ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তিন দিনের রিমান্ডের পর আদালতে আরও দুই মামলার শুনানির সময় অনেকটাই স্বাভাবিক ছিলেন আলোচিত ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীর।
এ সময় তাকে তার আইনজীবী মো. শফিকুল ইসলাম ও স্বামী জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে নিচু স্বরে কথা বলতে দেখা যায়। তবে রিমান্ড শুনানি শেষে হেলেনাকে বেশ বিচলিত দেখাচ্ছিল। আইনজীবী শফিকুল ইসলামের মুখও এ সময় মলিন দেখায়।
মঙ্গলবার ঢাকার মুখ্য মহানগর আদালতের (সিএমএম) হাকিম শাহিনুর রহমানের আদালতে পল্লবী থানায় পুলিশের করা টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ও এক সাংবাদিকের করা চাঁদাবাজির মামলায় হেলেনাকে আট দিন পুলিশি হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেয়া হয়।
শুনানি শেষে রিমান্ড আদেশ শুনে অনেকটা অস্থির হয়ে পড়েন স্বামী জাহাঙ্গীর। অস্ফুট স্বরে তিনি বলেন, ‘এই মামলায়ও রিমান্ড?’
এরপর নির্লিপ্ত হয়ে আদালতের এজলাস কক্ষ ত্যাগ করেন তারা।
বৃহস্পতিবার রাতে হেলেনা জাহাঙ্গীরকে তার গুলশানের বাসা থেকে আটক করে র্যাব। শুক্রবার রাতে তার বিরুদ্ধে গুলশান থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এবং পল্লবী থানায় টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়।
এর মধ্যে গুলশান থানায় করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলাটিতে তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে এই মামলায় তাকে তিন দিনের রিমান্ডে পাঠায় আদালত।
হেলেনার বিরুদ্ধে সোমবার বিকেলে পল্লবী থানায় চাঁদাবাজির মামলা হয়। মামলাটি করেন আব্দুর রহমান তুহিন নামে ভোলার এক সাংবাদিক।
মামলাটির বিষয়ে পল্লবী থানা জানায়, হেলেনার মালিকানাধীন জয়যাত্রা টিভিতে ভোলা প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেয়ার নামে আব্দুর রহমান তুহিনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নেয় কর্তৃপক্ষ।
টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনে করা মামলায় সাত দিন এবং চাঁদাবাজি মামলায় সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। শুনানি শেষে দুই মামলায় চার দিন করে মোট আট দিনের রিমান্ড আদেশ দেন বিচারক।
এর আগে শুক্রবার রাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গুলশান থানায় করা মামলায় হেলেনাকে তিন দিনের পুলিশি হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেয় পুলিশ।
শুনানির সময় আদালতে হেলেনা আত্মপক্ষ সমর্থনে চিৎকার করে বলেন, ‘আমি সরকারের লোক।’
আদালতে বিচারক হেলেনা জাহাঙ্গীরের কাছে আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছু বলার আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি সরকারের লোক। আমি আওয়ামী লীগের লোক। আমার পদ এখনও যায়নি। আমাকে কোনো শোকজ করা হয়নি। আমি কোনো নোটিশ পাইনি। আমার জীবনে আমি ফেসবুকে কোনো দিন সরকারের বিপক্ষে লিখি নাই। আমি সরকারের লোক। আওয়ামী লীগের লোক। আমি আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে কাজ করি।’
হেলেনা আরও বলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করি। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রায় ২৫টা দেশ সফর করেছি। আমি কীভাবে সরকারের বিপক্ষে কথা বলব। কোথাও কোনো প্রমাণ নেই আমার ফেসবুকে। কোনো পেজে। বরং কেউ যদি কথা বলে থাকে সেটার প্রতিবাদে আমি দাঁড়িয়েছি। সেই ভিডিও আছে আমার ফেসবুকে। সেটার ভিডিও আছে আমার ফেসবুকে।’
তিনি বলেন, ‘তারা বিভিন্ন দলের হয়ে আমেরিকা থেকে, কানাডা থেকে সরকারের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে। দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা করছে। তাদের বিপক্ষে আমি কথা বলেছি। এগুলোর প্রমাণ আমার কাছে আছে।’
তবে এ সময় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে একটি কল রেকর্ড বিচারককে দেয়া হয়। যেখানে হেলেনা জাহাঙ্গীরের কণ্ঠ শোনা যায়।
ভিডিওতে হেলেনা জাহাঙ্গীরকে বলতে শোনা যায় তিনি প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য কাউকে গুনে চলেন না। ‘কোনো মন্ত্রীকে গোনার সময় নাই।’
গৃহবধূ থেকে ব্যবসায়ী হয়ে সিআইপির (কমার্শিয়ালি ইমপর্টেন্ট পারসন) স্বীকৃতি পাওয়া এই ব্যবসায়ী সম্প্রতি তুমুল আলোচিত হয়ে ওঠেন ‘আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ’ নামে একটি সংগঠনের প্রচার চালাতে গিয়ে। আওয়ামী লীগের এই নামে কোনো সংগঠন নেই। তিনি এই সংগঠনকে সামনে নিয়ে আসার পর ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থকদের কাছ থেকে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েন।
এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের পদ হারান হেলেনা। ক্ষমতাসীন দলের মহিলাবিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্যপদ ছাড়াও কুমিল্লা উত্তর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টার পদ থেকেও অব্যাহতি দেয়া হয় তাকে। ওই ঘটনায় পিছুটান দেন হেলেনা। বলেন, তিনি ‘আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ’ নামে এই সংগঠনের কেউ না। তাকে সম্প্রতি সভাপতি হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল।
র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১-এর অভিযানে ২৯ জুলাই রাতে রাজধানীর গুলশান-২ এলাকার ৩৬ নং রোডের ৫ নং বাড়ি ‘জেনেটিক রিচমন্ড’-এ অভিযান পরিচালনার পর হেলেনা জাহাঙ্গীরকে আটক করা হয়। অভিযানে জব্দ করা হয় ১৯ বোতল বিদেশি মদ, ১টি ক্যাঙ্গারুর চামড়া, ১টি হরিণের চামড়া, ২টি মোবাইল ফোন, ১৯টি চেকবই ও বিদেশি মুদ্রা, ২টি ওয়াকিটকি সেট এবং জুয়া (ক্যাসিনো) খেলার সরঞ্জাম ৪৫৬টি চিপস। পরবর্তী সময়ে মধ্যরাতে তার জয়যাত্রা টেলিভিশন স্টেশনেও অভিযান পরিচালনা করা হয়।