বরিশালে পোস্টার-ব্যানার অপসারণকে কেন্দ্র করে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুনিবুর রহমানের সরকারি বাসভবনে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের লিখিত বক্তব্যকে সংক্ষুব্ধ পক্ষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম।
পুরো ঘটনাকে মন্ত্রী দেখছেন নিছক ভুল-বোঝাবুঝি হিসেবে। তার আশা, এ নিয়ে সংকট দ্রুত নিরসন হবে।
সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে রোববার সাংবাদিকদের কাছে এসব কথা বলেন তাজুল।
মন্ত্রী বলেন, ‘কখনও কখনও সংক্ষুব্ধ পক্ষ এ রকম কথা বলতে পারে। সংক্ষুব্ধ পক্ষ তাদের পক্ষ থেকে আবেগ, ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বিভিন্নভাবে করতে পারে। সে রকম আবেগ, ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ অস্বাভাবিক কিছু না।
‘তারা মনে করেছেন তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রতিবাদের ভাষা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে।’
মন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর তার কাছে জানতে চাওয়া হয় তিনি অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের বক্তব্য সমর্থন করেন কি না। জবাবে উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে তিনি বলেন, ‘আমার সমর্থনের প্রশ্ন কেন আসছে?’
তিনি বলেন, ‘আমি সমর্থন করি সম্পূর্ণ সমস্যা সমাধান হয়ে সবাই শান্তিপূর্ণভাবে সহবস্থান করুক। শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করুক।’
ভুল-বোঝাবুঝির কারণ ব্যাখ্যায় তাজুল ইসলাম বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবে ভুল-বোঝাবুঝিই তো। আপনারা অন্য কিছু মনে করেন নাকি? সব ঘটনাই ভুল-বোঝাবুঝি থেকেই হয়।
‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধও ভুল-বোঝাবুঝির কারণে হয়েছিল। মহাযুদ্ধ যদি ভুল-বোঝাবুঝির কারণে হয়, তাহলে এখান থেকে ভুল-বোঝাবুঝি হবে না কেন? প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিঃসন্দেহে ভুল-বোঝাবুঝির কারণে হয়েছে।’
চলমান সংকটের মধ্যেও সিটি করপোরেশন তার কাজ শুরু করেছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘এখন তারা সেখানে ক্লিন করেছে। সেখানে প্রতিবাদ মিটিং-মিছিল ছিল। সেটা তো বন্ধ হয়েছে।
‘প্রশাসন এবং মেয়রদের পরস্পরের মধ্যে কিছু আলোচনা হয়তো হয়েছে। তারা হয়তো একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ে এসেছে। তারা নিজেরা দায়িত্বশীল এবং এখানে স্থানীয় যে প্রশাসন আছে, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসন, নির্বাহী কর্মকর্তা তারা তো দায়িত্বশীল।’
বরিশালের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহকে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই তিনি একজন দায়িত্বশীল মানুষ। তারা বুঝেছেন এটা নিজেদের মধ্যে একটা মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং। এটা কারও জন্যই শুভকর না।’
‘প্রয়োজনে তদন্ত’
বরিশালের ঘটনায় প্রয়োজনের সাপেক্ষে তদন্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন তাজুল ইসলাম। মন্ত্রণালয় ঠিক কীভাবে এ ইস্যুতে কাজ করছে, সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি তিনি।
মন্ত্রী বলেন, ‘প্রয়োজনের সাপেক্ষে তদন্ত অবশ্যই করা হবে। সবকিছুই তদন্ত করা হবে। সিটি করপোরেশন যেমনি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিষ্ঠান, প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের প্রত্যেককেই দায়িত্ব পালন করার জন্য সুযোগ করে দিতে হবে, স্ব-স্ব মর্যাদার প্রতি সম্মান করে।’
মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো তদন্ত কমিটি করা হয়নি।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মন্ত্রী বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে যেহেতু মামলা হয়েছে, পুলিশ তদন্ত করবে। আমাদের পক্ষ থেকে যদি তদন্ত করার দরকার হয়, সেটা আমরা তো বিভিন্নভাবেই করি।
‘এটা সাংবাদিকদের তো বলারই দরকার নেই। আমার মনে হয়, আপনারা নিশ্চয়ই চাইবেন না যে, আমরা আমাদের কাজ কী করি পুঙ্খানুপুঙ্খ এই মুহুর্তে আপনাদেরকে বলে ফেলি। কাজটি একটি ফলাফল আকারে আসলে তখন হয়তো আপনারা জানবেন। আপনারা চান যে সমস্যাগুলো নিরসন হোক, ভুল-বোঝাবুঝি না থাকুক, আমরাও চাই।’
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি যে উভয়েই দায়িত্বশীল। তাদের স্ব-স্ব দায়িত্ববোধের কারণে এ সমস্যা নিরসন হবে।’
প্রশাসন ক্যাডারদের সংগঠন থেকে যে প্রেস রিলিজ দেয়া হয়েছে, এতে রাজনীতিবিদদের সঙ্গে প্রশাসনের দূরত্ব তৈরি হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেন, ‘না, আমি একেবারেই মনে করি না।’
তিনি বলেন, ‘মতপার্থক্য থাকতে পারে; এটা থাকবেই। পরিবারের ভেতরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যেমনি মতপার্থক্য থাকে, বাবা-সন্তানের মধ্যেও মতপার্থক্য থাকে। আমরা যারা কাজ করি, আমার অধীনস্থদের সঙ্গে আমার যেভাবে কথায় মতপার্থক্য থাকে, আবার আমরা একসঙ্গে কাজও করি।’
‘কখনও কখনও একটা বিষয়ে আমি এক রকম মনে করি আবার আরেকজন আরেক রকম মনে করে। সময়ের ব্যবধানে আমরা আবার উভয়েই ঐকমত্যে পৌঁছাই।’
কী হয়েছিল বরিশালে
গত বুধবার রাতে ব্যানার অপসারণ নিয়ে বরিশাল সদরের ইউএনও মুনিবুর রহমানের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা স্বপন কুমার দাসের কথা-কাটাকাটি হয়।
প্রশাসনিক কর্মকর্তার সঙ্গে থাকা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এ সময় ইউএনওর সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন।
এ সময় আনসার সদস্যদের সঙ্গে হাতাহাতি শুরু হলে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এবং ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ইউএনওর বাসায় হামলার চেষ্টা চালান। আনসার সদস্যরা গুলি ছুড়লে প্রশাসনিক কর্মকর্তা স্বপন কুমার দাসসহ চারজন আহত হন।
সংঘর্ষের পর সদর ইউএনওর কার্যালয়ের সামনে পুলিশ অবস্থান নিলে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা আবার ইউএনওর বাসভবনে হামলার চেষ্টা করেন। এ সময় পুলিশ ও সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে।
যা ছিল সেই বিবৃতিতে
এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। বৃহস্পতিবার রাতে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের এক বিবৃতিতে বরিশালের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর গ্রেপ্তার দাবি করা হয়।
বিবৃতিতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও তার অনুসারীদের ‘দুর্বৃত্ত বাহিনী’ উল্লেখ করা হয়েছে, মেয়রকে ‘অত্যাচারী’ বলা হয়েছে।
বিবৃতিটি ছিল এমন: ‘আইনের মাধ্যমেই দুর্বৃত্তদের মোকাবিলা করা হবে এবং আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। বরিশালের ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সরকারি কর্তব্য পালন করতে গিয়ে একজন নির্বাহী কর্মকর্তা কীভাবে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের দ্বারা হেনস্থা হয়েছেন। তার বাসায় হামলা করা হয়, যেখানে তার করোনা আক্রান্ত অসুস্থ বাবা-মা ছিলেন। তাদের উপস্থিতিতেই ওই কর্মকর্তাকে গালিগালাজ করা হয়েছে। তার বাড়ির গেট ভেঙে প্রবেশ করে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। তার চামড়া তুলে নেয়ার জন্য প্রকাশ্যে স্লোগান দিয়ে মিছিল করেছে দুর্বৃত্তরা।’
বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের অভিযোগ, মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ ও তার ‘দুর্বৃত্ত বাহিনী’ সিটি করপোরেশনের কর্মচারীদের দিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন। তারা পুরো জেলায় ‘ত্রাসের রাজত্ব’ কায়েম করেছেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘মেয়রের অত্যাচারে বরিশালবাসী অতিষ্ঠ। মেয়রের হুকুমেই এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে বলে অ্যাসোসিয়েশন মনে করে। অ্যাসোসিয়েশন অবিলম্বে তার গ্রেপ্তার দাবি করছে। পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়ার জন্য অঙ্গীকার ব্যক্ত করছে।’