ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর রাশিয়া থেকে ভ্যাকসিন আনার ক্ষেত্রে তাকে ও জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে সম্পৃক্ত করতে যে বক্তব্য রেখেছেন, সেটি চট করে বলে ফেলা কোনো চটকদার কথা নয়।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী নিজেও চাইছেন এই উদ্যোগে সম্পৃক্ত হতে। সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে করোনার টিকা কেনার ক্ষেত্রে বেক্সিমকো ফার্মসিউটিক্যালস যে ভূমিকায় ছিল, একই ভূমিকা তিনি নিতে চাইছেন রাশিয়া থেকে টিকা আনার ক্ষেত্রে।
জাফরুল্লাহর দাবি, রাশিয়ার যে প্রতিষ্ঠান টিকা উৎপাদন করছে, সেটির সঙ্গে তার যোগাযোগ আর তার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ওই প্রতিষ্ঠানের লোকাল এজেন্ট।
অবশ্য এ বিষয়ে সরকারকে কোনো আনুষ্ঠানিক চিঠি না দিয়ে মূলত নুরের মাধ্যমেই কথাটা প্রথম ছড়ানো হয়েছে। তিনি আহ্বান জানাচ্ছেন, রাশিয়া থেকে টিকা আনতে তাকে সম্পৃক্ত করুক।
বিদেশ থেকে ওষুধ আমদানির ক্ষেত্রে সরাসরি আনার সুযোগ নেই। যে দেশ আমদানি করবে, সেখানে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের একটি লোকাল এজেন্ট থাকে। আমদানির ক্ষেত্রে মধ্যস্থতা করে সেই লোকাল এজেন্ট।
বাংলাদেশে সিরামের লোকাল এজেন্ট বেক্সিমকো ফার্মা। আর সেখান থেকে করোনার ৩ কোটি ৪০ লাখ টিকা আনার সময় বেক্সিমকোকে সম্পৃক্ত করায় ব্যাপক সমালোচনা করেছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সে সময় তিনি বলেছিলেন, কোনো তৃতীয় পক্ষের বদলে সরকারের উচিত নিজেরা সরাসরি টিকা নিয়ে আসা।
এখন রাশিয়ায় তৈরি ‘স্পুতনিক-ভি’ টিকার ২ কোটি ডোজ ৮ ডলারে সরকারকে এনে দিতে চাইছেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সরকার যদি রাজি হয়, তাহলে এক সপ্তাহের মধ্যেই ২ কোটি টিকা এনে দিতে পারি। চীন থেকে সরকার ১০ ডলারে নিচ্ছে, আর আমি বলেছি আমি ৮ ডলারে সেটা ঢাকায় পৌঁছে দেব।’
সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকা আনার সময় বেক্সিমকো ফার্মাকে সম্পৃক্ত না করে সরাসরি টিকা কেনার পরামর্শ দিয়ে এখন কেন নিজেকে বেক্সিমকোর একই ভূমিকায় দেখতে চাইছেন- এমন প্রশ্নে জাফরুল্লাহ খানিকটা বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, ‘আরে বাবা রে, আপনাকে প্রয়োজনটা আগে বুঝতে হবে। এখন করোনার যে ভয়াবহ থাবা, সরকারের পিঠ ঠেকে যাওয়ায় শাটডাউন করছে। এতে লোক খেতে পারছে না, মানুষ মরছে। এই অবস্থায় টিকা জরুরি। আর তা যদি কম খরচে আনা যায় ক্ষতি কী বলেন শুনি।’
সিরাম থেকে টিকা আনার পর সেগুলো সংরক্ষণ, জেলায় জেলায় পৌঁছে দেয়া, মান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সব দায়িত্ব ছিল বেক্সিমকো ফার্মার। এসব কাজ করে তারা টিকাপ্রতি এক ডলার করে নেবে বলে সরকারের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে।
রাশিয়া থেকে টিকা আনতে পারলে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের টিকাপ্রতি কত করে থাকবে-এটা জানাননি জাফরুল্লাহ।
তিনি কথা বেশি না বাড়িয়ে বলেন, ‘শেষ হলো তো নাকি? ঠিক আছে।’
এরপর আর কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়েই ফোন কাটেন তিনি।
জাফরুল্লাহ তখন যা যা বলেছেন
সিরাম থেকে বেক্সিমকো ফার্মার মধ্যস্থতায় যখন অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা আনার চেষ্টা শুরু হয়, তখন জাফরুল্লাহ বারবার প্রশ্ন তুলেছেন, তৃতীয় পক্ষ কেন সম্পৃক্ত হবে।
এর মধ্যে ২৮ জানুয়ারি জার্মানভিত্তিক বাংলা সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলেকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘এই সরকার ব্যবসায়ীদের সরকার। তাই সিরামের টিকা বেক্সিমকোর মাধ্যমে এনেছে ৷ তারা (বেক্সিমকো) (কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই ফাও কত টাকা নিয়ে গেল! দামও বেশি নিচ্ছে ৷ বেক্সিমকো সেরামের এখানকার প্রতিনিধি হলেও সরকার চাইলে এসেনসিয়াল ড্রাগস-এর মাধ্যমে আনতে পারত।’
অক্সফোর্ড উদ্ভাবিত টিকা আনতে গত ৫ নভেম্বর বাংলাদেশ, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট ও বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়। এই চুক্তির তীব্র সমালোচনা করেছিলেন জাফরুল্লাহ।
সরকার সিরাম থেকে টিকা কেনার ক্ষেত্রে যে চুক্তি করেছে সেটি অভিনব। চুক্তিটি এমন যে, সিরাম ভারত সরকারকে যদি ৪ ডলারের বেশিতে টিকা দেয়, তাহলে বাংলাদেশ দেবে ৪ ডলার করে। আর যদি ভারত আরও কমে টিকা কেনে, তাহলে বাংলাদেশ ভারতের সমান দাম দেবে।
জাফরুল্লাহ সে সময় বলেছিলেন, এই টিকা কেনা হচ্ছে বেশি দামে, এতে দেশের লোকসান হচ্ছে।
এখন তিনি বলছেন, রাশিয়া থেকে টিকা এনে দেবেন ৮ ডলারে, অর্থাৎ দ্বিগুণ দামে।
টিকা নিয়ে যা হয়েছে
বাংলাদেশে গত ৭ ফেব্রুয়ারি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত টিকা দিয়ে শুরু হয় গণটিকা কর্মসূচি। এই টিকা ঢাকা কিনেছে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট।
সে সময় জানানো হয়েছিল, সিরাম প্রতি মাসে দেবে ৫০ লাখ করে, সব মিলিয়ে পাঠাবে ৩ কোটি ৪০ লাখ। আর বিশ্বজুড়ে টিকা বিতরণে গড়ে ওঠা জোট কোভ্যাক্স থেকে পাওয়া যাবে আরও সাত কোটির বেশি টিকা। ফলে টিকা নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা সরকারে ছিল না।
তবে ভারতে করোনার নতুন ধরন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার পর সে দেশের সরকার সিরামকে টিকা রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। আর এ কারণে বাংলাদেশ সরকারও পরিকল্পনা পাল্টাতে বাধ্য হয়।
সিরামের বিকল্প হিসেবে সরকার যোগাযোগ করে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে। চীনের কাছ থেকে চার থেকে পাঁচ কোটি টিকা কেনার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। তবে রাশিয়া থেকে কত টিকা আসবে, সে বিষয়ে এখনও কিছু চূড়ান্ত হয়নি।
এরই মধ্যে চীন থেকে কেনা টিকার একটি চালান ঢাকায় এসে পৌঁছেছে। তবে রাশিয়া থেকে টিকার চালান এখনও আসেনি। আর সরকার দুই দেশের টিকা দেশেই উৎপাদনের যে পরিকল্পনা করছে, সেটিও চূড়ান্ত হয়নি।
তবে কোভ্যাক্স থেকে যে টিকা আসার কথা ছিল, সেটিও আসতে শুরু করেছে। চলতি মাসের মধ্যেই সরকারের হাতে এক কোটি টিকা চলে আসবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আর আগামী মাসে ফাইজার উদ্ভাবিত আরও ৬০ লাখ টিকা কোভ্যাক্স থেকে আসবে বলেও জানানো হয়েছে।