চট্টগ্রামে রিমান্ডে থাকা সেই কুলসুম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
পুলিশ বলছে, নিজের পরিবর্তে নিরপরাধ মিনুকে হত্যা মামলার আসামি সাজিয়ে জেলে ঢোকানোর বিষয়ে তিনি জবানবন্দি দিয়েছেন।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শফি উদ্দিন আহমেদের আদালতে রোববার বিকেলে এই জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়।
নিউজবাংলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কোর্ট উপপরিদর্শক আবছার উদ্দিন রুবেল।
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন বলেন, গ্রেপ্তার কুলসুম আক্তার আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। এ সময় তিনি জানান, হত্যা মামলায় ১ বছর ৪ মাস হাজতবাস শেষে জামিনে বের হন। দীর্ঘ ১০ বছর আদালতে হাজিরা দেন। ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর ওই মামলায় তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। সাজা থেকে বাঁচার জন্য মর্জিনা বেগম নামের এক নারীর কাছে সাহায্য চান।
মর্জিনা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে শাহাদাত নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে। নুর আলম কাওয়াল নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করেন শাহাদাত।
পরে শাহাদাত ও নুর আলম দেড় লাখ টাকা চুক্তিতে আসামি কুলসুমের বদলে অন্য নারীকে জেলে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এতে কুলসুমও রাজি হয়ে যান।
এরপর মর্জিনা তার পূর্বপরিচিত মিনু আক্তারকে টাকার লোভ দেখিয়ে এক মাসের মধ্যে জামিন করানোর আশ্বাস দিয়ে জেলে যেতে রাজি করান। ২০১৮ সালের ৬ জুন মিনুকে কুলসুম সাজিয়ে আদালতে তোলা হয়।
আদালতে নাম ধরে ডাকার সঙ্গে সঙ্গে মিনু ভেতরে যান। পরে তাকে বিচারক কারাগারে পাঠান।
এরপর চুক্তির দেড় লাখ টাকার জন্য শাহাদাত ও নুর চাপ দিলে টাকা জোগাড় হয়নি বলে জানান কুলসুম। একপর্যায়ে এটা নিয়ে সালিশ বৈঠকও হয়। টাকা না দিয়ে আত্মগোপন করেন কুলসুম ও মর্জিনা। পরে সীতাকুণ্ডের ছিন্নমূল এলাকায় কুলসুম ও মর্জিনার দুটি ব্যক্তিগত প্লট দখল করে নেন শাহাদাত ও নুর।
এর আগে ১৬ জুন মিনুর মুক্তির পর মূল আসামি কুলসুমের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর চতুর্থ দায়রা জজ আদালত। ২০ জুন পরোয়ানাটি কোতোয়ালি থানায় পৌঁছায়। এর ৮ দিন পর নগরীর পতেঙ্গা এলাকার মাইলের মাথা থেকে কুলসুমকে গ্রেপ্তার করে। আর তার সহযোগী মর্জিনাকে আটক দেখানো হয়।
পরে কুলসুম আক্তার, মর্জিনা আক্তার ও অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজনের বিরুদ্ধে প্রতারণা মামলা করেন থানার উপপরিদর্শক আকাশ মাহমুদ ফরিদ। এজাহারে প্রতারণার মাধ্যমে মিনুকে কারাগারে পাঠানোর অভিযোগ আনা হয়।
এই মামলায় কুলসুম ও মর্জিনাকে দুই দিনের রিমান্ডে পাঠায় আদালত। রিমান্ডে তাদের দেয়া তথ্যমতে শনিবার রাতে সীতাকুণ্ড থানার জঙ্গল সলিমপুর কালাপানিয়া দরবেশনগর এলাকা থেকে শাহাদাত ও নুরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সবশেষ রোববার বিকেলে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন কুলসুম।
মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, ২০০৬ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার রহমতগঞ্জ এলাকায় কোহিনুর আক্তার ওরফে বেবী নামে এক নারী খুন হন। এ ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়।
ওই মামলায় কুলসুম আক্তার গ্রেপ্তার হন।
২০০৮ সালে এই মামলায় অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা। ২০০৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কুলসুম জামিন পান। এ মামলায় ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত কুলসুমকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।
রায়ের দিন কুলসুম অনুপস্থিত থাকায় আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। এরপর ২০১৮ সালের ১২ জুন মিনু নামের এক নারীকে সাজাপ্রাপ্ত আসামি কুলসুম আক্তার সাজিয়ে আত্মসমর্পণ করানো হয়। তখন আদালত মিনুকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠায়।
২০১৯ সালের ২৩ এপ্রিল কুলসুম হাইকোর্টে আপিল করেন। সেই সঙ্গে জামিনের আবেদনও করেন।
চলতি বছরের ২১ মার্চ চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে একটি আবেদন করেন। ওই আবেদনে তিনি বলেন, ২০১৮ সালের ১২ জুন কারাগারে পাঠানো আসামি প্রকৃত সাজাপ্রাপ্ত আসামি কুলসুম আক্তার নন।
এ আবেদনের শুনানি শেষে আদালত কারাগারে থাকা মিনুকে আদালতে হাজির করে তার জবানবন্দি নেয়। তখন তিনি জানান, তার নাম মিনু, তিনি কুলসুম নন।
মিনু বলেন, মর্জিনা নামের এক নারী তাকে চাল, ডাল দেবে বলে জেলে ঢোকান। প্রকৃত আসামি কুলসুম আক্তারকে তিনি চেনেন না।
আদালত কারাগারের রেজিস্টারগুলো দেখে হাজতি আসামি কুলসুম ও সাজাভোগকারী আসামির চেহারায় অমিল খুঁজে পায়। তখন আদালত কারাগারের রেজিস্টারসহ একটি উপনথি হাইকোর্ট বিভাগে আপিল নথির সঙ্গে সংযুক্তির জন্য পাঠিয়ে দেয়।
পরে হাইকোর্ট গত ৭ জুন নিরপরাধ মিনুকে মুক্তির নির্দেশ দেয়।
কারামুক্তির ১২ দিন পর চট্টগ্রামের বায়েজিদে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান মিনু। অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে মরদেহ দাফন করে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম।
বায়েজিদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কামরুজ্জামান সে সময় বলেন, ‘২৮ জুন গাড়ির ধাক্কায় এক নারী নিহত হন। ওই দিন রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি করার সময় তাকে কয়েকবার সড়ক থেকে সরিয়ে দিয়েছিল আমাদের মোবাইল টিম। মৃত্যুর পর চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তার ময়নাতদন্ত হয়। পরিচয় না পেয়ে অজ্ঞাতনামা হিসেবে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামকে দিয়ে দিই আমরা। তারা মরদেহটি দাফন করে।’
ওসি আরও বলেন, ‘পরে আমাদের একটি টিম সীতাকুণ্ড এলাকায় কয়েকজনকে ওই নারীর ছবি দেখালে তারা মিনুর ভাইয়ের কথা বলেন। পরে মিনুর ভাই ছবিটি দেখে তার বোন মিনু বলে শনাক্ত করেন।’