গাড়ির ব্যবস্থা না করেই শ্রমিকদের কাজ করাতে ঢাকায় আনার পরদিন তীব্র সমালোচনার মুখে সরকার ও পোশাকশিল্পের মালিকদের কেউ দায় নিতে রাজি হচ্ছেন না।
এভাবে গাদাগাদি করে যাত্রায় করোনার ঝুঁকি বাড়বে- সরকারের পক্ষ থেকেই বিষয়টি বলাবলি হচ্ছে। তবে শ্রমিকদের এভাবে নিয়ে আসার প্রশ্নে ‘রা’ নেই মন্ত্রীদের মুখে।
নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এসে দিনভর ভোগান্তি শেষে রাত ৯টার পর বাস চালানোর অনুমতি দেয়ার বিষয়ে কোনো কথাই বলেননি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
তিনি শনিবারের ঘটনার জন্য স্পষ্টত দায়ী করেছেন শিল্পমালিকদের। তিনি বলেন, ব্যবসায়ী নেতারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কারখানার আশপাশের শ্রমিকদের নিয়ে প্রথমে কারখানা চালু করবেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল অনেক প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের দ্রুত কাজে যোগ দেয়ার নোটিশ দেয়।
তবে পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান দাবি করেছেন, তারা কাউকে ফিরতে চাপ দেননি। তারা আশপাশে থাকা শ্রমিকদের নিয়ে কারখানা চালু করতে চেয়েছেন। বারবার বলেছেন, শাটডাউনে আসতে না পারলে চাকরিতে কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু তারপরও শ্রমিকরা ঢাকায় এসেছেন।
গত বছর মার্চে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর সাধারণ ছুটির মধ্যেও একই ঘটনা দেখা গেছে। তখনও যান চলাচলে বিধিনিষেধের মধ্যে পোশাকশ্রমিকদের একইভাবে কর্মস্থলে ফিরতে বাধ্য করা হয়েছে। সে সময়ও বিজিএমইএর বক্তব্য ছিল একই রকম।
বিজিএমইএর বক্তব্যে বিশ্বাস নেই শ্রমিকদের
বিজিএমইএর সভাপতির এই বক্তব্যে যে শ্রমিকদের আস্থা নেই, সেটি স্পষ্ট।
দিনাজপুরের পার্বতীপুরের পারভীন আক্তার পার্বতীপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ এসেছেন। ভাড়া তিন গুণ গেছে।
অনেকে ভ্যানেই ফেরেন ঢাকা
কেন এত কষ্ট করে এসেছেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আইজ কামে না ফিরলে যেই ১১ দিন ছুটি ছিল, তা অ্যাবসেন্ট দেখাইয়া বেতন কাইটা নিব, চাকরিও চলে যাইবার পারে। এর লেগে কষ্ট কইরাও ঢাকায় আসছি।’
পারভীন তাও ঢাকায় আসার বাস পেয়েছেন। তবে গত রাতে বাস চালুর আগে যারা এসেছেন, তাদের আসতে হয়েছে ট্রাকে চেপে পণ্য হয়ে। গাদাগাদি করে আসা মানুষগুলো রোদে কষ্ট করেছেন, পথে বৃষ্টিতে ভিজেছেন। শিশুদের নিয়ে আসা বাবা-মায়েরা ছিলেন আরও অসহায়। কান্নারত সন্তানকে আগলে রাখতে না পেরে ভেঙে পড়েন তারা।
শ্রমিকরা বলছেন, সময়মতো না এলে চাকরি যাবে না, এমন ঘোষণা শুনে এর আগে যারা দেরি করেছেন, তাদের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। তাদের বেতন কাটা হয়েছে, সাধারণ ছুটির সময়টাও অর্জিত ছুটি হিসেবে ধরা হয়েছে। বহুজনের চাকরিও গেছে।
যা ঘটেছে
১ জুলাই থেকে চলমান শাটডাউনের মধ্যে ঈদের ছুটির সময় ৮ দিনের জন্য শিথিল করার সময়ই ঘোষণা আসে, ঈদের পর ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বন্ধ থাকবে কলকারখানাও।
ঈদের পাশাপাশি শাটডাউনের কারণে দীর্ঘ ছুটি পাওয়া যাবে বলে শ্রমিকরা পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রামের পথ ধরেন। ঈদের ছুটি শেষে কারখানা খুলে দিতে মালিকপক্ষের আবেদন নাকচ করে গত মঙ্গলবারও জানানো হয়, ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত সবকিছু বন্ধ থাকবে।
শুক্রবার রাতে হঠাৎ করেই আদেশ আসে, রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা ১ আগস্ট থেকে চালু থাকবে। আর লাখ লাখ শ্রমিক শনিবার ট্রাকে-ভ্যানে চেপে পণ্য হয়ে ফিরেছেন।
একদল ফিরেছেন স্বল্প গতির যানবাহনে ভেঙে ভেঙে, কেউ কেউ ফিরেছেন হেঁটে।
ফেরি পারাপারে যে চিত্র দেখা গেছে, তা করোনাকালে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। হাজার হাজার শ্রমিক গাদাগাদি করে উঠেছেন ফেরিতে, আর এর ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি তীব্র সমালোচনা করছেন বহুজন।
শনিবার দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ ফেরিতেই পার হন নদী। যাত্রীদের ভিড়ে কানায় কানায় পূর্ণ ছিল ফেরিগুলো।
ক্লান্ত-শ্রান্ত শ্রমিকরা ঘর্মাক্ত হয়ে ঘরে ফেরার পর রাতে আদেশ আসে লঞ্চ চলবে রোববার দুপুর পর্যন্ত। এরও ঘণ্টাখানেক পর জানানো হয়, চলবে বাসও।
কিন্তু ততক্ষণে আর্থিক ক্ষতি সয়ে, শারীরিক কষ্ট সয়ে শ্রমিকদের সিংহভাগ চলে এসেছেন কর্মস্থলে। যারা শিশুদের নিয়ে ফিরেছেন, তাদের দুর্ভোগ ছিল অবর্ণনীয়।
এই আদেশ আসার পর যা ধারণা করা হয়েছিল, রাতে তা দেখা গেছে। বরিশাল থেকে লঞ্চ ছাড়েনি, বাসেও দেখা যায়নি ভিড়।
আবার প্রথমে নির্দেশ আসে যে বাস চলবে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। আর লঞ্চ চলবে দুপুর পর্যন্ত। তবে রোববার আবার আদেশ আসে, সারা দিনই আসতে পারবে শ্রমিকবাহী বাস।
দায় কার, সে প্রশ্ন নিজেই করছেন কাদের
ওবায়দুল কাদের নিয়মিত যে ব্রিফিংয়ে আসেন, তাতে তিনি নিজে থেকেই শ্রমিকদের এই ভোগান্তির বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। তবে শ্রমিকদের ফেরার জন্য বাস বা লঞ্চের ব্যবস্থা দেরিতে করার বিষয়ে কোনো কথাই বললেন না।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে আজ (রোববার) থেকে রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা বিধিনিষেধের আওতামুক্ত ঘোষণা করেছে সরকার। ব্যবসায়ী নেতারা প্রতিশ্রুতি দিয়ছিলেন, কারখানার আশপাশের শ্রমিকদের নিয়ে প্রথমে কারখানা চালু করবেন। ঈদের ছুটিতে গ্রামে যাওয়া শ্রমিকরা ৫ তারিখের পর যোগদান করবেন। এতে কেউ চাকরিচ্যুত হবেন না।’
ফেরি ঘাটে ভেড়ার সঙ্গে সঙ্গেই এগুলো ভর্তি হয়ে যায় যাত্রীতে।
পরমুহূর্তে তিনি বলেন, ‘এক দিনের মধ্যে শ্রমিকদের ফিরে আসার নোটিশ প্রদানের প্রেক্ষিতে ফেরিঘাটগুলোতে রীতিমতো ভীতিকর অবস্থা তৈরি হয়।’
এই ব্রিফিংয়ে কাদেরকে প্রশ্ন করার সুযোগ নেই। তিনি বিটিভিকে যে বক্তব্য দেন, সেটিই পরে পাঠানো হয় অন্য গণমাধ্যমেও। তিনি নিজেই প্রশ্ন করেন, শনিবারের দায় কার।
সড়কমন্ত্রী বলেন, ‘এভাবে শ্রমিকরা হঠাৎ করে ঢাকা ফিরে আসবে, পথে পথে দুর্ভোগের মধ্যে পড়বে- এ দোষটা কার? এ দায় কে বহন করবে? যারা ভোগান্তিতে আছে, তারা সরকারের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে। কিন্তু সরকারের সঙ্গে তো কথা এমন ছিল না।’
ভবিষ্যতে সচেতন থাকবেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী
রোববার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে এসে শনিবারের হ-য-ব-র-ল অবস্থা নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের মুখে পড়েন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন।
তিনি বলেন, ‘এটা অবশ্যই সংক্রমণ বাড়াবে, আমরা স্বীকার করি আর না করি। আমরা দেখেছি গতকাল ফেরিতে গাদাগাদি করে শ্রমিকরা ঢাকায় ফিরেছে। এটা সংক্রমণ বাড়াবে।’
এই অব্যবস্থাপনা, আগেভাগে সিদ্ধান্ত নিতে পারার দায় কার, সেই বিষয়টি তিনি আনতেই চাননি। এক বাক্যে বলেন, ‘সামনে এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে, সে বিষয়ে সচেতন থাকব আমরা।’
প্রশ্ন এড়ালেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
২৭ জুলাই জোরের সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছিলেন, ৫ আগস্টের আগে শিল্পকারখানা খুলছে না। তার তিন দিন পরেই রাতে জারি হয় রোববার থেকে রপ্তানিমুখী কারখানা খোলার আদেশ। আর তার আগের দিন হয় হুলস্থুল।
শাটডাউনের মধ্যে হঠাৎ করে কারখানা খুলে দেয়ার আদেশ, শ্রমিকদের এভাবে ঢাকায় ফেরার বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রীর এখনকার বক্তব্য কী- সেটি অবশ্য জানা যায়নি।
অনেকে ফেরার কোনো বাহন না পেয়ে হেঁটেই পাড়ি দেন দীর্ঘ পথ
এ-সংক্রান্ত এক প্রশ্নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জবাব না দিয়ে বলেন, ‘দেখেন, লকডাউনের সিদ্ধান্ত যেখান থেকে নেয়, সেটা আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নয়। লকডাউন যেখান থেকে শিথিল করে বা চালু করে, তারাই এটার উত্তর দিতে পারবে।’
বিজিএমইএর সভাপতি দায় দিলেন শ্রমিকদেরই
শ্রমিকদের পরিবহনের ব্যবস্থা না করে তাদের আসতে বলা, ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য নিয়ে নিউজবাংলা কথা বলেছে বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসানের সঙ্গে। তিনি মোটাদাগে যা বলেছেন, সেটা হলো শ্রমিকদের দূর থেকে এভাবে আসার দরকার ছিল না।
তিনি বলেন, ‘ঢাকায় এখনো অনেক শ্রমিক আছেন। গত পাঁচ দিন ধরে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ শ্রমিক ঢাকায় কারখানার সামনে এসে বলছে আমাদের ফ্যাক্টরি খুলে দেন।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেক ফ্যাক্টরি এখন ঢাকার বাইরে চলে গেছে। সেখানে অনেক স্থানীয় শ্রমিক রয়েছে। অনেক শ্রমিক দেশেই যায়নি। তাদের নিয়েই আমরা কারখানা চালু করতে চেয়েছি। যারা দেশে গেছে তাদের আমরা শুরু থেকেই বলছি, যারা ঢাকায় আসতে পারেননি তাদের চাকরিতে কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু তারপরও শ্রমিকরা ঢাকায় আসছে।’
হঠাৎ কারখানা খুলে দেয়া, তারপর দেরিতে যানবাহন খুলে দেয়া, শ্রমিকদের ভোগান্তি—তাহলে দায় কার? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘শ্রমিকদের অসচেতনতার কথা আমি বলব না। এটা আমাদের সবার অসচেতনতা। এবারের ঈদেও তো সবাইকে বাড়ি যেতে মানা করা হয়েছিল। কিন্তু তারপরও ১ কোটি ৩০ লাখ লোক বাড়ি গেছে।’
মোবাইল সিমের তথ্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বিটিআরসির পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘গতকালও ২ লাখ ৩১ হাজার, তার আগের দিন ২ লাখ ২৫ হাজার লোক ঢাকার বাইরে গেছে। এরা কি গ্রামে আমাদের কারখানায় চাকরি করতে গেছে? অবশ্যই না।’
ফারুক হাসান বলেন, ‘আমি আবারও বলছি, শুধু ৫ তারিখ না, লকডাউন যদি ১০ তারিখ পর্যন্ত বাড়ে, যদি কেউ ১১ তারিখ আসে, তার চাকরি যাবে না। যদি তার চাকরি যায়, সে বিজিএমইএতে জানালে তার চাকরির ব্যবস্থা আমরা করব।’