‘বইষ্যা নামলে মোর ঘরের চালের যে কয় জায়গা দিয়া পানি পরে, হেই পানি ধরার লইগ্যা মোর ঘরে হেতডি হাঁড়ি-পাতিলও নাই।’
আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বলছিলেন কিস্তাকাঠি আবাসনের ২২/৮ নম্বর ঘরের নাসিমা বেগম।
২১/৫ চা-বিক্রেতা নূপুর বেগম। তিনি শহর থেকে শাড়ি কিনে আবাসনে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে সংসার চালান। তার ঘরটির চাল এমনভাবে ঝাঁজরা হয়ে গেছে যে এখন ভিতর থেকে আকাশ দেখা যায়। নূপুর গত বর্ষায় অন্যত্র গিয়ে থেকেছেন। চালের টিনের যে অবস্থা তার চেয়ে তার ঘরের বেড়ার অবস্থা আরও খারাপ। যখন-তখন তার ঘরের ভিতর সাপ ঢোকে বলেও জানান তিনি।
এমন বাস্তবতায় দিনাতিপাত করছেন ঝালকাঠির উত্তর কিস্তাকাঠি আবাসন প্রকল্পের বাসিন্দারা। নির্মাণের পর এক যুগের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও সংস্কার না করায় অধিকাংশ ঘরই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এসব ঘরের টিনের চালাগুলো মরিচা ধড়ে ঝাঁজরা হয়ে গেছে। চালার ছিদ্র দিয়ে দেখা যাচ্ছে আকাশ।
এ ছাড়া বেশির ভাগ শৌচাগার ও গোসলখানা এখন ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। রাস্তাঘাট পাকা না থাকায় সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন এখানকার বসবাসকারীরা।
২০০৭ সালে ঝালকাঠি পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডে ৬৫ একর খাসজমিতে স্থাপন করা হয় উত্তর কিস্তাকাঠির এই আবাসন প্রকল্পটি। তিনটি ব্যারাকে নির্মাণ করা হয় ৪৫০টি ঘর। যা বরাদ্দ দেয়া হয় ৪৫০টি ভূমিহীন নিম্ন আয়ের পারিবারকে। সংস্কার না হওয়ায় প্রকল্পের ৪৫০টি পরিবার মানবেতর জীবন যাপন করছে। টিনের চালা এবং বেড়ায় হওয়া ছিদ্র পলিথিন দিয়ে ঢেকে পানি থেকে বাঁচার চেষ্টা করছেন তারা।
প্রতি ১০টি পরিবারের জন্য ২টি শৌচাগার ও ২টি করে গোসলখানা রয়েছে এখানে। শৌচাগারগুলো এখন ব্যবহারের অযোগ্য। পয়োনিষ্কাশনের জন্য ব্যারাকে কোনো ড্রেন না থাকায় ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত পানি যাচ্ছে এখানকার একমাত্র পুকুরটিতে। আর দূষিত পুকুরের পানি ব্যবহার করে বাসিন্দারা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
দুই-একজন সচ্ছল বাসিন্দা ঘর মেরামত করে বসবাস করলেও নিম্ন আয়ের অসহায় বাসিন্দারা সংস্কার না করেই দিনের পর দিন কষ্ট করে কাটাচ্ছেন।
ঝালমুড়ি বিক্রেতা ৬৮ বছর বয়সী খলিল সিকদার আবাসনের ২ নম্বর ব্যারাকের ১০ নম্বর ঘরে থাকেন। তিনি বলেন, ‘বৃষ্টির দিনে মাঠের চেয়ে আমার ঘরে পানি বেশি ওঠে। পলিথিন টাঙিয়েও বৃষ্টি ঠেকানো যায় না।’
১২ বছরে একবার প্রত্যেকটি ঘরে দুটি করে নতুন টিন দিয়ে মেরামত করা হয়েছিল। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগন্ন।
৩ নম্বর ব্যারাকের ২০/৫ নম্বর ঘরের বাসিন্দা শহিদ হাওলাদার বলেন, ‘পেত্তেক ঘরে ৩ বান হইরা টিনের প্রয়োজন। অথচ ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে মাসে ঘরপ্রতি দু’হান হইরা টিন লাগাইয়া দেছেলে সদর উপজেলা টিএনও (ইউএনও)।’
বাসিন্দাদের দুর্দশা নিয়ে উত্তর কিস্তাকাঠি আবাসন প্রকল্প সমবায় সমিতি-১-এর সাধারণ সম্পাদক মন্টু খলিফা বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সময় আবাসনের এসব সমস্যার কথা কর্তৃপক্ষকে জানালেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অনেক সময় বিভিন্ন কর্মকর্তা এখানে পরিদর্শনে এসে সংস্কারের কথা বলে চলে যান।’
জরাজীর্ণ ঘর তো আছেই, এ ছাড়া এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে নেই ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র। গোরস্থানও নেই। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় তাদের শহরে গিয়ে উঠতে হয়। আর এখানে বসবাসরত সাড়ে ৪০০ পরিবারের কোনো সদস্য মারা গেলে দাফনের জন্য যেতে হয় ছয় কিলোমিটার দূরে পৌর গোরস্থানে।
এরই মধ্যে অনেক বাসিন্দাই আশ্রয়ণ কেন্দ্র ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। বাধ্য হয়ে যারা বসবাস করছেন তাদের ভোগান্তির শেষ নেই। তাদের দাবি দ্রুত প্রতিটি ঘরের চালের টিন পরিবর্তন করে নতুন করে চালা তৈরি করে দেয়াসহ শৌচাগার ও গোসলখানাগুলো সংস্কার করা।
এ প্রসঙ্গে সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক বলেন, ‘কিস্তাকাঠি আবাসন প্রকল্প অনেক পুরোনো। তাই প্রতিটি ঘরের চাল পরিবর্তন করে নতুন টিন না দিলে সমস্যার সমাধান হবে না। ইতোমধ্যে সংস্কারের জন্য চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।’
জেলা প্রশাসক জোহর আলী নিউজবাংলাকে বলেন, প্রকল্পের বাসিন্দাদের দুর্ভোগ নিরসনের জন্য যথাসাধ্য কাজ করা হবে। বিষটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখার জন্য সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকতাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
ডিসি আরও বলেন, শুধু কিস্তাকাঠিই নয়, ঝালকাঠি জেলার বিভিন্ন উপজেলাতেও যেসব আশ্রয়ণ কেন্দ্রের ঘরগুলো বসবাসের অনুপযোগী সবগুলো ঘরই মেরামতের জন্য বরাদ্দ চেয়ে ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।