বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর পর তাকে ‘গার্ড অফ অনার’ দেয়ার সময় সরকারের নারী কর্মকর্তাদের উপস্থিতি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির আপত্তিতে ক্ষুব্ধ নারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা।
তারা বলছেন, এটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে ধর্মের বিষয়টিকে সামনে আনা হচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ১৯তম বৈঠক হয় রোববার। এ সময় বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর পর তাকে ‘গার্ড অফ অনার’ দেয়ার সময় নারী কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে আপত্তি জানিয়ে বিকল্প খোঁজার সুপারিশ করে কমিটি।
সংসদীয় এই কমিটির সভাপতি হিসেবে আছেন শাজাহান খান। সদস্য হিসেবে বৈঠকে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, রাজি উদ্দিন আহমেদ, মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম (বীর উত্তম), কাজী ফিরোজ রশীদ, ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল ও মোছলেম উদ্দিন।
- আরও পড়ুন: গার্ড অফ অনারে নারী চায় না সংসদীয় কমিটি
সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী, কোনো বীর মুক্তিযোদ্ধা মারা যাওয়ার পর তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানায় প্রশাসন। গার্ড অফ অনার দিতে সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত থাকেন জেলা প্রশাসক (ডিসি) বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। রাষ্ট্রীয় সম্মানের অংশ হিসেবে সরকারের প্রতিনিধি হয়ে মরদেহে ফুলেল শ্রদ্ধাও জানান ওই সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক স্থায়ী কমিটির বৈঠকের পর শাহজাহান খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই প্রশ্ন আসছে ধর্মীয় অনুভূতি থেকে। কোনো কোনো জায়গা থেকে বলা হয়েছে, জানাজায় নারীরা অংশ নিতে পারেন না।’
‘গার্ড অফ অনার সাধারণত জানাজার সময় দেয়া হয়’ জানিয়ে স্থায়ী কমিটির সভাপতি বলেন, ‘এ জন্য এই ইয়েটা (সুপারিশ) আসছে। যদি গার্ড অফ অনার জানাজার আগে দেয় বা পরে দেয়, তখন জানাজা থাকে না। সেইটা একটা জিনিস। আমরা দেখেছি, সব জায়গায় জানাজার সময় গার্ড অফ অনার দেয়। ওই জায়গায় ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়টি বিবেচনা করে এটা সুপারিশ করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘মহিলার বিকল্প একজন পুরুষকে দিয়ে গার্ড অফ অনার দেয়ার বিষয়টি এসেছে। আমরা মন্ত্রণালয়কে এটা পরীক্ষা করে দেখতে বলেছি।’
বিষয়টি নিয়ে নিউজবাংলা কথা বলেছে দেশের বিভিন্ন উপজেলায় কর্মরত নারী ইউএনওদের সঙ্গে। তারা বলছেন, এই সুপারিশের মাধ্যমে নারীকে হেয় করার পাশাপাশি তাদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বকে বিতর্কিত করা হচ্ছে।
চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর ইউএনও নাজমুন নাহার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রথমত আমি এই সুপারিশের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। গার্ড অফ অনার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। এটার সঙ্গে ধর্মকে টেনে আনা অযৌক্তিক।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সংবিধান নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে বলেছে। এই সুপারিশ সংবিধানবিরোধী। এখানে নারীকে ছোট করা হয়েছে। তার ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হচ্ছে। প্রশ্নবিদ্ধ সুপারিশ এটি।
‘এ ধরনের সুপারিশ স্বাধীন বাংলাদেশে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য, সংবিধান পরিপন্থি, নারীর মানবাধিকার পরিপন্থি ও নারীর ক্ষমতায়ন পরিপন্থি। এ ধরনের সুপারিশ একজন নারীর জন্য যেমন অবমাননাকর, ঠিক একইভাবে একজন মুক্তিযোদ্ধার জন্যেও অপমানজনক।’
- আরও পড়ুন: জানাজা আর গার্ড অফ অনার এক নয়
ইউএনও নাজমুন নাহার দীর্ঘদিন মাঠ প্রশাসনে কাজ করছেন। প্রয়াত অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধার গার্ড অফ অনারে তিনি উপস্থিত থেকেছেন।
তিনি বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে গার্ড অফ অনার দিতে এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যার সম্মুখীন হইনি। মাঠের মানুষগুলো সহজ সরল। এদের (মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি) চেয়ে মাঠপর্যায়ের মানুষগুলো ভালো বোঝে।’
ইউএনও নাজমুন নাহারের আশঙ্কা, এ ধরনের সুপারিশের পেছনে কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠীর উসকানি থাকতে পারে।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে একটি শ্রেণি আছে, যারা নারীর ক্ষমতায়ন পছন্দ করে না। তারা নারীকে ঘরবন্দি করে রাখতে চায়। ওই শ্রেণির লোকজনের রোষানল থেকে বাঁচতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি এই সুপারিশ করতে পারে।’
নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ইউএনও চৈতী সর্ববিদ্যা পাল্টা প্রশ্ন তুলে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কর্মকর্তা তো কর্মকর্তাই। এতে নারী-পুরুষের প্রশ্ন কেন আসবে?’
একই জেলার কবিরহাটের ইউএনও হিসেবে আছেন হাসিনা আক্তার। তিনি বলেন, ‘ইউএনও একটি প্রশাসনিক পদ, ধর্মীয় নয়।’
জামালপুরের বকশিগঞ্জ উপজেলায় গার্ড অফ অনারে ইউএনও মুনমুন জাহান লিজা
হাসিনা আক্তার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানাতে জেন্ডার কোনো জটিল বিষয় নয়। এটাকে কেউ খাটো করলে তা নিতান্তই অগ্রহণযোগ্য। এটি (সংসদীয় কমিটির সুপারিশ) একান্তই কোনো মহলের ব্যক্তিগত মত। আমাদের রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ অনেক কর্মকর্তাই নারী, সে ক্ষেত্রে বিষয়টাকে একপেশে করে দেখা উচিত নয়।’
আরও পড়ুন: ‘নারী কর্মকর্তা বাদের সুপারিশকারীদের ক্ষমা চাইতে হবে’
শেরপুরের নালিতাবাড়ীর ইউএনও হেলেনা পারভিনের প্রশ্ন, একজন নারী কর্মকর্তা যদি সব কাজ করতে পারেন, তাহলে গার্ড অফ অনার দিতে বাধা কোথায়?
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ইসলামের দৃষ্টিকোণের কথা যদি ওঠে, তাহলে অন্য ধর্মের পুরুষ অফিসাররাও তো গার্ড অফ অর্নার দিতে পারবেন না। কাজেই এ নিয়ে বিতর্কের কোনো সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না।’
একই জেলোর শ্রীবরদী উপজেলার ইউএনও নিলুফা আক্তার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নারীরা মুক্তিযুদ্ধে অনেক বড় অবদান রেখেছেন। তারা এখন গার্ড অফ অনার দিলে সমস্যা কোথায়? আমরা মাঠপর্যায়ে সব কাজই তো করছি। তাহলে গার্ড অফ অনার দিতে পারব না কেন? রাষ্ট্র আমাদের যে দায়িত্ব দেবে, সেটা আমরা অন্য সব পুরুষ অফিসারের মতোই পালন করতে পারব।’
সংসদীয় কমিটির সুপারিশের প্রতিবাদ জানিয়েছেন নাটোরের লালপুরের ভারপ্রাপ্ত ইউএনও শাম্মী আক্তার।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকারিভাবে সব সময় নারী অধিকারের কথা বলা হচ্ছে। গার্ড অফ অনারে নারীর অংশগ্রহণে আপত্তি তোলা সরকারি নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যেখানে সব সময় নারী অধিকারের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে রাষ্ট্রীয় সম্মাননায় অংশগ্রহণ করতে না দেয়ার সুপারিশ বেমামান।’
নাটোরের বাগাতিপাড়ার ইউএনও প্রিয়াংকা দেবী পাল বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানাতে গার্ড অফ অনার দেয়া হয়। এটা তো জানাজার অংশ নয়। গার্ড অফ অনারের অর্থ হলো সামরিক উপায়ে সম্মান জানানো। এটা ধর্মীয় কোনো বিষয় না। তাই নারী কর্মকর্তার অংশগ্রহণ নিয়ে আপত্তি তোলার কোনো কারণ দেখি না।’
জানাজা ও গার্ড অফ অনার এক নয় বলে মন্তব্য করেছেন মানিকগঞ্জ সদরের ইউএনও জেসমিন সুলতানাও।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে গার্ড অফ অনার দিই। সেখানে কে নারী আর কে পুরুষ সেটা বিবেচ্য বিষয় না, বিষয়টি হলো মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের সংবিধান অনুযায়ী কিন্তু কোনো নারী-পুরুষ পার্থক্য করা যাবে না, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী দেখা যাবে না ,এটাও বলা আছে। সুতরাং আমি মনে করি, এটা সংবিধানবিরোধী কার্যকলাপ হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের মহান জাতীয় সংসদ এটা প্রণয়ন করছে। নতুন করে এ ধরনের কিছু জাতীয় সংসদে পাস হবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস। বর্তমান সরকার আমাদের নারী-পুরুষে ভেদাভেদ করবে না। কারণ আমরা আমাদের অবস্থান থেকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করছি কি না, সেটা আলোচ্য বিষয়। আমাদের দেশে পুরুষের পাশাপাশি অনেক নারী মুক্তিযোদ্ধাও রয়েছে।’
প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন চট্টগ্রাম থেকে সিফায়াত উল্লাহ, মানিকগঞ্জ থেকে আজিজুল হাকিম, সাভার থেকে ইমতিয়াজ উল ইসলাম, নাটোর থেকে নাজমুল হাসান, নোয়াখালী থেকে মোহাম্মদ সোহেল, শেরপুর থেকে শাহরিয়ার শাকির ও জামালপুর থেকে সাইমুম সাব্বির শোভন।