হেফাজত নেতা মামুনুল হকের মতোই ঘটনা। নারায়ণগঞ্জের রিসোর্টে অবরুদ্ধ হয়ে সঙ্গিনীকে দ্বিতীয় স্ত্রী দাবি করার পর তার কথিত দ্বিতীয় বিয়ের প্রসঙ্গ আসে সামনে।
ক্রিকেটার থেকে ধর্মীয় আলোচক বনে যাওয়া আবু ত্ব-হা মোহাম্মদ আদনানের দ্বিতীয় বিয়ের প্রসঙ্গও এলো তার উধাও হয়ে যাওয়ার পর।
তার আগ পর্যন্ত ত্ব-হার স্বজন, প্রথম স্ত্রীর পরিবার কিছুই জানতে পারেনি। তার মা আজেদা বেগমও বিয়ের কথাটি জানেননি তাৎক্ষণিক। পরে একটি মাধ্যমে জানার পর আর কাউকে জানাননি।
আজেদা তার ছেলের দ্বিতীয় স্ত্রীকে খুব একটা যে পছন্দ করেন না, সেটা জানিয়েছেন নিউজবাংলাকে।
১০ জুন ত্ব-হা ঢাকায় আসার পথে নিখোঁজ হওয়ার দাবি প্রথমে সামনে আনেন তার স্ত্রী পরিচয়ে সাবিকুন্নাহার সারা। তখনও জানা যায়নি তিনি যে দ্বিতীয় স্ত্রী।
পরে সারা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তার স্বামীকে উদ্ধারের আবেদন জানিয়ে চিঠি দেন; ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করেন, বেসরকারি টেলিভিশনে দেন দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। বিশেষ করে সংবাদ সম্মেলনে তার রাখা আবেগঘন বক্তব্য ‘ত্ব-হাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেন, না হলে তার কাছে আমাকে নিয়ে যান’ পায় বিশেষ গুরুত্ব।
সাবিকুন্নাহারের এই সামনে আসায় চমকে ওঠেন ত্ব-হার স্বজন ও পরিবারের লোকজন। পরিবারের অনেকেই এই বিয়ের খবর জানতেন না।
ত্ব-হাকে খুঁজে না পাওয়ার কথা প্রথমে জানান তার দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিকুন্নাহার। ১৬ জুন তিনি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলনে আসেন। ছবি: নিউজবাংলা
ত্ব-হার মা আজেদা বেগম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিয়ের খবর আমি কিছুদিন পরে পাইছি। আমি শুনেছি ত্ব-হাকে ট্রাপে ফেলানো হয়েছে। খুব মানসিক অত্যাচার করত, ডিস্টার্ব করত। খুবই অশান্তিতে ছিল ত্ব-হা।’
ত্ব-হার মামা আমিনুল ইসলাম (মা-মামা একই বাড়িতে থাকেন) বলেন, ‘আমরা বিয়ের খবর জানতাম না। এই ঘটনার (নিখোঁজ) পর মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারি, সে বিয়ে করেছে। এর বেশি কিছুই জানি না।’
ত্ব-হার প্রথম স্ত্রী আবিদা নূরের বাবা আজহারুল ইসলাম মণ্ডলও বললেন একই কথা।
তিনি বলেন, ‘আমি এই ঘটনাগুলো হবার পর ফেসবুক আর মানুষের কাছে শুনতেছি যে, জামাই ঢাকাত বিয়ে করছে। এর আগে আমি জানি না।’
আবিদা নূর বিষয়টি জানেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ও খুব পরহেজগার, কারও সঙ্গে কথা বলে না।’
‘আপনি একটু শুনে জানাবেন’-এমন মন্তব্যের পর আজহারুল বলেন, ‘ঠিক আছে।’
কিছুক্ষণ পর ফোন করা হলে তিনি বলেন, “বাড়িতে অনেক গেস্ট আছে, মানুষ আছে। আমি মেয়ের কাছে জানতে চাইলাম। বলল, ‘বাবা আমি পরে বিষয়টা তোমাকে বলব।’”
আবিদার সঙ্গে ত্ব-হার বিয়ে হয় পারিবারিকভাবে। দেড় মাস আগে আবিদা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। এর আগ পর্যন্ত রংপুরের শালবনের চেয়ারম্যানের গলিতে ভাড়া বাসায় থাকতেন স্বামী-স্ত্রী। তবে এখন আবহাওয়া অফিসের কাছে বাবার বাড়িতে আছেন।
ত্ব-হার মা থাকেন নগরীর সেন্ট্রাল রোডে আহলে হাদিস মসজিদের পাশে পারিবারিক বাসভবনে। আর শুক্রবার রাতে আদালত থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি ওঠেন মায়ের কাছেই।
- আরও পড়ুন: ত্ব-হার কাছে এখনই যাবেন না সাবিকুন্নাহার
শনিবার সকালে সেই বাসায় গিয়ে ত্ব-হার বক্তব্য পায়নি নিউজবাংলা। তার মা বলেছেন, ত্ব-হা অসুস্থ, এখন কথা বলবেন না।
১০ জুন ঢাকায় আসার কথা ছিল ত্ব-হার। দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিকুন্নাহার সারা দাবি করেছেন, তার কাছেই আসছিলেন তিনি।
এই অন্তর্ধান নিয়ে নানা গুঞ্জনের মধ্যে আট দিন পর ১৮ জুন খোঁজ মেলে ত্ব-হার। তিনি প্রথম স্ত্রীর বাবার বাড়ি যাওয়ার সময় স্থানীয়রা দেখে জানায় পুলিশকে।
পরে পুলিশ গিয়ে নিয়ে আসে ত্ব-হাকে। তার বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, ব্যক্তিগত কারণে তিনি গাইবান্ধায় একটি বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন।
সেই বাড়িটি ত্ব-হার বাল্যবন্ধু সিয়াম ইবনে শরীফের বাবার।
গৃহকর্তা শরীফ খান মারা গেছেন বছর দুয়েক আগে। সিয়াম চাকরি করেন রংপুরে; বোনের বিয়ে হয়েছে ঢাকায়। সেই বাসায় একাই থাকেন সিয়ামের মা নিশাত নাহার।
তিনি জানান, ত্ব-হা আগে তাদের বাসায় একা থেকেছেন। এবার তিন সঙ্গীসহ এসে বলেছেন, দুই ব্যক্তি তাকে ফলো করছে। এ কারণে বাসায় থাকবেন। তাই তিনি সন্দেহ করেননি।
সেই বাসার টেলিভিশন নষ্ট, নিশাত স্মার্টফোনও ব্যবহার করেন না। ফলে ত্ব-হাকে নিয়ে কী হচ্ছে, সেটি তিনি জানতে পারেননি।
তবে বৃহস্পতিবার রাতে তার মেয়ের ফোনে জানতে পারেন সবকিছু। আর তখন ত্ব-হাকে বাসায় যেতে বলেন।
ত্ব-হা শুক্রবার রংপুরে ফিরে যান প্রথম স্ত্রী আবিদার বাসায়। আর দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিকুন্নাহার সারার সঙ্গে দিনভর চেষ্টা করে যোগাযোগ করতে পারেন রাতে।
ত্ব-হার কাছে যেতে চাওয়ার আকুতি জানানো সারার কাছে নিউজবাংলা প্রশ্ন রাখে তিনি রংপুর যাবেন কি না। তবে তিনি জবাব দেন নেতিবাচক।
সারার বক্তব্য, আদালতে আইনজীবীর দুই স্ত্রীর মধ্যে ‘ঝামেলার’ প্রসঙ্গ তোলা, মায়ের জিম্মায় ত্ব-হাকে বাড়ি পাঠানোর পর এটা স্পষ্ট হয় যে, ত্রিভুজ সম্পর্কের সমীকরণ কিছুটা জটিল।
ত্ব-হার আইনজীবী সোলায়মান আহমেদ সিদ্দিকী বাবু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ত্ব-হা আদালতে ১৬৪ ধারায় জানিয়েছেন, উনি গাইবান্ধায় ছিলেন। তিনি নিজেই পারিবারিক অশান্তির কারণে নিখোঁজ ছিলেন।
‘শুক্রবার প্রথম স্ত্রীর (আবিদা নূর) বাবার বাড়িতে আসছিলেন। উনার সঙ্গীরাই উনার সঙ্গে ছিলেন। যেহেতু দুই স্ত্রীর মধ্যে ঝামেলা ছিল, তাই তাকে তার মায়ের জিম্মায় দেয়া হয়েছে।’
ত্ব-হার বরাত দিয়ে তার মায়ের করা সাধারণ ডায়েরির (জিডি) তদন্ত কর্মকর্তা মজনু মিয়া নিউজবাংলাকে জানান, তিন মাস আগে এই দ্বিতীয় বিয়ে হয়। তবে কোথায় কীভাবে বিয়ে হয়েছে, সেটি তিনি জানেন না।
গাইবান্ধা সদরে বোয়ালী ইউনিয়নের পশ্চিম পিয়ারাপুর গ্রামের এই বাড়িতে সাত দিন অবস্থান করেছেন ত্ব-হা ও তার তিন সঙ্গী। ছবি: নিউজবাংলা
এই পুলিশ কর্মকর্তা এ-ও জানান, বিয়ের কিছুদিন আগে ঢাকায় একটি আলোচনা সভায় সাবিকুন্নাহারের সঙ্গে ত্ব-হার পরিচয় হয়। এরপর হয় বিয়ে।
সাবিকুন্নাহার সারা ঢাকার মিরপুর-১১ নম্বরের ‘এ’ ব্লকের একটি বাসায় মেয়েদের একটি মাদ্রাসা চালান। মাদ্রাসার পাশেই একটি বাসায় থাকতেন। তবে এখন সেই বাসায় থাকেন না।
তাদের বিয়ের বিষয়ে জানতে গত শনিবার অসংখ্যবার ফোন করা হয় সাবিকুন্নাহার সারাকে। একবার ফোন রিসিভ করে সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর সংযোগ কেটে দেন। এরপর আর ফোন রিসিভ করেননি।
দ্বিতীয় বিয়ের কী শর্ত
মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির যদি আরেকটি বিয়ে করার প্রয়োজন হয়, তাহলে তাকে বর্তমান স্ত্রী বা স্ত্রীদের মধ্যে শেষ স্ত্রীর অনুমতি লাগবে।
ওই ব্যক্তিকে এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানের কাছে আরেকটি বিয়ে করার অনুমতি চেয়ে আবেদন করতে হবে। অনুমতির জন্য ফি দিয়ে চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করতে হবে।
বেশ কয়েকটি শর্তে দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি দেয়া যেতে পারে। ১. বর্তমান স্ত্রীর বন্ধ্যত্ব, ২. শারীরিক মারাত্মক দুর্বলতা, ৩. দাম্পত্য জীবন-সম্পর্কিত শারীরিক অযোগ্যতা, ৪. দাম্পত্য অধিকার পুনর্বহালের জন্য আদালত থেকে প্রদত্ত কোনো আদেশ বা ডিক্রি বর্জন, ৫. মানসিকভাবে অসুস্থতা ইত্যাদি।
অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করলে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৪৯৪-এর বিধান মতে, কারাদণ্ডের মেয়াদ সাত বছর পর্যন্ত হতে পারে।