মগবাজারে বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবন রাখি নীড়ের চোরাই গ্যাসলাইনে লিকেজ পাওয়া গেছে। এরপর থেকেই তদন্তের মোড় ঘুরে গেছে।
এর আগে পর্যন্ত বিস্ফোরণের কারণ হিসেবে স্যুয়ারেজ লাইনের গ্যাস জমা হওয়ার বিষয়টিতে জোর দেয়া হচ্ছিল। কিন্তু চোরাই গ্যাসলাইন উদঘাটন হওয়া এবং সেখান থেকে গ্যাস লিকেজ ঘটতে থাকায় এখন এটিই তদন্ত কমিটির মনোযোগের কেন্দ্রে চলে এসেছে।
এখন পর্যন্ত সকল কমিটি নিশ্চিত হয়েছে, গ্যাসের কারণেই এই বিস্ফোরণ। তবে ভবনের ঠিক কোথায় সেই গ্যাস চেম্বার তৈরি হয়েছিল, সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি তারা।
ঘটনার আট দিন পর রোববার সকালে হঠাৎ আবার ভবনের সামনে থেকে গ্যাস লিকেজ শুরু হয়। খবর পেয়ে তিতাস গ্যাসের জরুরি সংস্কার বিভাগ সেই লিকেজ খুঁজে বের করার কাজ শুরু করে।
দিনভর ভবনের সামনে খোঁড়াখুঁড়ির পর রাতে সেই লিকেজ শনাক্ত হয়। দেখা যায় ভবনের ভেতরে যে চোরাই গ্যাসলাইনের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল, সেই লাইন থেকেই গ্যাস লিক হচ্ছে। পরে ওই লাইনের গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিতাস গ্যাসের এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে জানান, মগবাজার ফ্লাইওভারের মূল সড়কের নিচ দিয়ে একটি গ্যাসলাইন এসে ওই ভবনের ভেতরে চলে গেছে, যেটির একটি প্রান্ত ভবনের ভেতরে দৃশ্যমান। ওই লাইনটিতেই লিকেজ পাওয়া গেছে। এই লিকেজ দিয়ে অনেক গ্যাস বের হচ্ছিল।
রোববার ওই ভবনের সামনে আবারও গ্যাস লিক করছিল
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার মহাব্যবস্থাপক ও ঘটনার তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক শাহনেওয়াজ পারভেজ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ভবনের ভেতরে একটি গ্যাসলাইনের সন্ধান পেয়েছি। ওই লাইনে গ্যাস গতকাল (রোববার) লিক করেছিল। এখন আমরা তদন্ত করে দেখছি, এই লাইনের লিকেজ থেকে এই বিস্ফোরণ ঘটেছে কি না এবং সেই সাথে সম্ভাব্য অন্য সব উৎসকেও আমরা তদন্তের আওতায় রেখেছি।’
মগবাজারে বিস্ফোরণ ঘটা ভবনে রয়েছে একটি চোরাই গ্যাসলাইন
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভবনটির নিচতলায় প্রক্রিয়াজাতকৃত মাংসের চেইন শপ বেঙ্গল মিটের যে আউটলেট ছিল, ঠিক তার মেঝের নিচ দিয়ে আড়াআড়িভাবে ওই গ্যাসলাইনটি ভবনের ভেতরে ঢুকে গেছে। সেটি বেঙ্গল মিটের বাইরের দেয়াল ঘেঁষে ভবনের ওপরের তলায় উঠে গেছে। আর গ্যাসলাইনটি যেদিক দিয়ে প্রবেশ করেছে তার ওপরে মূলত বেঙ্গল মিটের জেনারেটর রুম ছিল।
এভাবে লুকিয়ে ভবনের মাটির নিচ দিয়ে গ্যাস সংযোগ টানার কারণ জানতে চাইলে শাহনেওয়াজ বলেন, ‘এমনটা তো স্বাভাবিকভাবে হওয়ার কথা না। কারণ, কোনো অবস্থাতেই তিতাস এভাবে লাইন টেনে দেবে না। আমরা সবকিছুই তদন্ত করে দেখব।’
ভবনটির গ্যাসলাইন ১৯৭২ সালের
বিস্ফোরণের শিকার তিনতলা ভবন রাখি নীড়ে শুরুতে আবাসিক গ্যাস সংযোগ ছিল। সেটি ১৯৭২ সালের সংযোগ। পুরোনো নথি থেকে এ তথ্য জানতে পেরেছে তিতাস কর্তৃপক্ষ। ভবনটির সংযোগসংক্রান্ত কোনো তথ্য তিতাসের সার্ভারে পাওয়া যায়নি। কারণ ২০১৪ সালে ওই সংযোগ স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন করা হয়। তাই সেটি আর তিতাসের তালিকায় ছিল না।
সেই নথি সূত্রে জানা যায়, ১৯৭২ সাল থেকে সচল থাকার পর সংযোগটি ২০১৪ সালে স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন করে তিতাস। যেকোনো সংযোগ বিচ্ছিন্নের আদেশে কারণ উল্লেখ থাকলেও এই সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করার আদেশে কোনো কারণ উল্লেখ ছিল না। আদেশে শুধুই স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন করার কথা বলা হয়েছে।
মগবাজারে বিস্ফোরণ হওয়া ভবনের নিচে এমন পাইপ দিয়ে গ্যাসের সংযোগ দেয়া হয়
তাছাড়া ভবনটির সংযোগ দেবার সময় একটি নকশা তৈরি করে রেখেছিল তিতাস। সেই নকশায় দেখা যায়, মূল সড়কের পর ১৪ ফুট খালি জায়গা ছিল। সেই জায়গার পর ভবনের মূল কাঠামো থাকার কথা। কিন্তু এই নকশার সাথে কোনো মিল নেই ভবনের বর্তমান কাঠামোর। এখন ফুটপাত ঘেঁষেই ভবন। হদিস নেই সেই ফাঁকা ১৪ ফুট জায়গার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিতাস গ্যাসের ওই কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা এত আগের লাইন যে এর সম্পর্কে এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা কঠিন। তবে কিছু বিষয়ে খটকা আছে। ২০১৪ সালের আদেশ যেহেতু আমরা পেয়েছি, তাই এরপর থেকে এই লাইনের কোনো অস্তিত্ব থাকার কথা নয়। আর আমরা লিকেজ বের করতে গিয়ে যা দেখলাম, তা হলো আলাদা একটি পাইপ দিয়ে রাস্তার নিচের গ্যাসলাইন থেকে ভবনের ভেতরে সংযোগ নেয়া হয়েছে, যা তিতাস কখনোই করবে না। কারণ গ্যাসলাইনের রাইজার ভবনের ভেতরে স্থাপন করার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের ধারণা পুরো গ্যাসলাইনের সংযোগটি আড়াল করতেই এই ব্যবস্থা করা হয়েছে।
‘আবার তখনকার নকশা বলছে, সেই সময় ভবনের সামনে কিছু খালি জায়গা ছিল, ভবনের এখনকার কাঠামো যেখানে শুরু হয়েছে, তা মূলত খালি জায়গা ছিল। এমনও হতে পারে, তিতাস গ্যাস তখন বাড়ির বাইরে সামনের অংশে রাইজারটি স্থাপন করেছিল, কিন্তু মালিক নিয়ম না মেনেই গ্যাস সংযোগ রাইজারটি ভবনের ভেতরে রেখে ভবনটির সামনের অংশ বর্ধিত করেছেন। ফলে গ্যাসের লাইনের ওপর দিয়েই দোকান তৈরি হয়েছে। সবকিছু তদন্তের পরই নিশ্চিত হওয়া যাবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।