অটোগ্রাফট আইটিবিবিআর গবেষণাগারে প্রক্রিয়াজাতকরণ ও পারমাণবিক বিকিরণ পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে জীবাণুমুক্তকরণ শেষে সরবরাহের জন্য নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করবে।
কয়েক বছর ধরে এই নিউরো-ক্রেনিয়াল অটোগ্রাফটিং সেবাগ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা বহু গুণ বেড়েছে। আইটিবিবিআর থেকে টিস্যু গ্রাফট সরবরাহের পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে পুনর্বাসিত মানুষের সংখ্যাও গত বছরগুলোতে কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। চলমান সেবার ক্রমোন্নতির পাশাপাশি আইটিবিবিআরের গবেষণা কার্যক্রমও বেড়েছে।
টিস্যু কীভাবে কাজ করে
বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. সানোয়ার হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দেশে বিভিন্ন ধরনের টিস্যু গ্রাফটের ক্রমবর্ধমান চাহিদার অনুপাতে বর্তমান ল্যাবরেটরি অবকাঠামোতে টিস্যু গ্রাফট সরবরাহ করা যাচ্ছে না। তাই হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো টিস্যু গ্রাফটের চাহিদা মেটাতে ইনস্টিটিউটের সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন। এ জন্য প্রকল্প নেয়া হচ্ছে।
‘এ প্রক্রিয়ার শুরুতে বিভিন্ন মাধ্যমে হাসপাতালগুলোতে ত্বকের টিস্যু ও হাড়ের টিস্যু সংরক্ষণ করা হয়। তা আইটিবিবিআর-এ পরিশোধন করে সংরক্ষণ করা হয়। পরবর্তীতে অন্য কোনো রোগীর চাহিদার ক্ষেত্রে তা সরাবরাহ করা হয়।’
সাধারণত অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ থেকে তা সংগ্রহ করা হয়। যেমন, কোনো শিশুর জন্মের পর মায়ের প্ল্যাসেন্টার আবরণ ফেলে দেয়া হয়। কিন্তু তা সংরক্ষণ করে ত্বকে গ্রাফটিংয়ের মাধ্যমে কাজে লাগানো যায়। আবার দুর্ঘটনায় কারও হাড় ভেঙে গেলে যদি তা অকেজো হয়ে পড়ে, আর জোড়া লাগানোর মতো অবস্থায় না থাকে, তা ফেলে দিতে হয়। ওই হাড় পরিশোধনের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা যায়। পরবর্তীতে হাড়ের কোনো অংশ একই ধরনের অন্য কোনো রোগীর জন্য অপারেশনের ক্ষেত্রে কাজে আসে।
এ প্রকল্পের আওতায় এ খাতে আরও গবেষণা হবে বলে জানান কমিশনের এ সদস্য।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পর গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা। ওই সভায় দেয়া সুপারিশগুলো প্রতিপালন করায় এটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে উপস্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছে।
বুধবারের একনেক সভায় অনুমোদন পেলে চলতি বছর হতে শুরু হয়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এসব কাজ শেষ করবে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন।
প্রকল্পটির দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মোসাম্মৎ নাসিমা বেগম কমিশনের মতামতে বলেন, ‘প্রকল্পটির আওতায় পরমাণু প্রযুক্তি প্রয়োগে দেশে মানব স্বাস্থ্য সেবায় টিস্যু ব্যাংকিং কার্যক্রম বিস্তৃত ও আধুনিক হবে। হিউম্যান মডেল টিস্যু ব্যাংক স্থাপনসহ পরমাণু প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রস্তুত করা থেরাপিউটিক মানব কল্যাণে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মাধ্যমে এ খাতে গবেষণা পরিচালনা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ সব বিবেচনায় প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য তোলা হচ্ছে।’