নেত্রকোণায় হত্যা মামলার বাদীপক্ষের বিরুদ্ধে বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের মামলা করার পর তার কাছ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ ওঠা পুলিশের তদন্ত সংস্থা পিবিআই কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে।
তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। সাত কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সেই কর্মকর্তা হলেন ধনরাজ দাস। তিনি নেত্রকোণা পিবিআইয়ের ইন্সপেক্টর ছিলেন।
পিবিআই কেন্দ্রীয় দপ্তরে ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার এই তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন বলে জানিয়েছেন নেত্রকোণা পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শংকর কুমার দাশ। তিনি জানান, সাত কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বলা হয়েছে।
তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে পিবিআইয়ের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক সায়েদুর রহমানকে। কমিটির অপর দুজন সদস্য ময়মনসিংহ পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার গৌতম কুমার বিশ্বাস ও ঢাকা পিবিআইয়ের সহকারী পুলিশ সুপার আমিনুল ইসলাম।
শংকর কুমার জানান, পিবিআই কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে ইন্সপেক্টর ধনরাজকে কিশোরগঞ্জ পিবিআই কার্যালয়ে তাৎক্ষণিক বদলি করা হয়েছে।
ঘটনা যা ঘটেছিল
এই পিবিআই কর্মকর্তা যার সঙ্গে ফোনে টাকা নিয়ে কথা বলেছিলেন, তার নাম আবুল হোসাইন। তিনি বারবার ধনরাজের কাছ থেকে টাকা ফেরত চাইছিলেন। ধনরাজ তাকে এসে টাকা নিয়ে যেতে বলছিলেন আর আবুল বলছিলেন, এসে দিয়ে যেতে হবে টাকা।
আবুল হোসাইনের বাড়ি কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার সেকান্দরনগর গ্রামে। তিনি নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলার ডাউকি গ্রামের সাবিজ মিয়ার মেয়ের জামাতা।
২০১৮ সালের ১৯ জুলাই রাত থেকে ২০ জুলাই সকালের মধ্যে কোনো এক সময়ে খুন হন কেন্দুয়ার ডাউকি গ্রামের সাবিজ মিয়ার ছেলে জুয়েল মিয়া।
সকালে গ্রামের মসজিদের সামনে থেকে মরদেহ উদ্ধারের পর ওই দিন কেন্দুয়া থানায় নিহতের বাবা সাবিজ মিয়া অজ্ঞাতদের আসামি করে মামলা করেন।
পরে এই মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। আর নানা হাত ঘুরে তদন্তের ভার আসে ইন্সপেক্টর আবদুল্লাহ আল মামুনের কাছে। তিনি গত ৪ ডিসেম্বর সাতজনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন।
১০ ডিসেম্বর আসামি জিয়াউল ও পলাশের বাড়ি ভাঙচুর, লুটপাটের ঘটনা হয়, এমন অভিযোগে তার ভাই জুলহাস মামলা করেন। এই মামলাটি হয় গত ২০ জানুয়ারি।
৭ লাখ ৪৫ হাজার টাকার মালামাল লুট ও ভাঙচুরের এই মামলায় খুন হওয়া জুয়েলের মা ললিতা আক্তার, ভগ্নিপতি আবুল হোসাইনসহ ছয়জনকে আসামি করা হয়।
এই মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা কেন্দুয়া থানার এসআই নোমান সাদেকীন গত ২ ফেব্রুয়ারি বিচারিক আদালতে ‘ঘটনা মিথ্যা’ উল্লেখ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন।
‘মিথ্যা মামলা’ করার জন্য বাদী জুলহাস মিয়ার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২১১ ধারা প্রয়োগের প্রস্তাবও দেন তদন্ত কর্মকর্তা নোমান সাদেকীন।
পরে এই মামলার বাদীপক্ষ আদালতে নারাজি দিলে মামলাটি আবার তদন্ত হয়। এবার দায়িত্ব পান ধনরাজ। তিনিও মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। তবে বাদীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলার অভিযোগ না এনে বলেন, ঘটনাটি রাতে ঘটেছে এবং কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সাক্ষী পাওয়া যায়নি।
এই মামলার তদন্ত চলাকালেই আবুল হোসাইনের স্বজনদের কাছ থেকে ধনরাজ টাকা নেন বলে অভিযোগ উঠছে। তবে পিবিআই কর্মকর্তা সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
ফাঁস হওয়া ফোনালাপে কী কথা
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া কল রেকর্ডে ভুক্তভোগীকে বলতে শোনা যায়, ‘আপনার অফিসে গিয়া আমি টাকা দিয়া আসছি, আপনি এখন আমার বাড়িতে আইসা টাকাটা দিয়া যান। আমি অভিযোগ উঠাইয়া নিয়া আইয়াম।‘
জবাবে পিবিআইয়ের কর্মকর্তাকে বলতে শোনা যায়, ‘আপনি আসেন। দিয়ে থাকলে নিয়ে যান।’
তখন ভুক্তভোগী বলছেন, ‘নিয়ে থাকলে মানে আপনি কি কিছু নিছেন না?’
ইন্সপেক্টর বলেন, ‘নিমু না কেরে। আপনি তো মোবাইলে...‘
এভাবেই ৯ মিনিট ২৬ সেকেন্ডের অডিও রেকর্ডে উঠে আসে ঘুষের টাকার লেনদেনের বিষয়টি।
ইন্সপেক্টর ধনরাজ কী বলছেন?
নিউজবাংলাকে পিবিআইয়ের কর্মকর্তা বলেন, ‘আবুল হোসাইন নানাভাবে চাপ দিয়ে আসছিলেন মামলার বাদীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করার অভিযোগ করতে। কিন্তু ঘটনার সত্যতা থাকায় তার আবদার রাখার সুযোগ ছিল না। এ কারণেই তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে আমার বিরুদ্ধে ঘুষ নেয়ার অভিযোগ তুলছেন। তার শাশুড়িকে দিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ দিচ্ছেন।’
১ লাখ ২০ হাজার টাকা ঘুষ নেয়ার কথা তিনি অস্বীকার করার পর কল রেকর্ডের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়া হলে ধনরাজ বলেন, ‘প্রায় দুই মাস আগে আবুল হোসাইনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি কথা বলার সময় বারবার টাকা ফেরত চাচ্ছিলেন। বাজেভাবে কথা বলছিলেন। আমার বিকাশ নম্বরে এক হাজার টাকা পাঠানোর কথা আবুল হোসাইন আমাকে বলেছেন। আমি বলেছি প্রমাণ দিয়ে টাকা নিয়ে যেতে।’
আবুল হোসাইন কী বলছেন
পিবিআইয়ের কর্মকর্তাকে ঘুষ দেয়ার অভিযোগ আনা আবুল হোসাইন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মামলায় আমাদের দায় দেখিয়ে আদালতে চার্জশিট দেয়ার ভয়ভীতি দেখান ধনরাজ। এমনকি একদিন আমাকে ডেকে নিয়ে তার অফিসে আটকে রাখেন টাকার জন্য।
‘পরে টাকা দেয়ার অঙ্গীকার করে সেদিন তার অফিস থেকে ছাড়া পাই। বাধ্য হয়ে প্রথম দফায় তাকে হাতে হাতে নগদ ১ লাখ টাকা, পরে ১৯ হাজার টাকা দিই। বাকি ১ হাজার টাকার জন্য বারবার তাগাদা করছিলেন ধনরাজ। শেষে ১ হাজার টাকা বিকাশে দিই। এখন আমি এই টাকা ফেরত চাই।’
টাকা দেয়ার বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে ফোনে বলা কথাবার্তার রেকর্ড আছে বলেও জানান আবুল।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বললেন, ঘটনা সত্য
ফাঁস হওয়া কল রেকর্ডের কথাবার্তায় উঠে আসে কেন্দুয়া উপজেলার সান্ধিকোনা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আবুল হাসেমের নামও।
তিনি বলেন, ‘টাকা তো নিছেন ধনরাজ দাস। ১ লাখ ২০ হাজার টাকাই নিছেন। এটা সত্য। আমি জানি। ধনরাজ দাস আমাকে ফোন করেছিলেন। ফোনে তিনি বলেছেন, আবুল হোসাইন যেন সমস্যার সৃষ্টি না করেন। টাকাটা দিয়ে দেবেন। আর যাতে কেউ না শোনে। কিন্তু ধনরাজ দাস পরে আর টাকাটা ফেরত দেননি।’