ঘরের ভেতর খুন। ছুরিকাঘাত করে মরদেহে আগুন। কিন্তু অস্ত্র মেলেনি, খুনির আঙুলের ছাপ নেই কোথাও। এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, যিনি সন্দেহজনক কাউকে ভবনে ঢুকতে বা বের হতে দেখেছেন। সেই ভবনে নেই কোনো সিসিটিভি ক্যামেরাও।
রাজধানীর কলাবাগানে নিজ ঘরে খুন হওয়া চিকিৎসক কাজী সাবিরা রহমান হত্যার তদন্তে নেমে হয়রান পুলিশ। এমন কোনো একটি পথ খুঁজে পাচ্ছে না তারা, যে পথ ধরে এগোলে হত্যা রহস্যের কূলকিনারা করা যাবে।
এটি আত্মহত্যা নয়, এটা নিশ্চিত। পরিবারের পক্ষ থেকে কাউকে সন্দেহ করা হচ্ছে না। সেই চিকিৎসকের সঙ্গে কারও বিরোধ ছিল, এমন তথ্যও মেলেনি। তাহলে কে বা কারা খুন করবে, এমন প্রশ্নের কোনো জবাবও মিলছে না।
তবে বাসার সিঁড়িতে দুটি সিগারেটের ফিল্টার পাওয়া গেছে। সেটি পরীক্ষা করে যদি কিছু পাওয়া যায়, তাহলে পুলিশ কিছুটা আগাতে পারবে বলে আশা করছে।
তবে কি সোহাগী জাহান তনু, সাগর-রুনিদের হত্যার মতো ডা. সাবিরা হত্যারও কোনো ক্লু মিলবে না?
এই পরিস্থিতিতে পথ খুঁজে না পেয়ে নিহত চিকিৎসকের সহকর্মী, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের ঢালাও জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
সাবিরা যে ফ্ল্যাটে থাকতেন, তার পাশের কক্ষে সাবলেটে থাকা নারী, যিনি ঈদের আগে বাড়িতে গিয়ে ঢাকায় আসেননি, তাকেও ঢাকায় আনা হয়েছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য।
তাতেও এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি যা তদন্ত কর্মকর্তাকে আশান্বিত করতে পারে।
গত ৩১ মে রাজধানীর কলাবাগানের প্রথম লেনের ৫০/১ পাঁচতলা ভবনের তৃতীয় তলার ভাড়া ফ্ল্যাট থেকে চিকিৎসক সাবিরার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ৪৭ বছর বয়সী সাবিরা গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন।
গত ৩১ মে এই রুমটি থেকে চিকিৎসক সাবিরার মরদেহ উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ছবি: নিউজবাংলা
সাবিরা খুনের খবর পেয়ে প্রথমে বাসায় যায় কলাবাগান থানা-পুলিশ। পরে তারা খবর দেয় সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটকে। পরে ঘটনাস্থলে আসেন ডিবি, র্যাব, তদন্ত সংস্থা পিবিআইয়ের সদস্যরা।
খুনের ৩৬ ঘণ্টা পর তার মামাতো ভাই রেজাউল হাসান মজুমদার জুয়েল কলাবাগান থানায় অজ্ঞাতদের আসামি করে মামলা করেন।
তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, সাবিরা রহমান খুন হওয়ার পর কলাবাগান থানা-পুলিশের পাশাপাশি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও র্যাব ছায়া তদন্ত করছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের নিউমার্কেট জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) শরীফ মোহাম্মদ ফারুকুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সাবিরা রহমানের কলিগ, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এই ঢালাও জিজ্ঞাসাবাদে কেউ বাদ যাচ্ছে না। সাবিরার বাসায় সাবলেটে থাকা আরেক নারী নূরজাহানকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। নূরজাহানকে গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।’
সাবিরার বাসার সিঁড়িতে দুটি সিগারেটের ফিল্টার পাওয়া গিয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওই বাসার সিঁড়িতে দুইটা সিগারেটের ফিল্টার পাওয়া গিয়েছিল। ফিল্টার দুটি ডিএনএ স্যাম্পলিংয়ের জন্য ল্যাবে পাঠানো হয়েছিল। যদি কিছু পাওয়া যায়, আলহামদুলিল্লাহ্। তবে এই রিপোর্ট এখনও পাওয়া যায় নাই।’
আপনারা কাকে সন্দেহ করছেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটা বলার সুযোগ নাই। সবাইকেই আমরা সন্দেহ করছি। কিন্তু আমাদের এভিডেন্স তো মিলাতে হবে। তবে এখন পর্যন্ত ক্লু লেস।’
বাংলাদেশে বেশ কিছু আলোচিত হত্যা রহস্যের কূলকিনারা করতে না পারায় সমালোচনার মুখে পড়েছে পুলিশ।
সাবিরা রহমানের কলিগ, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে
ক্লুহীন আরও কিছু ঘটনা
কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু হত্যার পাঁচ বছর পূর্ণ হলো গত ২০ মার্চ। কিন্তু এমন একটি ক্লুও খুঁজে পাওয়া যায়নি, যে পথ ধরে আগানো যাবে।
২০১৬ সালের ২০ মার্চ রাতে তনুর মরদেহ কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের পাওয়ার হাউসের অদূরে একটি ঝোপ থেকে উদ্ধার করা হয়। পরদিন বিকেলে তনুর বাবা কোতোয়ালি মডেল থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন।
শুরুতে পুলিশ, ডিবি ও পরে সিআইডি মামলা তদন্ত করেও কোনো কূলকিনারা পায়নি। সর্বশেষ পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে ২০২০ সালের ২১ অক্টোবর মামলার নথি পিবিআই-ঢাকা কার্যালয়ে হস্তান্তর করা হয়।
এর চেয়ে বেশি আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যা। এই দম্পতি ২০১২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় খুন হন। পরদিন ভোরে তাদের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। সাগর ছিলেন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক ও রুনি ছিলেন এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক।
৯ বছর পার হলেও সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলার কোনো কূলকিনারা করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
ঘটনাস্থলে গিয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করা হবে। ২০১২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েই মহীউদ্দীন খান আলমগীর ১০ অক্টোবরের মধ্যে সাগর-রুনি হত্যারহস্য উদঘাটন হবে বলে আশা করেছিলেন। এরপর ৯ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনে একজনকে ধরতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। পরে সেই ব্যক্তিকে ধরা হয়, কিন্তু ঘটনার রহস্য আর উন্মোচিত হয়নি।
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর প্রথমে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানার পুলিশ ও পরে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) এই মামলার তদন্তভার পায়। দায়িত্ব পাওয়ার পর ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্টে ব্যর্থতা স্বীকার করে ডিবি। এরপর আদালত র্যাবকে মামলার তদন্তের নির্দেশ দেন। সেই থেকে র্যাব মামলাটি তদন্ত করছে। তবে এখনও তারা কোন কূলকিনারা পায়নি।