ময়মনসিংহের ভালুকায় অটোরিকশাচালক শামীমের টাকা হাইওয়ে পুলিশের কেড়ে নেয়ার ঘটনা তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে ঘটনার আড়ালেও ঘটনা রয়েছে।
হাইওয়ে পুলিশের খপ্পরে পড়ার আগেই তিনি তিনজন পুলিশ সদস্যকে ভালুকা থানায় নামিয়ে দিয়ে আসেন। এই পুলিশ সদস্যরা তাকে ১০০ টাকা ভাড়ার জায়গায় দেন ২০০ টাকা।
একই রাতে পুলিশের দুই বিপরীত রূপ দেখেন শামীম। পুলিশের কয়েকজন সদস্যের মহানুভবতা যেমন উচ্ছ্বসিত করে তাকে। ঠিক তেমনি বেদনায় নীল করে দেয় আরেকদল পুলিশের রূঢ় আচরণ।
ওই অটোরিকশাচালকের পুরো নাম আফছর আলী শামীম। তিনি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার ২ নম্বর পুটিজানা ইউনিয়নের গাড়াজান পণ্ডিতবাড়ী এলাকার ছেলে।
স্ত্রী আর তিন মেয়েকে নিয়ে থাকেন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা বাজারে। প্রতি রাতে অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।
ওই রাতের পুরো ঘটনা জানতে নিউজবাংলার প্রতিবেদক ভুক্তভুগী অটোরিকশাচালক শামীমের সঙ্গে যোগাযোগ করলে জানা যায় তার আনন্দ আর যন্ত্রণার পূর্বাপর গল্প।
শামীম বলেন, ‘রোজা রাইখ্যা দিনের বেলা গাড়ি (রিকশা) চালাইলে অনেক কষ্ট অয়। এর লাইগ্যা রাইতের বেলা অটো চালাই। রাইতে ৬০০-৮০০ ট্যাহা কামায়্যা সেহরির আগে বাড়িতে আয়্যা পড়ি। এই ট্যাহা তিন মাইয়্যার পড়া, অটোর কিস্তি আর সংসারে খরচ করি।’
তিনি বলেন, ‘সেই দিন রাইতেও অটো লইয়্যা বাইর অইছিলাম। ভালুকার সিডস্টোরে তিন যাত্রী অটোতে উইঠ্যা কইল তারা ভালুকায় রিজার্ভ যাইব। অটো চালাইয়্যা কিছুদূর যাওয়ার পর একটা হোন্ডাতে এক লোক বইস্যা ছিল।
‘তহন আমার অটোর যাত্রী কইল গাড়ি থামাইতে। একজন গাড়িততে নাইম্ম্যা হোন্ডার লগে গেছে গা। আর দুইজনরে ভালুকা থানার মোড়ে নামাই দেই। তারার আলাফ শুইন্যা বুঝবার পারলাম তারা থানার পুলিশ। তারা আমারে ১০০ ট্যাহার ভাড়া ২০০ ট্যাহা দিলো। মনে হইলে পুলিশ অনেক ভালা।’
এবার ভারাক্রান্ত হৃদয়ে শামীম বলেন, ‘ইউটার্ন দিয়া গাড়িডা ঘুরায়্যা যাইবার সময় হাইওয়ে চেকপোস্টের সামনে আমারে আটকাইয়্যা দেয় হাইওয়ে পুলিশ। মনে মনে ভাবছি আল্লায় জানে এইবার কী অয়।
‘একজন পুলিশ অফিসার আইয়্যা আমার গাড়ির চাবি টাইন্না লইয়্যা যায়। বহু অনুনয়-বিনয় কইরা হাত জোড় কইরা কান্নাকাটি করলাম। তবুও চাবিডা দিল না। ওই দিনের সারাদিনের আয় ৬০০ ট্যাহা কাইড়া নিয়া গাড়ির চাবি ফেরত দেয়।
‘এই ট্যাহা দিয়া আমি অটোর কিস্তি মাসে ১৬ হাজার ৫০০ ট্যাহা দেই। মেয়েদের পড়ালেহা আর সংসার চলে। তহন মনডা ভীষণ খারাপ অয়্যা গেলো। তবুও তো আমি নিরুপায়!’
শামীম বলে যান, ‘ভালুকার সিডস্টোর বাসস্ট্যান্ডে এক চা-পান বিক্রেতা আমার অনেক দিনের পরিচিত। কাকু বইল্যা ডাহি। কষ্টের কথাডা কাকুরেই জানাইলাম। তহন আমার কষ্টে কাকুর মনও খারাপ অয়্যা যায়।
‘পরের দিন রাইতে আবার গাড়ি লইয়্যা বাইর অইছি। রাইতে দেড়টার দিকে চা-সিগারেট খেতে কাকুর দোকানে যাই। তহন ভালুকা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদের গাড়ি লইয়্যা চালক আইতে দেরি করায় তিনি তহন দাঁড়াইয়্যা আছিন।’
এই জনপ্রতিনিধি পুরো কাহিনি শুনে ফেসবুকে তা লিখেন। আর এতে টনক নড়ে পুলিশ সদরদপ্তরের। বরখাস্ত করা হয় ভালুকা ভরাডোবা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির এটিএসআই আবু তাহের, নায়েব হাবিবুর রহমান ও কনস্টেবল রেজাউল করিমকে।
এই তিন পুলিশকে গাজীপুর হাইওয়ে পুলিশের মাঠ পর্যায়ের সব কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দিয়ে হাইওয়ে পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়েছে।
বরখাস্তকালীন সময়ে তারা পুলিশ লাইনসে উপস্থিত থেকে নিয়মিত রোল কলে হাজিরা দেবেন এবং এই সময়ে তারা কেবল খোরপোশ ভাতা পাবেন।
শামীম বলেন, ‘চেয়ারম্যান কইল, অটোরিকশাটি কার? আমি কইলাম আমার, কইলাম কোথাও যাবেন? তিনি না করলেন। তিনি জানবার চাইল, রাতে গাড়িতে প্যাসেনজার পাও? কইলাম, পাই।
‘হঠাৎ কইরা কাকু চেয়ারম্যানরে কইল, কাইল রাইতে এই অটোরিকশাচালকটার সব ট্যাহা হুদাই কাইড়া নিছে হাইওয়ে পুলিশ। তহন চেয়ারম্যান একটু কাগজে আমার ঠিকানা আর মোবাইল নম্বর লেইখ্যা নিছে।
‘এই ঘটনা লেইখ্যা ফেসবুকে ছাইড়া দিসে চেয়ারম্যান। পরে হুনছি মানুষজন হাইওয়ে পুলিশরে অনেক সমালোচনা করতাছে’- তার কাহিনি নিয়ে তোলপাড়ের কথা শুনেছেন শামীম নিজেও।
হাইওয়ে পুলিশের তিন সদস্যকে বরখাস্তের আদেশে সন্তুষ্ট কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘হাইওয়ে পুলিশ সবসময় বিভিন্ন গাড়ির চালকদের কাছ থাইক্যা চাঁদা নিতাছে। আমার মনে কইতাছে এমন ঘটনায় আমিই প্রথম বিচার পাইলাম। চাঁদাবাজ পুলিশকে বরখাস্ত করায় আমি সন্তুষ্ট।’
এমন ঘটনা আছে আরও
চালকদের তথ্য বলছে, শামীমের মতো আরও অনেকেই ভালুকায় হাইওয়ে পুলিশের চাঁদাবাজির শিকার।
গাড়ি থামার সিগন্যাল দিলেই টাকা দিতে হয়। না দিলেই টুকে দেয়া হয় মামলা। টাকা আদায় করা হয় রীতিমতো দরাদরি করে টাকা আদায় করতে হয।
করোনার কারণে দূরপাল্লার গণপরিবহন বন্ধ থাকায় চাপ বেড়েছে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে। এতে আরও বেশি বেপরোয়া ভালুকা হাইওয়ে পুলিশ।
ভালুকা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘প্রতিনিয়ত হাইওয়ে পুলিশের চাঁদাবাজিসহ মামলা দিয়ে হয়রানি চলছেই। হয়ত এ ঘটনার পর কয়েকদিন চাঁদাবাজি বন্ধ থাকবে। তবে আবারও রমরমা হবে চাঁদাবাজি। হাইওয়েতে পুলিশের চাঁদাবাজি বন্ধ করা প্রয়োজন।’
গাজীপুর হাইওয়ে পুলিশ সুপার আলী আহম্মদ খান বলেন, ‘তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রাথমিক তদন্ত করে তিন পুলিশকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বিস্তারিত তদন্তের প্রতিবেদন শেষে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’