বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জে ছোট-বড় ও নতুন-পুরোনো বিভিন্ন ধরনের শিল্পকারখানা রয়েছে ৩ হাজার ৪৫০টি। এর মধ্যে ৯৯৬টি কারখানাই গড়ে উঠেছে রূপগঞ্জে, যেখানে বৃহস্পতিবার হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের কারখানায় আগুন লেগে ৫২ জনের মৃত্যু হয়।
উপজেলার বরপা, তারাব, ভুলতা, গোলাকান্দাইলসহ আশপাশে রয়েছে এসব কারখানা। এগুলোর ৩০টি বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
ঝুঁকিপূর্ণ কারখানার তালিকায় রয়েছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ড ও বড় প্রতিষ্ঠানও। শ্রমিকের নিরাপদ কর্মপরিবেশের জন্য যে ধরনের নিরাপত্তা মানদণ্ড অনুসরণ হওয়ার কথা, এসব কারখানার অনেকগুলোতেই রয়েছে তার বড় ধরনের ঘাটতি।
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এটি জানিয়েছে।
অধিদপ্তর বলছে, কারখানার মালিক বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সংস্কারমূলক ব্যবস্থা বা উন্নয়নমূলক ত্বরিত পদক্ষেপ না নিলে যেকোনো মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে সেজান জুস কারখানার মতো ভয়াবহ দুর্ঘটনা।
রূপগঞ্জের অনেক কারখানার বিরুদ্ধে আছে কম টাকায় ও অস্থায়ীভাবে শিশুশ্রমিক নিয়োগের অভিযোগ। অভিযোগ আছে, এসব শিশুশ্রমিক দিয়ে বিরতিহীন ৮-১০ ঘণ্টার ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করানোরও।
হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের সেজান জুস কারখানাই শুধু নয়, এলাকার অন্তত আরও ২০ কারখানায় শিশুশ্রমের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
৮ জুলাই বৃহস্পতিবার রাতে সেজান জুস কারখানায় আগুন লাগার পর ১০ জুলাই শনিবার এলাকার বিভিন্ন কারখানা ঘুরে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারী, স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে শিশুশ্রম-সম্পর্কিত এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
স্থানীয় সূত্রগুলোর মতে, রূপগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জের বিসিক ও সিদ্ধিরগঞ্জে প্রায় অর্ধশত পোশাক কারখানায় শিশুশ্রমিকরা কাজ করছে।
এসব কারখানার বেশির ভাগই বাইরে থেকে মেইন গেট ও কলাপসিবল গেটের পাশাপাশি ভেতরের প্রতিটি ফ্লোরের সিঁড়ি নেট দেয়া গেট, রেলিং গেট, লোহার গেট পরিবেষ্টিত।
ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক (রূপগঞ্জ) তানহারুল ইসলাম নিউজবাংলাকে জানান, অন্তত ৩০টি কারখানা ঝুঁকিপূর্ণ। শুকনা খাবার তৈরির কারখানার পাশাপাশি স্টিল মিল ও পোশাক এবং টেক্সটাইল মিলও রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ কারখানার তালিকায়।
তানহারুল ইসলাম জানান, এলাকার অনেক কারখানাতেই নেই পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা। সেই সঙ্গে নেই ইমারজেন্সি এক্সিট ডোরও। কোথাও একটি আবার কোথাও একাধিক সিঁড়ি রয়েছে। কিন্তু কারখানায় দুর্ঘটনা ঘটলে শ্রমিকদের বাইরে বের হওয়ার একাধিক ব্যবস্থা নেই। যেগুলোতে আছে, সেগুলো প্রায়ই থাকে তালাবদ্ধ, যা শ্রমিকরা ব্যবহার করতে পারে না।
ঝুঁকি এড়াতে ফায়ার সার্ভিস কী পদক্ষেপ নিয়েছে, জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘যেসব কারখানায় অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা কম ও ইমারজেন্সি এক্সিট ডোর নেই, আমরা তাদের নোটিশ করে থাকি। কেউ নোটিশ না মানলে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানানো হয়।’
শিশুশ্রম ইস্যুতে জানতে চাইলে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জের উপমহাপরিদর্শক সুনেম বড়ুয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কোনো কারখানায় ১৪ বছরের নিচে কোনো শ্রমিক আমরা পাইনি। আমাদের পরিদর্শনে সেটি চোখে পড়েনি। তা ছাড়া পরিদর্শকদের নির্দেশই দেয়া আছে, কোনো কারখানায় শিশু শ্রমিক থাকলে ব্যবস্থা নিতে।’
অনেক কারখানায় কিশোর শ্রমিক থাকে, যাদের বয়স ১৪ থেকে ১৮ বছর। এ ধরনের কিশোর শ্রমিকের কাজ আইনেও অনুমোদনযোগ্য বলে জানান তিনি।
তবে এলাকার অনেক কারখানার শ্রমিক এবং স্থানীয়রা দাবি করছেন, কারাখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের এ দাবি সঠিক নয়। সেজান জুস কারখানাও তো পরিদর্শন করা হয়েছে। সেখানে কি শিশুশ্রমিক তাদের চোখে পড়েনি?
অগ্নিকাণ্ডের পর সেজান জুস কারখানায় কর্মরত অনেক শ্রমিক আহত হয়ে রূপগঞ্জের ইউএস-বাংলা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চিকিৎসাধীন আহত ওই শ্রমিকদের অনেকেই শিশুশ্রমিক, যাদের দিয়ে ভয়ংকর সব দাহ্য পদার্থের বিপুল মজুতের পাশে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করানো হতো।
রূপগঞ্জের ইউএস-বাংলা হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার অমিত পাল নিউজবাংলাকে জানান, এই হাসপাতালে ২২ জনকে ভর্তি করা হয়, যার ১৬ জনই ১৬ বছরের নিচে। তাদের মধ্যে ৬ জন এখনো চিকিৎসাধীন, যাদের বয়স ১৩ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে।
বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এবং ২০১৩-এর সংশোধনীতে শিশুশ্রমের অনুমোদনযোগ্য কাজের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। সেখানে ৫ থেকে ১১ বছর বয়সীদের শিশুশ্রমিক হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। যাদের দিয়ে ঝুঁকিহীন কাজ করালে সেটি শিশুশ্রম আইনে অবৈধ বলা হয়েছে।
তবে আইনে ১২-১৭ বছর বয়সীদের কাজকে শিশুশ্রম হিসেবে অনুমোদন করা হলেও সেখানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, এ ধরনের বয়সের শিশু দিয়ে সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টা পর্যন্ত হালকা পরিশ্রম বা ঝুঁকিহীন কাজ করানো যাবে।
তবে কোনোভাবেই এই কাজ সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টার বেশি হতে পারবে না। যদি কেউ করিয়ে থাকে সেটা ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম হিসেবে বিবেচিত হবে।
বাস্তবতা হলো, আইনে অনুমোদনযোগ্য এই বয়সসীমার সুযোগ নিচ্ছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। যাদের দিয়ে ষোল আনা ঝুঁকিপূর্ণ কাজও করিয়ে নেয়া হচ্ছে। বেতনও দেয়া হচ্ছে কম। আবার চাকরির স্থায়ীকরণেও নেই কোনো নিশ্চয়তা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুনেম বড়ুয়া বলেন, ‘আসলে আমরা প্রতিটি কারখানার কর্তৃপক্ষের কাছে নোটিশ দিয়ে থাকি, যাতে তারা যেন কোনো শিশুকে নিয়োগ না দেয়। আবার অনুমোদনযোগ্য বয়সের যাদের নিয়োগ দেয়, তাদের দিয়ে যেন কোনোভাবেই ঝুঁকিপূর্ণ ও অনুমোদিত সময়ের বেশি কাজ না করানো হয়।
‘ভবিষ্যতে আমরা পরিদর্শনে এসব বিষয় আরও কঠোরভাবে নজরে রাখব। যদি কারখানায় শিশুশ্রম আইনের ব্যত্যয় পাওয়া যায়, কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
একই সঙ্গে অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে যে তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে, ওই কমিটির প্রতিবেদনে শিশুদের অবৈধভাবে নিয়োগের বিষয়টি তুলে ধরা হবে বলেও জানান তিনি।
ঝুঁকিপূর্ণ কারখানাগুলোর বিষয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী, জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ঢাকা বিভাগ) দিনমনি শর্মা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সেজান জুস কারখানার মতো দুর্ঘটনা আর যাতে না ঘটে সে জন্য প্রাথমিকভাবে কোন কোন কারখানা ঝুঁকিপূর্ণ তা চিহ্নিত করার উদ্যোগ চলমান রয়েছে। তবে ঝুঁকিপুর্ণ কারখানাগুলোর ভবিষ্যৎ কী হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে শিগগিরই উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সেখানেই করণীয় ঠিক হবে ঝুঁকিপুর্ণ কারখানাগুলো কীভাবে চলবে।’
এ বিষয়ে পরামর্শ রেখে ইলেকট্রনিক সেইফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (ইসসাব) যুগ্ম মহাসচিব প্রকৌশলী মো. মাহমুদুর রশিদ বলেন, ‘আমরা কারখানা মালিকদের উদ্দেশ্যে শুধু এটুকুই বলতে চাই, আপনারা আপনাদের কষ্টের বিনিয়োগকে সুরক্ষিত রাখার জন্যেও নিজে নিরাপদ থাকতে এবং শ্রমিকদের জীবন বাঁচাতে উদ্যোগ নিন। ভবনের স্ট্র্যাকচারাল এবং ফায়ার সেইফটি এবং ইলেকট্রিক্যাল সেইফি স্ট্যান্ডার্ড মেইনেটইন করুন এবং সময় থাকতেই ত্রুটি দূর করুন।’