পারিবারিকভাবে এক বছর আগে বিয়ে হয় দিনমজুর হুমায়ুন কবির ও মোছা. সাবিকুন্নাহারের। তাদের ছেলে সন্তানের জন্ম গত জুলাইয়ে। ওই শিশুকে গত শুক্রবার গভীর রাতে পুকুরে ফেলে হত্যার অভিযোগ উঠেছে সাবিকুন্নাহারের বিরুদ্ধে।
ময়মনসিংহের তারাকান্দার বিসকা ইউনিয়নের লালমা গ্রামে এ ঘটনায় শনিবার আটক হয়েছেন সাবিকুন্নাহার। স্বামী হুমায়ুনের মামলায় পুলিশ তাকে আদালতে তোলার পর সন্তান হত্যার কথা স্বীকারও করেছেন তিনি। এরপর তাকে পাঠানো হয় কারাগারে।
তবে সাবিকুন্নাহারের স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ির লোকজন এখন বলছেন, সন্তান জন্মের পর থেকে মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। এ কারণেই হত্যার ঘটনাটি ঘটতে পারে।
সোমবার খবর পাওয়া যায়, স্ত্রীকে মুক্ত করতে আদালতপাড়ায় আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করতে গেছেন হুমায়ুন। এতে প্রশ্ন ওঠে, সন্তান হত্যার অভিযোগে স্ত্রীর নামে মামলা দিয়ে আবার তাকে ছাড়িয়ে নিতে তিনি কেন তৎপর হলেন!
এ বিষয়ে খোঁজ নিতে লালমা গ্রামে যান নিউজবাংলার প্রতিবেদক।
সাবিকুন্নাহারের শ্বশুরবাড়ি গিয়ে কথা হয় শ্বশুর আবুল কাশেমের সঙ্গে। তিনি নিউজবাংলাকে জানান, পরিবারের কারও সঙ্গে সাবিকুন্নাহারের কলহ বা মনোমালিন্য ছিল না। তবে বাচ্চার জন্মের পর থেকে বুকের দুধ না আসায় তিনি কিছুটা অস্থির ছিলেন। এ জন্য তাকে কবিরাজি ওষুধও খাওয়ানো হয়।
কাশেম বলেন, ‘বাচ্চার প্রতি তাকে বিরক্ত দেখা যায় নাই কখনও। হঠাৎ গত শুক্রবার রাত ৩টার দিকে বাচ্চাকে পাওয়া যাচ্ছিল না। থানায় খবর দিলে পুলিশ এসে তাকে (সাবিকুন্নাহার) দুপুরে (শনিবার) আটক করে থানায় নিয়ে যায়।
‘পুলিশ বলছে মামলা করতে হবে। তাই আমার ছেলে হুমায়ুন মামলা করছে। এর মধ্যে বিকেল ৫টার দিকে বাড়ির পিছনের পুকুরে বাচ্চার লাশ ভাসতে দেখে উদ্ধার করি।’
তিনি বলেন, ‘ঘটনার তিন দিন আগে থেকেই সাবিকুন্নাহার বলছিল, তার শরীরটা ভালো লাগছে না। এর আগে কখনও এমন করে বলেনি। ও খালি বলত “আমার কিছু ভাল লাগে না”। চুপচাপ থাকতো। আমি বলছিলাম শনিবার ৫০০ টাকা ভিজিট দিয়ে তোমাকে ডাক্তার দেখাব। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আগের দিনই এই ঘটনা ঘটল।’
আবুল কাশেম বলেন, ‘সংসারে কারও সঙ্গে তার সামান্যতম মনোমালিন্য নেই। সুখের সংসার ছিল। তবু যেহেতু নিজের সন্তানকে পুকুরে ফেলে দিয়েছে, সেহেতু তার মাথায় হঠাৎ কোনো সমস্যা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। কারণ একজন সুস্থ মা তার কোলের শিশুকে কোনো কারণ ছাড়াই হত্যা করতে পারে না।’
প্রতিবেশী এমদাদুল হক ও তাসলিমা খাতুনও জানান, সবার সঙ্গে সাবিকুন্নাহারের ভালো সম্পর্ক ছিল। নিজের সন্তানকে তিনি মেরে ফেলেছেন, তা তাদের বিশ্বাস হচ্ছে না।
মামলার নথিতে সাবিকুন্নাহারের স্বামী উল্লেখ করেছেন, তিনি রাজধানীর একটি হোটেলে বাবুর্চির কাজ করেন। ঘটনার দিন ঢাকায় ছিলেন। বাচ্চা নিখোঁজের খবর পেয়ে বাড়ি গিয়ে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন কীভাবে বাচ্চা হারাল।
এজাহারে বলা হয়েছে, সাবিকুন্নাহার স্বামীকে জানান, ভোররাতে সাদা শাড়ি পরা দুই নারী তার কোল থেকে বাচ্চা নিয়ে যায়। বাচ্চাকে পানি খাওয়াতে হবে বলে তারা নিয়ে যায়। পরদিন বাচ্চার মরদেহ পুকুরে ভাসতে দেখে পুলিশ সাবিকুন্নাহারকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এক পর্যায়ে বাচ্চাকে পুকুরে ছুড়ে ফেলার কথা স্বীকার করেন তিনি।
হুমায়ুন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্ত্রীর সঙ্গে আমার কখনও ঝগড়া ছিল না। বাচ্চাকে হত্যা করার মতো কোনো কারণও আমি খুঁজে পাইনি। যেহেতু কয়েক দিন ধরে বলছে তার শরীরটা ভালো লাগছে না। সেহেতু ধারণা করছি হয়ত হঠাৎ মাথায় কোনো সমস্যা হয়েছে। পুলিশ মামলা করতে বলায় মামলা করেছি।’
এখন কেন স্ত্রীকে ছাড়িয়ে আনতে চান, এমন প্রশ্নে হুমায়ুন বলেন, ‘সাবিকুন্নাহারকে জামিনে মুক্তি দেয়া হলে তার চিকিৎসা করাতে চাই। নিশ্চিত হতে চাই সে আসলেই নিজের সন্তানকে ইচ্ছা করে হত্যা করেছে কিনা। নাকি মানসিক কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে। মানসিক সমস্যার কারণে হলে আমাদের সন্তানকে সে হত্যা করলেও ক্ষমা করে দিব। কারণ সে হয়ত না বুঝে এমন করেছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি মামলা না করলে পুলিশ বাদি হয়ে মামলা করত। তাই আমাকে দিয়েই মামলা করানো হয়েছে। ছেলেকে হত্যার বিষয়ে আমার স্ত্রী যে কথাগুলো বলেছে সবই অসংলগ্ন। একজন মানুষ নিজেকে বাঁচাতে অনেক মিথ্যা কথা বলে, কিন্তু সে ভালোভাবে মিথ্যা কথাও সাজাতে পারেনি। বলেছে, গভীর রাতে দুইজন নারী বাচ্চাকে চাইতেই তাদের হাতে তুলে দিয়েছে।
‘সুস্থ হলে সে নিজেকে বাঁচাতে কঠিন মিথ্যা কথার আশ্রয় নিতে পারত। তাই স্ত্রীকে ছাড়াতে আইনজীবীর পরামর্শ নিচ্ছি। আমি তাকে চিকিৎসা করাতে চাই৷ অথবা সরকারিভাবেই চিকিৎসা করানো হোক।’
ময়মনসিংহ জেলা আইনজীবী সমিতির সহসভাপতি নজরুল ইসলাম চুন্নু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মা কিংবা বাবা যেই হোক, কেউ বাচ্চাকে হত্যা করতে পারে না। এটি আইনের দৃষ্টিতে গুরুতর অপরাধ। যদি কোনো স্বামী যদি বলেন, আমার স্ত্রীর মানসিক সমস্যা রয়েছে, তবুও আইনের দৃষ্টিতে তার জিম্মায় স্ত্রীকে দেয়ার সুযোগ নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘তবে এই বিষয়টি আমলে নিয়ে পুলিশ তদন্ত করে দেখবে আসলেই মূল ঘটনা কী? অথবা মানসিক সমস্যা রয়েছে কিনা। যদি মানসিক সমস্যা থাকে, সেক্ষেত্রে কারা হাসপাতালে কিংবা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর বিধান আইনে আছে।
‘কিন্তু স্বামী বললেই স্ত্রীকে তার হাতে তুলে দেয়ার আবদারটি একেবারেই বেআইনি। সে আসলেই মানসিক সমস্যায় ভুগছিল কিনা, পুলিশই সেটি তদন্ত করে বের করবে।’
তবে তারাকান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়েরের দাবি, ওই নারী বাচ্চাকে হত্যা করে কাল্পনিক গল্প বলেছেন। নিজেকে বাঁচাতে এমন বলেছেন।
ওসি বলেন, ‘তার স্বামী চাইলে জামিনের ব্যবস্থা করতেই পারেন। এরপর তার মানসিক রোগ আছে কিনা দেখতে পারে। আদালতের মাধ্যমেও তার ডাক্তারি পরীক্ষা করা যেতে পারে। যেহেতু মামলা হয়ে গেছে, সেহেতু সবকিছুই এখন আইনি প্রক্রিয়ায় হবে।’