ঘরে মা ও দুই ভাই-বোনের মরদেহ, মেঝেতে আহত বাবা। সেই বাবাকেই এখন সন্দেহ করা হচ্ছে হত্যাকারী হিসেবে।
এসবের কিছুই জানে না পাঁচ বছর বয়সী আফসান। বাসায় না থাকায় প্রাণে বেঁচে যায় সে। এখন আছে মামার বাসায়। মা-বাবা-ভাইবোনের খোঁজ করছে; যেতে চাইছে বাড়ি।
আফসান সিলেটের গোয়াইনঘাটের হিফজুর-আলিমা দম্পতির মেজো ছেলে। গোয়াইনঘাটের ফতেহপুর ইউনিয়নের বিন্নাকান্দি দক্ষিণপাড়া গ্রামের বাড়িতে বুধবার সকালে পাওয়া যায় তার মা আলিমা বেগম, বড় ভাই ১০ বছরের মিজান ও ছোট বোন ৩ বছরের তানিশার রক্তাক্ত মরদেহ।
সেখান থেকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় আফসানের বাবা হিফজুর রহমানকে। তাকে ভর্তি করা হয় সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
আফসানের নানা আইয়ুব আলী নিউজবাংলাকে বলেন, আফসান তাদের বাড়িতে আছে। তাকে এই ঘটনা জানানো হয়নি।
তিনি বলেন, মঙ্গলবার মামার বাড়িতে বেড়াতে আসে আফসান। রাতে সেখানেই সে থেকে যায়। আর ওই রাতেই হত্যা করা হয় তার মা ও ভাই-বোনকে। সে ওই বাড়িতে থাকলে তাকেও হত্যা করা হতো।
হত্যাকারী হিসেবে হিফজুরকে পুলিশ এখন সন্দেহ করছে। এ বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন আইয়ুব আলী।
কারও প্রতি সন্দেহ করতে পারছেন না বলেও জানান তিনি।
পুলিশ বলছে, হিফজুরের আচরণ শুরু থেকেই সন্দেহজনক।
ঘটনার পর পুলিশ প্রাথমিকভাবে ধারণা করেছিল, সম্পত্তিসংক্রান্ত বিরোধ থেকে এই হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে। তবে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ও অনেককে জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে এখন পুলিশের সন্দেহের তির আহত হিফজুরের দিকেই।
আহত হিফজুর রহমান
এই ঘটনার তদন্তের সঙ্গে সম্পৃক্ত পুলিশের জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘হিফজুর রহমান প্রথম থেকেই সন্দেহজনক আচরণ করছেন। প্রথমে আমরা তা বুঝতে পারিনি।
‘তিনি ঘরের ভেতরে অজ্ঞানের ভান করে পড়ে ছিলেন। তবে হাসপাতালে নেয়ার পর বোঝা যায় তার আঘাত গুরুতর নয়।’
হিফজুরকে সন্দেহের কয়েকটি কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাইরে থেকে কেউ হত্যার জন্য এলে সঙ্গে করে অস্ত্র নিয়ে আসত। তাদের ঘরের বঁটি দা দিয়েই খুন করত না। বিরোধের কারণে খুনের ঘটনা ঘটলে প্রথমেই হিফুজরকে হত্যা করা হতো কিংবা স্ত্রী সন্তানদের প্রথমে হামলা করলেও হিফুজর তা প্রতিরোধের চেষ্টা করতেন। এতে স্বভাবতই তিনি সবচেয়ে বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হতেন।
‘অথচ হিফজুরের শরীরের আঘাত একেবারেই সামান্য। হিফজুরের শরীরের কিছু জায়গার চামড়া ছিলে গেছে কেবল। এতে আমাদের ধারণা স্ত্রী-সন্তানদের হত্যা করে ঘটনা অন্য খাতে প্রবাহিত করতে নিজেই নিজের হাত-পা ছিলেছেন তিনি।’
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘সাধারণত ঘুমানোর আগে সবাই হাত-পা ধুয়ে ঘুমাতে যান। হিফজুরের স্ত্রী-সন্তানদের মরদেহের হাত, পাও পরিষ্কার ছিল। অথচ তার পায়ে বালু ও কাদা লাগানো ছিল। এতে বোঝা যাচ্ছে তিনি রাতে ঘুমাননি।’
এ ছাড়া হিফজুর অজ্ঞান হওয়ার ভান করেছিলেন জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘এখন হাসপাতালে জিজ্ঞাসাবাদেও তিনি উল্টাপাল্টা কথা বলছেন। পাগলের মতো আচরণ করছেন। তার কথাবার্তাও সন্দেহজনক।’তবে কী কারণে হিফজুর তার স্ত্রী-সন্তানদের খুন করতে পারেন এ বিষয়ে কিছু জানাতে পারেননি ওই কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, ‘যেহেতু হিফজুর এখনও হাসপাতালে আছেন তাই তাকে বেশি জিজ্ঞাসাবাদ করা যাচ্ছে না। তবে সুস্থ হলে তাকে আরও জিজ্ঞাসাবাদে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাবে।’
গোয়াইনঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল আহাদ বলেন, ‘কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা হিফজুরকে সন্দেহ করছি। তিনি হাসপাতালে পুলিশের নজরদারিতে আছেন। তবে এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না।’দিনমজুর হিফজুর তার মায়ের নামে পাওয়া জমিতে ঘর বানিয়ে থাকেন। স্থানীয় লোকজন জানান, বুধবার সকালে অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুম থেকে উঠছিলেন না হিফজুরের পরিবারের সদস্যরা। দেরি দেখে প্রতিবেশীরা হিফজুরের ঘরের সামনে যান। এ সময় ভেতর থেকে কান্নার শব্দ শুনে দরজায় ধাক্কা দেন তারা।
একাধিক প্রতিবেশী জানান, দরজার ছিটকানি খোলাই ছিল। ভেতরে প্রবেশ করে খাটের মধ্যে তিনজনের গলাকাটা মরদেহ ও হিফজুরকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পান তারা। পরে খবর দিলে গোয়াইনঘাট থানার পুলিশ গিয়ে লাশ তিনটি উদ্ধার করে হিফজুরকে হাসপাতালে পাঠায়।
এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত মামলা হয়নি। কাউকে আটক করা হয়নি বলেও জানান ওসি।