‘যার জন্য বছরের পর বছর কষ্ট করলাম। সঞ্চয়ের টাকায় কেনাকাটা করলাম। একরাতে তার সবকিছুই তছনছ করে দিল ডাকাতরা। বিয়েটাও পিছিয়ে গেল।’ নিউজবাংলাকে কথাগুলো বলার সময় জড়িয়ে আসে সৌদি থেকে দেশে পা রাখতেই ডাকাতের হাতে সব হারানো যুবক আকরাম হোসেন শাহিনের কণ্ঠ।
গত বৃহস্পতিবার ভোররাতে গাড়িতে করে ঢাকা থেকে কুমিল্লায় বাড়ি যাওয়ার সময় নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও থানার মোগড়া পাড়া সড়কে ডাকাতের কবলে পড়েন শাহিন। এ সময় তার গাড়ির সামনে ও পেছনে আরও অনেক গাড়ি ছিল। লোকজন ছিল। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেননি বলে জানালেন শাহিন।
ঘটনার আকস্মিকতায় সব হারিয়ে শাহিন দিশেহারা হয়ে রাস্তায় বসে আর্তনাদ করেন। এমন একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। নিউজবাংলার পক্ষ থেকে বিষয়টি পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) সোহেল রানাকে জানানো হয়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি দাগনভূঞা ও সোনারগাঁও থানা-পুলিশকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।
সোনারগাঁও থানা-পুলিশ শনিবার ফেনী থেকে শাহিনকে সোনারগাঁও থানায় ডেকে পাঠায়। তার বয়ান শুনে অভিযোগ রেকর্ড করেন। অভিযোগটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) কিংবা মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে কি না জানেন না শাহিন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোনারগাঁও থানার ওসি হাফিজুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, সৌদি প্রবাসী যুবকের বর্ণনা ও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে। পাশাপাশি ডাকাতদলের সদস্যদের শনাক্তের কাজ চলছে।
যেভাবে ডাকাতদলের কবলে পড়েন
শাহিনের ভাষ্যমতে, তার বড় ভাই ও ভগ্নিপতি কোম্পানীগঞ্জের পূর্বপরিচিত এক ব্যক্তির মাধ্যমে গাড়ি ভাড়া করেন। গাড়ি ভাড়ার সময় পূর্বপরিচিত যার সঙ্গে কথা হয়েছে, তিনি না গিয়ে আরেক চালককে পাঠান। বিমানবন্দর থেকে সেই গাড়িতে ওঠেন শাহিন, তার বড় ভাই ও ভগ্নিপতি।
বিমানবন্দর থেকে যে রুটে চালককে যেতে বলা হয়, তার কোনোটিতেই যেতে রাজি হননি চালক। চালক নিজেই তার পছন্দের রুটে গাড়ি চালিয়ে যান। মোগড়া পাড়ায় পৌঁছালে দেখেন, তার সামনে একাধিক গাড়ি রাস্তায় বড় বড় ব্লক ও গাছের গুঁড়ি ফেলে আটকে রাখা হয়েছে। তার পেছনেও হানিফ পরিবহনের গাড়ি, অন্যান্য যানবাহন ছিল। হঠাৎ রাস্তার ঢাল থেকে ৭-৮ জন লোক ধারালো অস্ত্র, লাঠিসোঁটা নিয়ে তাদের গাড়ি লক্ষ্য করে আসে। সব লাইট বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। দরজা খুলতে বলে। তাদের কথা না শুনলে তারা গাড়ির জানালা ভেঙে ফেলবে বলে। পরে সবাইকে জিম্মি করে গাড়ি থেকে সবকিছু নিয়ে যায়।
শাহিন জানান, শুরু থেকেই চালকের কর্মকাণ্ড সন্দেহ তৈরি করেছে। তার সঙ্গে ডাকাতদলের কোনো যোগসাজশ আছে কি না তা পুলিশ তদন্ত করছে। পুলিশের কাছে যাওয়ার বিষয়টি শাহিন চালককেও জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ঘটনার পর চালককে ফোনে জানিয়েছি, তাকে যেকোনো সময় পুলিশ ডাকতে পারে। তিনিও সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।’
আকরাম হোসেন শাহিন
যেসব মালামাল লুট করেছে
শাহিনের কাছে থাকা একাধিক লাগেজে দুটি নতুন আইফোন, হবু স্ত্রীর জন্য কেনা প্রায় এক ভরি স্বর্ণালংকার, বিভিন্ন ধরনের কসমেটিকস, ৫০-৬০ হাজার টাকা মূল্যের সৌদি রিয়াল, নতুন জামাকাপড় ও ভিসা লাগানো পাসপোর্ট ছিল। এর সবই নিয়ে গেছে ডাকাতরা।
বিয়ে পিছিয়েছে
শাহিন বলেন, ‘ডাকাতি হওয়ার পর আমার কাছে আর কিছুই নেই। প্রায় তিন বছর ধরে সৌদি আরবে কষ্টের চাকরির টাকা সঞ্চয় করেছিলাম। পরিবারের পছন্দ করা হবু স্ত্রীর জন্য প্রতি মাসে একটা একটা করে জিনিস কিনেছি। কোনো মাসে মোবাইল, কোনো মাসে স্বর্ণালংকার আবার কোনো মাসে কসমেটিকস কিনেছিলাম।
‘এভাবে প্রায় তিন বছরের সঞ্চয় নিয়ে বিয়ে করার উদ্দেশেই দেশে আসি। এখন এই পরিস্থিতিতে হাত একেবারেই খালি। তাই বিয়ে পিছিয়ে গেছে। মেয়েপক্ষের লোকজনও বাড়িতে এসে সমবেদনা জানিয়ে বলে গেছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বিয়ের আয়োজন করবেন। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক কবে হবে সেই আশাতেই আছি।’
নারায়ণগঞ্জ থানার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শেখ বিল্লাল হোসেন নিউজবাংলাকে জানান, ডাকাতির রাতে খবর পাওয়ার পরপরই পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে গাছের গুঁড়ি ও ব্লক সরিয়ে রাস্তা ক্লিয়ার করেছে। সবাই যে যার মতো চলে গেছে, যার কারণে বোঝা যাচ্ছে না, ওই রাতে শুধুই কি সৌদি প্রবাসী যুবকের গাড়িতে ডাকাতি হয়েছে, নাকি অন্যান্য গাড়িতেও ডাকাতি হয়েছে।
ডাকাতদলের সঙ্গে চালকের কোনো সম্পৃক্ততা আছে কি না এমন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মনে হয় না। এটি র্যান্ডমলি হয়েছে।’