২০১৬ সালের ৫ জুন। চট্টগ্রামে সকালে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় মাহমুদা খাতুন মিতুকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। মিতুর স্বামী চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তখনকার অতিরিক্ত উপ-কমিশনার বাবুল আকতার সে সময় ঢাকায় ছিলেন।
ঘটনার পরপরই চট্টগ্রামে গিয়ে পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন বাবুল আক্তার। অভিযোগ ছিল, জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমের জন্য তার স্ত্রীকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে।
মিতু হত্যার পর বাবুলের ‘আহাজারির’ ছবি সে সময় গোটা দেশকে নাড়া দেয়। স্ত্রী হত্যার বিচারের দাবি জোর গলায় তুলেছিলেন বাবুল। এমনকি মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেনও প্রথম দিকে জামাতাকে রেখেছিলেন সন্দেহের তালিকার বাইরে।
ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যে মিতু হত্যায় বাবুলের জড়িত থাকার গুঞ্জন ডালপালা মেলতে থাকে। তবে তখনও মোশাররফ হোসেন সংবাদ মাধ্যমে দাবি করেন, বাবুল আকতার নির্দোষ।
তবে কিছু দিনের মধ্যে বদলে যেতে থাকে এই চিত্র। মিতু হত্যার প্রায় তিন সপ্তাহ পর ২০১৬ সালের ২৪ জুন খিলগাঁওয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবুল আকতারকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে প্রায় ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপরেই ছড়িয়ে পড়ে, বাবুলকে পুলিশ বাহিনী থেকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে।
এর দেড় মাস পর বাবুল আকতার ৯ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের আবেদন করেন। তবে সেই আবেদন গ্রহণ করা হয়নি। এরপর ৬ সেপ্টেম্বর বাবুলকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বাবুলকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়ার পর মিতুর বাবা-মাও তার দিকে অভিযোগের আঙুল তুলতে শুরু করেন। তবে এ বিষয়ে পুলিশ ছিল প্রায় নিশ্চুপ। এরপর আদালতের নির্দেশনায় গত বছর এ মামলার দায়িত্ব ডিবির কাছ থেকে বুঝে নেয় পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
প্রায় দেড় বছরের চেষ্টায় নতুন ক্লু পেয়ে মামলার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে পিবিআই। মিতু হত্যা মামলার বাদী বাবুলই এখন নতুন করে হওয়া মামলার মূল আসামি।
চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় বুধবার নতুন করে হত্যা মামলা করেন মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন। এতে বাবুলকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে পাঁচ দিনের রিমান্ডে পেয়েছে পিবিআই।
দুই সন্তান ও মিতুর সঙ্গে বাবুল। ফাইল ছবিমিতু হত্যায় সরাসরি অংশ নেন বাবুলের সোর্স
মাহমুদা খানম মিতু হত্যায় অংশ নিয়েছিলেন তার স্বামী বাবুল আকতারেরই সোর্স কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা। পুলিশের তদন্তের সময় সেই সোর্সকে বাবুল আড়ালে রাখার চেষ্টা করেন।
পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বুধবার সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ‘মিতু হত্যার পর উদ্ধার হওয়া ভিডিও ফুটেজ আমরা একজনকে দেখেছিলাম তার নাম কামরুল ইসলাম মুসা। মুসা এখনও নিখোঁজ। আমরা জেনেছি মুসা নিয়মিত বাবুল আকতারের বাসায় যাতায়াত করতেন। বাবুলের বাসায় মুসা বাজারও করে দিতেন। মুসাকে শুধু বাবুল আকতারই চিনতেন।’
বনজ কুমার বলেন, ‘ভিডিও ফুটেজে স্পষ্ট এই মুসাকে চেনা গেছে, কিন্তু তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদে বাবুল আকতার মুসাকে চেনেন না বলে জানিয়েছিলেন। সেখান থেকে সন্দেহ হলে বিশদ তদন্ত শুরু করে পিবিআই। পরে আমরা তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে নিশ্চিত হই, বাবুল ইচ্ছাকৃতভাবে তার ব্যক্তিগত সোর্স মুসাকে সন্দেহ করেনি বা সন্দেহজনক বলে পুলিশকে জানাননি।’
এর পাশাপাশি বাবুলের দুই বন্ধু মিতু হত্যায় বাবুলের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তারা হলেন গাজী আল মামুন ও সাইফুল হক।
এ বিষয়ে বনজ কুমার বলেন, ‘নড়াইলে এক লোককে আমরা পর্যবেক্ষণে নিই। তার নাম গাজী আল মামুন, তিনি বাবুলের বন্ধু। অপর বন্ধু সাইফুল হককেও পিবিআই ডাকে। তারা সাক্ষী হিসেবে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। তদন্তের স্বার্থে আমরা বাবুল আকতারকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলাম। তিনি কিছু প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারেননি। বিষয়গুলো আইজিপি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানানো হলে তারা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বলেন।’
মামলার তদন্ত সম্পর্কে বনজ কুমার বলেন, ‘প্রথমে বাবুল আকতারের সম্পৃক্ততা আসেনি। এরপর কিছু নতুন প্রশ্ন আসে। সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে মামলা ভিন্ন দিকে মোড় নেয়।’
বনজ কুমার বলেন, ‘মিতু হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন আগে জঙ্গি কার্যক্রমে আহত হন বলে দাবি করেন বাবুল। আমরা সেটিই বিশ্বাস করেছি। আবার স্ত্রী মিতু নিহত হওয়ার পর যে তার আচরণ, তা ছিল সবচেয়ে আপনজন হারানোর মতো। তাই তার কথা সবাই বিশ্বাস করেছিল। তবে বিশদ তদন্তে সোর্স মুসার ক্লুটি আমাদের তদন্তের মেরিট পরিবর্তন করে দেয়।’