পদ্মা নদীতে ডুবে যাওয়ার সাত বছর পরও উদ্ধার করা হয়নি যাত্রীবাহী লঞ্চ পিনাক-৬। এর মধ্যে মারা গেছেন এ ঘটনায় করা মামলার প্রধান আসামি। তাতে স্বজন হারানোদের হতাশা আরও ভারী হয়েছে।
সময়ের পরিক্রমায় আবারও এলো ৪ আগস্ট। দিনটি মনে করিয়ে দিচ্ছে সাত বছর আগে পদ্মার তীরে এক শোকাতুর দিনের কথা। ঈদ শেষে পিকাক-৬ এ চড়ে ঢাকায় ফিরছিলেন আড়াই শতাধিক যাত্রী। কাওড়াকান্দি থেকে রওনা হয়ে মাওয়ার অদূরে উত্তাল পদ্মার ঢেউয়ের তোড়ে ডুবে যায় লঞ্চটি।
সরকারি হিসাবে বলা হয়, ২০১৪ সালে ওই লঞ্চ ডুবিতে ৪৭ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। নিখোঁজ অন্তত ৬০ জন।
মরদেহগুলোর মধ্যে পাঁচ নারী, দুই পুরুষ, পাঁচ শিশুসহ ১২ জনের পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় তাদের মরদেহ শিবচরের পাচ্চর এলাকায় বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করে প্রশাসন।
দেশের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সোনার মেশিন (সমুদ্রের তলদেশে জরিপ কাজে ব্যবহৃত) ব্যবহার করেও পদ্মায় ডুবে যাওয়া পিনাক-৬ লঞ্চটির কোনো সন্ধান করা সম্ভব হয়নি।
স্বজনদের দাবি, ডুবে যাওয়া পিনাক-৬-এর ভেতরে অনেক মরদেহ রয়েছে। লঞ্চটি উদ্ধার হলে ভেতরে আটকে থাকা যাত্রীদের দেহাবশেষ পাওয়া যেত।
পিনাক-৬ উদ্ধার অভিযান পরিত্যক্ত ঘোষণার পর স্বজন হারানোদের কেউ কেউ মরদেহের খুঁজে নিজ উদ্যোগে তল্লাশি চালান চাঁদপুর, শরীয়তপুর, বরিশাল, ভোলাসহ ভাটি অঞ্চলে। নদীর একূল-ওকূল তন্ন তন্ন করেও কোনো মরদেহ পাওয়া যায়নি।
পিনাক-৬ ডুবিতে স্বজন হারিয়েছেন মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ীর বেতকা ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার আমানুল হক। জানান, ওই লঞ্চে ঢাকার আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ুয়া তার নাতনি ইমা আক্তারও ছিল।
তিনি বলেন, ‘ঘটনার দিন থেকে বিভিন্ন স্থানে টানা ৯ দিন সন্ধান করেও নাতনির খোঁজ পাইনি। খুব আদরের নাতনি ছিল ইমা। ওই লঞ্চ ডুবির পর প্রতিবছর ঈদ এলেই আমাদের পরিবারে ফিরে আসে বিষাদের ছায়া।’
মাদারীপুরের শিবচরের দৌলতপুর গ্রামে ঈদ শেষে ঢাকার পথে পিনাক-৬ এ পদ্মা পারি দিচ্ছিলেন ফরহাদ মাতুব্বর, তার স্ত্রী শিল্পী, এক বছরের সন্তান ফাহিম ও শ্যালক বিল্লাল। এ চারজনের লাশ আজও উদ্ধার হয়নি।
ফরহাদের বোন প্রিয়া আক্তার জানালেন, ওই ঘটনার পর থেকে তাদের পরিবারে কোনো ঈদ নেই। প্রিয়জনের লাশ পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে এখন বিচারের অপেক্ষায় প্রিয়া।
পিনাক ডুবির পর লঞ্চের মালিক আবু বক্কর সিদ্দিক কালু, তার ছেলে ওমর ফারুক, কাঁঠালবাড়ী ঘাটের ইজারাদার আতাহার আলীসহ ছয়জনকে আসামি করে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং থানায় মামলা হয়। ওই মামলায় আবু বক্কর সিদ্দিক কালুকে চট্টগ্রাম থেকে এবং তার ছেলে ওমর ফারুককে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
ইতোমধ্যে মারা গেছেন প্রধান আসামি কালু। এ ছাড়া, লঞ্চটিও উদ্ধার করা যায়নি। তাতে বিচার কার্যক্রমের অগ্রগতি নিয়ে তৈরি হয়েছে আশঙ্কা।
অনেক চেষ্টা করেও উদ্ধার করা যায়নি পদ্মায় ডুবে যাওয়া পিনাক-৬ লঞ্চ। ফাইল ছবি
শিমুলিয়া বাংলাবাজার নৌরুটের মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শোকের মাস তার ওপর করোনাভাইরাস। তাই পিনাক-৬ ডুবি উপলক্ষে কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারিনি। এদিনটি আসলে শিমুলিয়া ঘাটে শোকের ছায়া চলে আসে; মনে হয় কালো অন্ধকার।’
পিনাক-৬ ডোবার পর শিমুলিয়া ঘাটে অনেক পরিবর্তন এসেছে বলে জানালেন মনির হোসেন। বললেন, আগে তিন ঘাটে দায়িত্বে ছিলেন বিআইডব্লিউটিএর একজন নৌ-ট্রাফিকের ইন্সপেক্টর। এখন তিনজন ইন্সপেক্টর ও একজন উপ-পরিচালক লঞ্চ ছাড়া এবং ধারণ ক্ষমতার ব্যাপারে তদারকি করেন। তাদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কাজ করা হয়।
পিনাক-৬ ডুবির ঘটনায় মামলা প্রসঙ্গে মনির হোসেন জানালেন, লঞ্চটির মালিক আবু বক্কর সিদ্দিক কালু বেশ কিছুদিন আগে মারা গেছেন। মামলায় তার ছেলেই এখন একমাত্র আসামি।
শিমুলিয়া নদী বন্দরের সহকারি পরিচালক নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা মো. সাদাত হোসেন নিউজবাংলাকে জানান, পিনাক-৬ ডোবার আগে তিন ঘাটের দায়িত্ব একজন ইন্সপেক্টর ছিল। সারা রাত লঞ্চ চলত। তদারকি কম ছিল। ধারণক্ষমতার ব্যাপারেও বেশি কিছু বলা হতো না। এখন তিনজন ইন্সপেক্টর দায়িত্বে। এ ছাড়া, ঘাটে আরেকজন উপ-পরিচালক পদে দায়িত্বে রয়েছেন। সবসময় তদারকি চলে।
পিনাক-৬ ডুবিতে স্বজন হারানোদের কান্না এখনও থামেনি। ফাইল ছবি
তিনি জানান, লঞ্চগুলোর ফিটনেস রেজিস্ট্রেশন আছে কিনা তা যাছাইয়ে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। এসবই হয়েছে পিনাক-৬ ডোবার পর। আগে রাতে ২৪ ঘণ্টায় লঞ্চ চলত, এখন সেটি রাত ৮টা পর্যন্ত করা হয়েছে।
লৌহজং থানার ওসি আলমগীর হোসাইন জানান, পিনাক-৬ ডোবার পর বেপরোয়া যান চলাচল, অতিরিক্ত যাত্রী বহন ও অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে বিআইডব্লিউটিএর পরিবহন পরিদর্শক জাহাঙ্গির ভূঁইয়া বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন। তদন্ত শেষে ২০১৭ সালে আসামিদের বিরুদ্ধে মুন্সীগঞ্জের সংশ্নিষ্ট আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। বর্তমানে মামলাটি আদালতে বিচারাধীন।
মুন্সীগঞ্জ আদালত সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন কারাগারে থেকে পিনাক-৬ লঞ্চের মালিক আবু বক্কর সিদ্দিক কালু ও তার ছেলে ওমর ফারুকসহ আসামিরা জামিনে রয়েছেন। কালুর মৃত্যুর বিষয়টি তাদের জানা নেই।