নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের সজিব গ্রুপের কারখানা হাশেম ফুডসের ভবনে অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জনের প্রাণহানির ঘটনায় চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ পর্যায়ের আট কর্মকর্তাকে আটক করেছে পুলিশ।
বেলা আড়াইটার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেন, আটককৃতরা পুলিশি হেফাজতে রয়েছেন। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
আর নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম জানিয়েছেন, আটককৃতদের মধ্যে হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের চেয়ারম্যান এম এ হাশেম, তার পরিচালক সন্তানরাসহ সিইও ও ডিজিএম পর্যায়ের কর্মকর্তারা রয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার রাতে কারখানাটিতে আগুন লাগার পর শুরুতে তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও পরের দিন উদ্ধার করা হয় ৪৯ জনের মরদেহ। মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫২ জনে। বেশির ভাগের মরদেহই পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। পরিচয় শনাক্তের জন্য ডিএনএ পরীক্ষা চলছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘সারা দেশ এ ঘটনায় স্তব্ধ। একসঙ্গে এতজনের প্রাণহানি খুবই দুঃখজনক। প্রথমে তিনজন, পরবর্তী সময়ে ৪৯ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়। ফায়ার সার্ভিস কিছু জীবিতদেরও উদ্ধার করেছে। এখন পর্যন্ত আটজনকে আটক করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, এ ঘটনায় পৃথক তদন্ত কমিটি করে দেয়া হয়েছে। কারখানায় কতজন লোক কাজ করত, সবই তদন্তে বেরিয়ে আসবে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হয়েছে। আরও সহযোগিতা প্রয়োজন হলে সরকারের পক্ষ থেকে করা হবে।
মামলা ও দোষীদের শাস্তির বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘অবশ্যই মামলা হবে। এর সঙ্গে সামান্যতম দোষীদেরও আইনের আওতায় এনে বিচার করা হবে। তবে তদন্তের আগে বিস্তারিত কিছু বলতে চাচ্ছি না। তদন্ত শেষে অবশ্যই তাদের বিচার হবে।’
কারখানায় আগুনে নিহতদের বেশির ভাগই শিশু। এতে শিশুশ্রমের বিষয়টি আবার সামনে চলে এসেছে। কারখানায় শিশুশ্রমের বিষয়ে আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, কতজন শিশু শ্রমিক ছিল তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও এখনও পুরোপুরি নেভেনি। ভবনের সব কটি ফ্লোর এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তীব্র ধোঁয়া এবং তাপ বের হচ্ছে। আছে উৎকট ঝাঁঝালো গন্ধ। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পানি ছিটিয়ে ধোঁয়া নিবারণ এবং আবারও যাতে আগুন না লাগে, সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানালেন, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, ইউএনও ও ডিসি তাৎক্ষণিকভাবে এখানে আসছে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে তাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। ১৭ জনকে ছাদ থেকে বড় একটি মই দিয়ে রেস্কিউ করেছে ফায়ার সার্ভিস। সিঁড়িতে ও ছাদে তালা দেয়া ছিল কি না, তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে।
কারখানায় অব্যবস্থাপনার ছাপ
হাশেম ফুডের ভবনের চারপাশে নানা ধরনের অব্যবস্থাপনার ছাপ চোখে পড়েছে। একটি কমপ্লায়েন্ট কারখানা বলতে যা বুঝায় তার ছিটেফোঁটাও ছিল না হাশেম সেখানে।
চারদিকে ইট, বালু, সিমেন্ট, ড্রাম, রাসায়নিকের ড্রাম, প্লাস্টিকের বস্তা, কার্ড এবং প্লাস্টিকের বিভিন্ন রকম কার্টন ও অব্যবহৃত আসবাবপত্রের স্তুপ দেখা গেছে।
ভবনের সবকটি ফ্লোর এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও ফ্লোরে ফ্লোরে এখনো নিভে যাওয়া আগুন থেকে তীব্র ধোঁয়া এবং তাপ বের হচ্ছে। আছে উৎকট ঝাঁঝালো গন্ধও।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আজও পানি ছিটিয়ে যাচ্ছে যেন আবার আগুন ছড়াতে না পারে।
তৃতীয় দিনে কোনো ফ্লোরে নতুন করে কোনো মরদেহ চোখে পড়েনি। ফলে যে ৫১ জন নিখোঁজ হওয়ার কথা বলাবলি হচ্ছিল, তাদের ভাগ্যে আসলে কী ঘটেছে, সেটি নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। তল্লাশি চলছে আরও মরদেহের খোঁজে।
দাহ্য পদার্থের ছড়াছড়ি
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় লাগা আগুন শুক্রবার রাতেও পুরোপুরি কেন নেভানো যায়নি, সেটি ফ্লোরে ফ্লোরে মজুদ দেখেই বোঝা যায়। যেসব পণ্য ছিল, তার সবই দাহ্য। ছিল বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক, যা আগুন আরও ছড়িয়ে যেতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।
ভবনের ছয় তলায় ছিল পুরো কার্টুন এর গুদাম। আর পঞ্চম তলায় রাখা হতো বিভিন্ন রাসায়নিক ও প্লাস্টিক মোড়ক।
চতুর্থ এবং তৃতীয় তলায় উৎপাদিত হতো সেজান জুসের বিভিন্ন পণ্য। তবে পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি পাশেই সারি সারি রাখা ছিল পণ্য ভর্তি কার্টন।
এই দুই ফ্লোরের তৃতীয় তলায় ক্যান্ডি লাইন নসিলা উৎপাদনের প্লান্ট। এ ফ্লোরে ছিল যাবতীয় ফ্লেভার, সুগার গ্লুকোজ কার্টুন কেমিক্যাল ও মোড়ক উৎপাদনের পলি।
চতুর্থ তলায় স্টোরসহ লাচ্ছা সেমাই, চানাচুর ঝাল মুড়ি তৈরি হতো। তবে এই ফ্লোরে বিপুল পরিমাণ সয়াবিন, ডাল এবং ‘মজার মজার’ ছিল। এর সবই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
নিচ তলায় ছিল কার্টুন এলডিপি বা প্লাস্টিকের পলি উৎপাদন প্লান্ট। এখানে আরেকটি স্থানে প্রসেস করা হতো ময়দা, ছিল কম্প্রেসার মেশিন। রাখা ছিল ফয়েল পেপারের বড় বড় রোল। ছিল আঠা জাতীয় রাসায়নিক।
গ্রাউন্ড ফ্লোরে ছিল সব ড্রিংস ও বিস্কুট উৎপাদন প্লান্ট। এখানে বিপুল পরিমাণ দাহ্য পদার্থ মজুদ ছিল।
দ্বিতীয় তলায় লিচু ড্রিঙ্কস ও লাচ্ছি তৈরি হতো। তৈরি হতো এসব পণ্যের প্লাস্টিক বোতলও। ছিল প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল রেজিন এর মতো দাহ্য পদার্থও।
মূলত পঞ্চম ও ষষ্ঠ দুটি ফ্লোরে গুদাম হিসেবে রাখা হলেও সবকটি ফ্লোরেই ছিল রাসায়নিক ও কার্টনের মতো দাহ্য পদার্থের বিপুল মজুদ।