মানিকগঞ্জের সিংগাইরে এক স্বর্ণকারকে মারধরের ঘটনার পর থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযানে যাননি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুনা লায়লা। তার বদলে অভিযান চালাচ্ছেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মেহের নিগার সুলতানা।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ইউএনও নিজেই।
কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার স্বামী ও সন্তান অসুস্থ থাকায় তিনি ঢাকায় আছেন। তাদের কাছে থেকে সেবাযত্ন করছেন।
ঘটনাটি তদন্তে গঠন করা কমিটি এখনও কাজ শুরু করেনি। এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, দায়িত্বটি লিখিতভাবে আজ তাকে দেয়া হয়েছে। তাই কাজ শুরু করতে পারেননি।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ওই মারধরের ঘটনা ঘটে সিংগাইরের ধল্লা ইউনিয়নের জাগীর বাজারে। মারধরের শিকার হন তপন চন্দ্র দাশ। শাটডাউনের মাধ্যমে দোকান খোলায় তাকে দুই হাজার টাকা জরিমানাও করেন ইউএনও রুনা লায়লা। তিনি জরিমানা পরিশোধ করেন। কিন্তু তাকে পিটুনির শিকারও হতে হয়।
প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন আসে যে, ব্যবসায়ী তপন চন্দ্র দাশ ইউএনওকে ‘আপা’ সম্বোধন করায় তাকে পিটুনি দেয় পুলিশ।
ইউএনও এই সংবাদের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। একটি জাতীয় গণমাধ্যমে তার প্রতিবাদলিপি ছাপার পর নিজের ফেসবুক পেজে সেই প্রতিবাদলিপি পোস্টও করেছেন। তবে সেই ব্যবসায়ীকে মারধরের বিষয়ে তিনি কোনো ব্যাখ্যা দিচ্ছেন না।
ইউএনও রুনা লায়লা তার প্রতিবাদলিপিতে ‘আপা’ ডাকা প্রসঙ্গ তুললেও ব্যবসায়ীকে পিটুনির নির্দেশের বিষয়ে কিছু বলছেন না
সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা অনুযায়ী কাউকে নির্যাতনমূলক কোনো সাজা দেয়া যাবে না। বাংলাদেশ এই ঘোষণায় অনুস্বাক্ষর করেছে আর কাউকে আঘাত করা বাংলাদেশেও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এই ঘটনাটি গণমাধ্যমে আসার পর যে পুলিশ সদস্য ব্যবসায়ী তপনকে মারধর করেছিলেন, তাকে প্রত্যাহার করে মানিকগঞ্জ পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়।
মানিকগঞ্জের সিংগাইর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার রেজাউল হক এই ঘটনায় ইউএনওর দায় দেখেছেন। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমি সেখানে ছিলাম না। তবে আমার পুলিশ সদস্য রফিকের কথা রেকর্ড করেছি। সে বলেছে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশেই মেরেছে।’
পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলেও ইউএনওর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ার সমালোচনার মধ্যে রোববার জেলা প্রশাসক আব্দুল লতিফ ঘটনাটি তদন্তে একটি কমিটি গঠন করেন। এতে ইউএনও দায় পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি।
এই তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছেন জেলার স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ পরিচালক শফিকুল ইসলাম। তিনি জানিয়েছিলেন, সোমবার থেকে তদন্ত শুরু করবেন। তবে সেটি শুরু হয়নি এখনও।
কারণ জানতে চাইলে শফিকুল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জেলা প্রশাসক গতকাল মৌখিকভাবে তদন্তের কথা বলেছিলেন। কিন্তু আজকে তদন্তের বিষয়ে লিখিতভাবে দায়িত্ব পেয়েছি।’
তবে কবে তদন্ত শুরু করবেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব তদন্তের কাজ শুরু করা হবে।‘
ঘটনা যা ঘটেছে
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধে শাটডাউনের মধ্যে সিংগাইরের ধল্লা ইউনিয়নের জাগীর বাজারে দোকান খুলেছিলেন স্বর্ণকার তপন চন্দ্র দাশ। বৃহস্পতিবার বিকেলে সেই বাজারে অভিযান চালান ইউএনও রুনা লায়লা।
এ সময় তপনকে দুই হাজার টাকা জরিমানা করার পর তা পরিশোধ করেন। এরপর তাকে লাঠি দিয়ে মারধর করা হয়।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চলাকালে মারধরের শিকার সিংগাইরের জাগীর বাজারের স্বর্ণকার তপন চন্দ্র দাশ
ইউএনও নিউজবাংলাকে বলেন ‘সরকারের নির্দেশ উপেক্ষা করে লকডাউনের মধ্যে দোকান খোলা রেখে দোকানের শাটার নামিয়ে মালিকসহ ৮-১০ জন লোক বসা ছিল। দোকান খোলা ও লোকসমাগম করার অপরাধে তাকে ২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।’
পিটুনির শিকার ব্যবসায়ী তপন চন্দ্র দাশ বলেন, ‘ক্রেতাদের পূর্বের কিছু মালের অর্ডার থাকায় সেগুলো ডেলিভারি দিতেই দোকান খুলেছিলাম। এ সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত এসে হাজির হয়। আমি জরিমানার টাকাও পরিশোধ করি। পুলিশ দেখে ভয় পেয়ে ইউএনওকে আপা বলে ক্ষমা চাই। এরপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাকে লাঠি দিয়ে তিন-চারটি বাড়ি মারে এক পুলিশ।’
আপা বলায় মারধরের সংবাদের প্রতিবাদ ইউএনওর
গণমাধ্যমে আসে যে, অভিযান চলাকালে ইউএনওকে ‘আপা’ সম্বোধন করেন স্বর্ণকার তপন। আর এরপর তাকে মারধর করে সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে থাকা এক নিরাপত্তাকর্মী।
ইদানীং দেখা যাচ্ছে, সরকারি চাকুরেদের মধ্যে ‘স্যার’ শব্দ শোনার বাসনা পেয়ে বসেছে। বহু ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ‘স্যার’ না বলার কারণে মানুষকে অপমানিত হতে হয়েছে, নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। মানিকগঞ্জের এই ঘটনাটি সামনে আসার পরও তুমুল সমালোচনা তৈরি হয়।
তবে ইউএনও প্রতিবাদলিপিতে বলেছেন, তাকে আপা ডাকা নিয়ে পুলিশ কর্তৃক ব্যবসায়ীকে মারধরের বিষয়টি সঠিক নয়। মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সময় ব্যবসায়ীকে জরিমানা করার পাশাপাশি সরকারি কাজে অসহযোগিতার জন্য তাকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে নিউজবাংলাকে রুনা লায়লা বলেন, ‘আমি তো কাউকে মারতে বলিনি।’
কিন্তু মারল কেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি তখন দূরে। কিন্তু ঘটনা ঘটে গেছে।’
কিন্তু তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা কেন নেননি আর সেই পুলিশের বিরুদ্ধে কেন রিপোর্ট করেননি- এমন প্রশ্নে ইউএনও রুনা লায়লা বলেন, ‘এটা ওই রকমের কোনো ঘটনা না, সে জন্য পুলিশকে কিছু জানানো হয়নি।’