অন্য সব মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনের মতো প্রতিদিন আজান দিতেন। নামাজ শেষে সবার পরে মসজিদ থেকে বের হয়ে চলে যেতেন থাকার ঘরে। সেটিও ছিল কিছুটা নির্জনে, গ্রামের প্রান্তে। গ্রামের মানুষের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বললেও বেশির ভাগ সময়ই থাকতেন চুপচাপ।
অভিযান চালিয়ে সেই তাদেরই বোমা তৈরির বিপুল সরঞ্জামসহ গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট।
পুলিশ জানিয়েছে, গত ১৭ মে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় পুলিশ বক্সে বোমা পাওয়া যায়। পরে বোমাটি নিষ্ক্রিয় করা হয়। ওই বোমার তদন্ত করতে গিয়ে গত রোববার বিকেলে ও রাতে দুজনকে গ্রেপ্তার করে সিটিটিসির স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ।
এরা হলেন আব্দুল্লাহ আল মামুন ওরফে ডেভিড কিলার এবং কাউসার হোসেন ওরফে মেজর ওসামা। তাদের তথ্যের ভিত্তিতেই নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার ও বন্দর থানা এলাকায় পাওয়া যায় দুটি জঙ্গি আস্তানা।
রোববার রাতেই আস্তানা দুটিতে আলাদা অভিযান চালায় সিটিটিসি। সেখান থেকে তিনটি শক্তিশালী আইইডি এবং বিপুল পরিমাণ বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।
সিটিটিসির হাতে গ্রেপ্তার কাউসার হোসেন ওরফে মেজর ওসামা বন্দর উপজেলার কেওঢালার কাজীপাড়া এলাকার একটি মসজিদের ইমাম। অপরজন আব্দুল্লাহ আল মামুন ওরফে ডেভিড কিলার আড়াইহাজারের নোয়াগাঁ গ্রামের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের (মিয়াবাড়ী) মুয়াজ্জিন।
যা বলছেন গ্রামবাসী
নোয়াগাঁ গ্রামের মিয়া বাড়ির বাসিন্দা ফাইজুল বারী খান নিউজবাংলাকে জানান, আব্দুল্লাহ আল মামুন মসজিদের মুয়াজ্জিন। তিনি মসজিদের থাকার ঘরে একাই থাকতেন। তার কাজ ছিল নামাজের প্রতি ওয়াক্তে আজান দেয়া, মসজিদের অজুখানার পানি ছাড়া এবং ভোরে শিশুদের আরবি পড়ানো। এর পাশাপাশি নোয়াগাঁ হাফিজিয়া মাদ্রাসার বাজারও করতেন তিনি।
বারী খান আরও বলেন, ‘মুয়াজ্জিনকে সবাই আব্দুল্লাহ আল মামুন নামে চিনতেন। দেড় বছর ধরে মুয়াজ্জিন তিনি। তাকে পাশের গ্রামের আরেক মসজিদের এক মুয়াজ্জিন এনে দেন। শুরু থেকেই তার চলাফেরা গ্রামের অন্য সব মানুষের মতোই স্বাভাবিক। তাকে দেখে কখনও বোঝার উপায় ছিল না সে জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। তবে প্রায়ই মসজিদ থেকে বাইরে যেতেন আবার ফিরে আসতেন।’
নোয়াগাঁ হাফিজিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক হারুনুর রশীদ বলেন, ‘আব্দুল্লাহ আল মামুন সবার সঙ্গে স্বাভাভিকভাবে চলাফেরা করতেন। তবে তিনি কথা বলতেন অনেক কম। গত দেড় মাস ধরে তার বাসায় বাইরের লোকজন আসতো। কারা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলতেন, যারা আসছেন তারা তার বন্ধু। যারা আসতেন তারাও পাঞ্জাবি পড়তেন, কারও কারও দাড়ি টুপি রয়েছে।’
আব্দুল্লাহ আল মামুনের মতো আবু নাঈমের আচরণও ধরতে পারেনি বন্দরের কাজীপাড়া গ্রামের মানুষ। তিনি স্থানীয় একটি মসজিদে নামাজ পড়াতেন।
গ্রামের বাসিন্দা সামসুল আলম বলেন, ‘কাজীপাড়া গ্রামের কয়েকটি মসজিদ। এর মধ্যে তিন সিটের একটি মসজিদের ইমাম আবু নাঈম। তিনি ১৭ দিন ধরে এ মসজিদে ইমামতি করছেন। তাকে এখানে এনে দিয়েছেন আগের ইমাম।’
গ্রামের বাসিন্দা সামসুল আলম আরও বলেন, ‘এর আগের যে ইমাম আছিল হের চলাফেরাও বালা আছিল না। হেরে আমি একদিন কইছি তর আচরণ তো ভালা না। হের কয়দিন পর শুনি ওই ইমাম চাকরি ছাইরা গেছে গা। যাওয়ার আগে হেয় আবু নাঈমরে আইন্না দিয়া গেছে। হেয় আসার সময় তার স্ত্রী ও সন্তান সঙ্গে নিয়া আইছে। হেয় গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলত কম।’
কাজীপাড়া গ্রামের আরেক বাসিন্দা আলমগীর হোসেন বলেন, ‘মসজিদে কোনো থাকার জায়গা না থাকায় ইমামকে কয়েক শ গজ দূরে গ্রামের একটি নির্জন জায়গায় পাচু মিয়া নামের এক ব্যক্তির জায়গায় ঘর তুলে থাকতে দেয়া হইছে। তার ঘরটা আমার ঘর থেকে একটু দূরে। ইমাম সাহেবের সাড়া শব্দ আসত না। তিনি নামাজ পড়াতেন, নামাজ শেষ হলে আবার ঘরে ফিরে যাইতেন। গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলতেন কম।’
আবু নাঈমের ওই ঘর থেকেই বোমা তৈরির বিপুল সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট (সিটিটিসি)। পাওয়া গেছে বোমার রিমোর্ট কন্ট্রোলার। তার ঘরের মতো আড়াইহাজারে নোয়াগাঁও গ্রামের অভিযানেও বোমার সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। সেখানে পাওয়া তিনটি বোমা নিষ্ক্রিয় করেছ বম্ব ডিসপোজাল ইউনিট।
সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান জানান, আবু নাঈম সাংগঠনিকভাবে মেজর ওসামা নামে পরিচিত। তিনি জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবির সদস্য ও বোমা তৈরিতে সিদ্ধহস্ত। সংগঠনে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দিতেন নাঈম।
আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের একটি টিম অভিযানের তিন দিন আগে বারেক নামে একজনসহ তিন জঙ্গিকে মিরপুর থেকে গ্রেপ্তার করে। তার তথ্য অনুযায়ী, রোবববার সন্ধ্যার দিকে ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে নাঈমকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বন্দরের কাজীপাড়ার ওই বাড়িতে রোববার রাত ২টা ৫০ মিনিটে অভিযান চালানো হয়।’
এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, নাঈম বাড়িটিতে পরিবারসহ থাকতেন। সম্প্রতি পরিবারের সদস্যদের গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে বাড়িতে বোমা তৈরির সরঞ্জাম সংগ্রহ করে একাই বোমা তৈরি করছিলেন তিনি।
রোববারের ঘটনায় বন্দর ও আড়াইহাজার থানায় দুটি মামলা করেছে সিটিটিসি। থানায় মামলা হলেও তদন্ত করবেন তারা।
মামলায় বলা হয়েছে, নব্য জেএমবি সামরিক শাখার এই দুই সদস্য নাশকতা সৃষ্টির জন্য বিস্ফোরক পদার্থ, আইইডি ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম নিজেদের হেফাজতে রেখে জঙ্গি কার্যক্রম চালাত। তারা পুলিশের ওপর হামলা করতে বোমা বানিয়ে সেটি সংরক্ষণ করত। এ কারণে তাদের আস্তানা থেকে বোমা তৈরির বিপুল পরিমাণ সরঞ্জাম পাওয়া গেছে।
নারায়ণগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার আবির আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, গ্রেপ্তার ওই দুই জঙ্গি সদস্যকে শনাক্ত করেছে সিটিটিসি। তাদের জঙ্গি কার্যক্রমের সার্বিক বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।
আবির আহমেদ আরও বলেন, ‘তারা যে মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন সেই মসজিদগুলো গ্রামের অনেক ভেতরে। তারা নির্জন পরিবেশে গিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করত, যাতে কেউ তাদের সম্পর্কে বুঝতে না পারে।’