নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাশেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জনের মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত শুরু করেছে নাগরিক তদন্ত দল।
শনিবার দুপুরে তারা হাশেম ফুডসের পুড়ে যাওয়া সেজান জুস কারখানাটি পরিদর্শন করেন। নাগরিক তদন্ত দলের আহ্বায়ক সুপ্রিম কোর্টের ব্যারিস্টার জোর্তিময় বড়ুয়া ও সদস্য সচিব মাহবুবুর রহমান ইসমাঈল নেতৃত্বে তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান।
কমিটির সদস্যরা ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলেন।
ভবন পরির্দশন শেষে তদন্ত কমিটির সদস্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের কারখানা ও কর্মস্থলে অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনা নতুন কিছু নয়। যেসব কারণে মানুষ অকালে মারা যাচ্ছে সেসব দূর করা সম্ভব।
তিনি বলেন, ‘কারখানায়, রাসায়নিক গুদামে আগুন লেগে মানুষ মারা যাচ্ছে, এই অকাল মৃত্যুতে সরকার থেকে তদন্ত কমিটি হয়। কিন্তু প্রতিবেদন প্রকাশ হয় না, দায়ী ব্যক্তিরাও শনাক্ত হয় না, তাই প্রতিকারও হয় না। যার ফলে একই ঘটনা বার বার ঘটতে থাকে।’
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘এতো বছর পরও রানা প্লাজা, তাজরীনের ঘটনায় বিচার হয়নি। ফলে কারখানায় যে ধরনের বিধিমালা থাকার কথা তা থাকে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘তদন্ত দল অনুসন্ধান করবে, এই ঘটনায় মালিকপক্ষের দায় কতটা, সরকারি প্রতিষ্ঠানে দায় কতটা এবং আগুন লাগার আগে কারখানার কর্মপরিবেশ কেমন ছিল।
ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কথা বলেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা‘সেখানে শিশু শ্রমিক ছিল কিনা, যদি শিশু শ্রমিক থেকে থাকে, তাহলে কোন আইনে তারা সেখানে কাজ করেছে। শ্রমিক যারা কাজ করতো তাদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার ছিল কিনা, তাদের মজুরি ঠিকমতো দেয়া হতো কিনা, তাদের কর্মঘন্টা কত ছিল, তাদের ওভারটাইম পরিশোধ করা হয়েছিল কিনা।’
নাগরিক তদন্ত কমিটির সদস্য আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘কারখানাটি দেখাশোনার জন্য শ্রম পরিদর্শকের দায়িত্বে যিনি ছিলেন, তিনি তার দায়িত্ব ঠিক মতো পালন করেছিলেন কিনা। ভবনের নকশা এবং ভবনটি কারখানা করার উপযোগী কী না- এসব বিষয়ে তদন্ত দল কাজ করবে এবং সুপারিশসহ প্রতিবেদন প্রকাশ করবে।’তিনি বলেন, ‘আমাদের সুপারিশমালা শুধু এই কারখানার জন্য নয়, দেশের সব শিল্পখাতের জন্য।’
কমিটির আহ্বায়ক ব্যারিস্টার জোর্তিময় বড়ুয়া বলেন, ‘ভবনের চারতলায় এসি রুমে বেশি লোকের প্রাণহানি হয়েছে। শুনেছি সেখানে উৎপাদন ব্যবস্থাপক মাহবুবু হোসেনও মারা গেছেন। আমরা সরকারের অন্যান্য দপ্তরের বক্তব্য এবং তাদের কাছ থেকে ডকুমেন্ট নেয়ার চেষ্টা করবো।’
তদন্ত শেষে প্রতিবেদন জনগণের সামনে উপস্থাপন করা হবে বলে তিনি জানান।
নাগরিক তদন্ত কমিটিতে শিক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসক, শ্রমিক আন্দোলন, সাংবাদিক, প্রকৌশলী, স্থপতি, রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মীসহ বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধি রয়েছেন।
তদন্ত কমিটি ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে ঘটনার কারণ অনুসন্ধান, সুপারিশসহ প্রতিবেদন প্রকাশ করবে।কারখানাটি পরিদর্শনের সময় ১৯ সদস্যের নাগরিক কমিটির সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রকৌশলী মোশাররফ হোসেন, অধ্যাপক তানজীম উদ্দিন খান, গবেষক ও সাংবাদিক প্রিসিলা রাজ ও মাহা মির্জা, শিল্পী ও সংগঠক বীথি ঘোষ, বাংলাদেশ শ্রম ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি গোলাম মুর্শেদ, বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার লিমা, গার্মেন্টস শ্রমিক মুক্তি আন্দোলনের সভাপতি শবনম হাফিজ, গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম সবুজ ও গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী রেজাউর রহমান লেনিন।
পুলিশের করা মামলার তদন্ত শুরু করেছে সিআইডিএদিকে শনিবার পুলিশের করা মামলার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
অতিরিক্ত ডিআইজি ইমাম হোসেন বলেন, ‘আমরা আজ কারখানাটিতে প্রাথমিক তদন্ত করেছি ও বিভিন্ন আলামত পেয়েছি। ঘটনার সময়কার সাক্ষীদের সাক্ষ্য পেয়েছি। আজ থেকে মূল তদন্ত শুরু। পুলিশের করা মামলার ১০টি বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে।’
গত ৮ জুলাই রাতে হাশেম ফুড লিমিটেডের কারখানায় আগুন লাগে। শুরুতে তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও পরের দিন উদ্ধার করা হয় ৪৯ জনের মরদেহ। মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২ জনে।
বেশির ভাগের মরদেহই পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়ায় পরিচয় শনাক্তের জন্য স্বজনদের নমুনা সংগ্রহ করে ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। ৮ তারিখ আগুন লাগলেও ৯ তারিখ রাতের আগে পুরোপুরি আগুন নেভানো যায়নি।
আগুন নেভাতে দীর্ঘ সময় লাগার কারণ মনে করা হচ্ছে কারখানার প্রতি ফ্লোরে মজুত করা দাহ্য পদার্থ। ছিল বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক, যা আগুন আরও ছড়িয়ে যেতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।
মালিকপক্ষ থেকে দাবি করা হয়, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকেই এই আগুনের সূচনা। তবে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনার পেছনে কারখানা কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলা ও অব্যবস্থাপনা দায়ী বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছে বিভিন্ন দায়িত্বশীল সংস্থা।
এ ঘটনায় পুলিশ কারখানার মালিক আবুল হাসেম, তার চার ছেলেসহ আটজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করে। তাদের চার দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
গত বুধবার তাদের আদালতে হাজির করা হলে কারখানার মালিক আবুল হাসেমসহ ছয়জনকে কারাগারে পাঠানো হয়। হাসেমের দুই ছেলেকে জামিন দিয়েছে আদালত।