আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাম্প্রতিক অভিযানে আলোচিত অভিনেত্রী পরীমনি, কথিত মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসাসহ বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এসব ঘটনায় বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে সংবাদ মাধ্যমে।
এর মধ্যে কিছু প্রতিবেদন বিতর্ক ছড়িয়েছে। বিভিন্ন ধরনের আলোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এ ধরনের ঘটনার খবর প্রকাশে সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে চলছে বিতর্ক।
সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষকরা বলছেন, প্রচার বাড়াতে রগরগে শিরোনাম দেয়া আর জনতুষ্টির স্রোতে গা ভাসানো সাংবাদিকতার কাজ নয়। স্পর্শকাতর বিষয়ে সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে অভিযুক্তের ‘সম্মান অক্ষুণ্ন’ রেখে উভয় পক্ষের বক্তব্য নিয়ে সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা নিশ্চিত করার তাগিদও দিচ্ছেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও সাংবাদিকতার শিক্ষক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক মনে করেন, স্পর্শকাতর ইস্যুতে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা যেমন বজায় রাখতে হবে, তেমনি সংবাদের কারণে কারও যাতে সম্মানহানি না হয়, সেটিও বিবেচনায় রাখতে হবে।
অভিনেত্রী পরীমনিকে গ্রেপ্তারের ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘সংবাদমাধ্যমের যে কাজটা করা দরকার, সেটা হলো বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে সেই বিষয়টি প্রচার হচ্ছে কি না, সেটা খেয়াল রাখা। কেউ কিছু একটা বললে সেটাই সংবাদমাধ্যমে প্রচার করতে হবে বিষয়টি তেমন না।’
এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীরও দায় আছে বলে মনে করেন আরেফিন সিদ্দিক। তিনি বলেন, ‘পুলিশেরও দেখা উচিত, অভিযুক্ত মানুষটিরও সম্মান কোনোভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে কি না।’
কোনো তথ্য পেলেই তা প্রচার করা সংবাদমাধ্যমের কাজ নয় জানিয়ে সাংবাদিকতার এই শিক্ষক বলেন, ‘ঘটনার নানা দিক ক্রস চেকের মাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রচার করাই সংবাদমাধ্যমের কাজ।’
বিষয়টিকে একইভাবে দেখছেন সিনিয়র সাংবাদিক ও টিভি টুডের প্রধান সম্পাদক মনজুরুল আহসান বুলবুল।
স্পর্শকাতর সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে বিশেষ দৃষ্টি রাখার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘খেয়াল রাখতে হবে ভার্চুয়াল মিসটেক যাতে না হয়, তথ্যগত বিভ্রান্তি যাতে না থাকে, আর যাকে নিয়ে নিউজ করছি, তাকে বা তাদের আমি যাতে অসম্মানিত না করি শব্দচয়নে-উপস্থাপনে বা ছবি দেখানোর মধ্যে।’
সাংবাদিকতায় নির্মোহ একটি অবস্থান থাকা জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সংবাদে এমন কিছু থাকবে না যাতে কারো প্রতি বেশি ভালোবাসা বা কারো প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ পায়। এটাই সাংবাদিকতার মূল নিয়ম।’
জনজীবনের কল্যাণে সাংবাদিকতা করার আহ্বান জানিয়ে সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার প্রশিক্ষক কুর্রাতুল-আইন-তাহমিনা বলেন, ‘সাংবাদিকদের জনমানুষের জীবন ও জগৎ সম্পর্কে জানা-বোঝা থাকা প্রয়োজন। মানুষের কাজে লাগা, জনজীবনের কল্যাণে সাংবাদিকতা করা, যথাসাধ্য পূর্ণ সত্য প্রকাশ করা তাদের দায়িত্ব।’
তিনি বলেন, ‘জনগোষ্ঠীর সবাই, সব অংশ সাংবাদিকের মনোযোগ দাবি করে৷ নাজুক কোণঠাসা অবস্থানের মানুষ, সমস্যাপীড়িত বিপর্যস্ত মানুষ, শিশু, কলঙ্ক, ক্ষতি বা ঝুঁকিতে থাকা মানুষের দাবি বেশি৷ তাদের প্রতি বিশেষভাবে সংবেদনশীল হতে হয়৷ তাদের প্রতি সাংবাদিকের বিশেষ দায়িত্ব থাকে৷ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কারো অন্যায্য ক্ষতি না করার বড় দায়িত্ব থাকে।’
জনস্বার্থ আর জনকৌতূহল এক বিষয় নয় মন্তব্য করে তাহমিনা বলেন, ‘সাংবাদিক জনস্বার্থে কাজ করবেন৷ জনস্বার্থ আর জনকৌতূহল কিন্তু এক নয়৷ জনকৌতূহল তৃপ্ত করায় ঝুঁকলে জনস্বার্থের ক্ষতি করার শংকা থাকে৷ আবার কখনও একজনের স্বার্থ বা কল্যাণ দশজনের দাবির চেয়ে বড় ও ন্যায্য হতে পারে৷ সেখানেই জনস্বার্থ নিহিত থাকতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘ব্যক্তিগত জীবন ও বিষয়ে একান্ততা, নিভৃতি বা গোপনীয়তার অধিকার প্রত্যেকের আছে৷ সাধারণ মানুষ, শিশু, বিপর্যস্ত জনের এ অধিকার একটু বেশি। তবে প্রমাণিত গুরুতর অপরাধী বা জনব্যক্তিত্বেরও এ অধিকার থাকে, থাকে মানবিক মর্যাদার দাবি৷
‘জনস্বার্থের ন্যায্য ও জোরালো যুক্তি ছাড়া সাংবাদিক কারও এসব অধিকার ক্ষুণ্ন করতে পারেন না, নিছক জনকৌতূহল তৃপ্ত করার জন্য তো নয়ই৷ স্পর্শকাতর বিষয়ে নীতিনৈতিকতার এই মৌলিক কথাগুলো বিশেষভাবে মনে রাখতে হয়৷’
অনলাইনভিত্তিক স্যাটায়ার ও হিউমার সাইট ইআরকি সম্পাদক সিমু নাসেরের অবস্থান ‘রগরগে শিরোনামের’ বিপক্ষে।
তিনি বলেন, ‘স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতে সংবাদমাধ্যমের লক্ষ্য হওয়া উচিত সত্যকে খুঁজে বের করা। শুধু সেনসেশনাল হেডলাইন না করে, একটা মানুষকে সেক্সুয়ালি অবজেক্টিফাই না করে আসল ঘটনা খুঁজে বের করা সংবাদমাধ্যমের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।’
কাটতি বাড়ানোর জন্য ক্লিক বেইজড শিরোনাম না করার আহ্বানও রেখেছেন তিনি।