বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

এত মৃত্যু তালার কারণে

  •    
  • ১০ জুলাই, ২০২১ ১৫:০৯

‘সবকটি ফ্লোরেই সিঁড়ির সামনে লোহার তারের পার্টিশন দেয়া আছে। উৎপাদনরত অবস্থায় এসব ফ্লোরগুলোর পার্টিশন তালাবদ্ধ থাকায় আগুনের সময় শ্রমিকরা উপরে যেতে পারেননি, নিচেও নামতে পারেননি বলে মনে হচ্ছে। এ কারণে মৃতের সংখ্যা বেশি হয়েছে।’

রূপগঞ্জের সেজান জুস কারখানার নিচতলা থেকে ভবনের ষষ্ঠ তলা পর্যন্ত পুড়ে ছাই। দুর্ঘটনার তৃতীয় দিনেও হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের কেউ আসেনি কারখানায়।

কর্মীরা কেউই আসেনি অফিসে। প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও শনিবার আসেননি। স্বজনদের আনাগোনা এখানেও সেভাবে নেই। তারা এখন হাসপাতালমুখি।

যে ফ্লোরেই আগুন প্রথমে লাগুক, অন্য ফ্লোরে যেতে সময় নিয়েছে নিশ্চিত। তার পরেও শ্রমিকরা ছাদে বা নিচে নেমে আসতে না পারার পেছনে একটি কারণই উঠে এসেছে। সেটি হলো ফ্লোরে ফ্লোরে তালা।

শুক্রবার দ্বিতীয় দিনেই শ্রমিকরা অভিযোগটি জানিয়েছিলেন। আর দুই দিনের প্রাথমিক তদন্ত শেষে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারাও এখন একই কথা বলছেন।

নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক অপারেশন তানহা জানান, ‘সবকটি ফ্লোরেই সিঁড়ির সামনে লোহার তারের পার্টিশন দেয়া আছে। উৎপাদনরত অবস্থায় এসব ফ্লোরগুলোর পার্টিশন তালাবদ্ধ থাকায় আগুনের সময় শ্রমিকরা উপরে যেতে পারেননি, নিচেও নামতে পারেননি বলে মনে হচ্ছে। এ কারণে মৃতের সংখ্যা বেশি হয়েছে।’

বাংলাদেশে পোশাক খাতে মর্মান্তিক নানা দুর্ঘটনার সময়ও একই বিষয় উঠে এসেছে। ফ্লোরে ফ্লোরে তালা দেয়া থাকায় কর্মীরা নিরাপদে নামতে পারে না। আর আগুন লাগলে কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের অভয় দিয়ে কর্মস্থলে থাকতে উৎসাহ দেয়। আর সেই তালাই পরে মৃত্যুর কারণ হয়।

২০১২ সালে তাজরিন ফ্যাশনে আগুনে ১১২ শ্রমিকদের প্রাণহানির ঘটনাতেও একই ঘটনা দেখা গেছে। তালাবদ্ধ কক্ষে শ্রমিকরা পুড়ে অঙ্গার হয়েছে। কিন্তু ফ্লোর ইনচার্জরা ধমকে শ্রমিকদের কক্ষে থাকতে বাধ্য করেছে।

একই রকম অভিযোগ উঠেছে রূপগঞ্জে সেজান জুসের কারখানার আগুনের ঘটনাতেও। শ্রমিকরা বলছেন, আগুন থেকে বাঁচার জন্য ভবনের ছাদে উঠতে গিয়ে সিঁড়ির গেটে তালা দেখেছেন তারা।

একটি ঘরে শ্রমিকদের তালাবদ্ধ করে রাখার অভিযোগ করেছে কারখানার একজন শিশু শ্রমিকও।

ঘটনাস্থলে গবেষক মাহতাব উদ্দিনের কাছে বৃহস্পতিবারের ঘটনার বর্ণনা দেয় ফাতেমা। সে তৃতীয় তলা থেকে লাফিয়ে নিচে পড়ে প্রাণে রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু চতুর্থ তলায় থাকা তার বোন আর ফেরেনি।

ফাতেমার বর্ণনা ছিল এমন, ‘আমি আমার বইনের খোঁজ নিছি। তারপরে শুনি, চাইরতলায় নাকি এসি রুমের ভিতরে তালা লাগায়া রাখছে। অনেক মানুষে বলছে তালাটা খোলো। তালা খোলে নাই। মালিকে নাকি কেডা নাকি অর্ডার দিছে তালা লাগায়া রাখতে।’

কারখানায় অব্যবস্থাপনার ছাপ

ভবনের চারপাশে নানা ধরনের অব্যবস্থাপনার ছাপ চোখে পড়েছে। একটি কমপ্লায়েন্ট কারখানা বলতে যা বুঝায় তার ছিটেফোঁটাও ছিল না হাশেম সেখানে।

চারদিকে ইট, বালু, সিমেন্ট, ড্রাম, রাসায়নিকের ড্রাম, প্লাস্টিকের বস্তা, কার্ড এবং প্লাস্টিকের বিভিন্ন রকম কার্টুন ও অব্যবহৃত আসবাবপত্রের স্তুপ দেখা গেছে।

ভবনের সবকটি ফ্লোর এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও ফ্লোরে ফ্লোরে এখনো নিভে যাওয়া আগুন থেকে তীব্র ধোঁয়া এবং তাপ বের হচ্ছে। আছে উৎকট ঝাঁঝালো গন্ধও।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আজও পানি ছিটিয়ে যাচ্ছে যেন আবার আগুন ছড়াতে না পারে।

তৃতীয় দিনে কোনো ফ্লোরে নতুন করে কোনো মরদেহ চোখে পড়েনি। ফলে যে ৫১ জন নিখোঁজ হওয়ার কথা বলাবলি হচ্ছিল, তাদের ভাগ্যে আসলে কী ঘটেছে, সেটি নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। তল্লাশি চলছে আরও মরদেহের খেঁজে।

এত আগুন দাহ্য পদার্থের কারণে

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় লাগা আগুন শুক্রবার রাতেও পুরোপুরি কেন নেভানো যায়নি, সেটি ফ্লোরে ফ্লোরে মজুদ দেখেই বোঝা যায়। যেসব পণ্য ছিল, তার সবই দাহ্য। ছিল বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক, যা আগুন আরও ছড়িয়ে যেতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।

ভবনের ছয় তলায় ছিল পুরো কার্টুন এর গুদাম। আর পঞ্চম তলায় রাখা হতো বিভিন্ন রাসায়নিক ও প্লাস্টিক মোড়ক।

চতুর্থ এবং তৃতীয় তলায় উৎপাদিত হতো সেজান জুসের বিভিন্ন পণ্য। তবে পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি পাশেই সারি সারি রাখা ছিল পণ্য ভর্তি কার্টুন।

এই দুই ফ্লোরের তৃতীয় তলায় ক্যান্ডি লাইন নসিলা উৎপাদনের প্লান্ট। এ ফ্লোরে ছিল যাবতীয় ফ্লেভার, সুগার গ্লুকোজ কার্টুন কেমিক্যাল ও মোড়ক উৎপাদনের পলি।

চতুর্থ তলায় স্টোরসহ লাচ্ছা সেমাই, চানাচুর ঝাল মুড়ি তৈরি হতো। তবে এই ফ্লোরে বিপুল পরিমাণ সয়াবিন, ডাল এবং ‘মজার মজার’ ছিল। এর সবই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

নিচ তলায় ছিল কার্টুন এলডিপি বা প্লাস্টিকের পলি উৎপাদন প্লান্ট। এখানে আরেকটি স্থানে প্রসেস করা হতো ময়দা, ছিল কম্প্রেসার মেশিন। রাখা ছিল ফয়েল পেপারের বড় বড় রোল। ছিল আঠা জাতীয় রাসায়নিক।

গ্রাউন্ড ফ্লোরে ছিল সব ড্রিংস ও বিস্কুট উৎপাদন প্লান্ট। এখানে বিপুল পরিমাণ দাহ্য পদার্থ মজুদ ছিল।

দ্বিতীয় তলায় লিচু ড্রিঙ্কস ও লাচ্ছি তৈরি হতো। তৈরি হতো এসব পণ্যের প্লাস্টিক বোতলও। ছিল প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল রেজিন এর মতো দাহ্য পদার্থও।

মূলত পঞ্চম ও ষষ্ঠ দুটি ফ্লোরে গুদাম হিসেবে রাখা হলেও সবকটি ফ্লোরেই ছিল রাসায়নিক ও কার্টুনের মতো দাহ্য পদার্থের বিপুল মজুদ।

এ বিভাগের আরো খবর