নারায়ণগঞ্জের সেই ভয়ংকর সাত খুনের সাত বছর আজ। ওই নৃশংস ঘটনার কথা মনে করে আজও শিউরে ওঠে মানুষ। আর স্বজন হারানোর বেদনায় ডুকরে কেঁদে ওঠা পরিবারগুলো কান পেতে অপেক্ষায় আছে বিচারের শেষ রায় শোনার। বিচারিক আদালত, হাইকোর্টের পর বিচারের শেষ রায় এখন ঝুলে আছে আপিল বিভাগে।
মাস্টার মাইন্ড নূর হোসেন ও র্যাব-১১-এর তখনকার সিও-এর পৈশাচিক ওই ঘটনায় তোলপাড় হয় সারা দেশ। সাত বছরেও বিচার না পাওয়ায় স্বজনরা হতাশায় ডুবছে। তাদের একটাই জিজ্ঞাসা, বিচার শেষ হবে কবে?
নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের স্ত্রী বিউটি বেগম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সাত বছর হয়ে গেলেও শেষ রায় হলো না। আমরা রায় কার্যকরের অপেক্ষায় আছি। বিচারিক আদালত ও হাইকোর্ট এ হত্যাকাণ্ডের রায় দ্রুত দিয়েছিল, কিন্ত আপিল বিভাগে রায় না হওয়ায় আমরা হতাশায় আছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এলাকার অনেকে বলে বেড়ায় নূর হোসেন ফিরে আসবে। তাদের এসব কথা শুনলে আতঙ্ক লাগে। নূর হোসেনের বিচার চাই। সে যেভাবে মানুষগুলোকে অত্যাচার করে মেরেছে তার শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। ৭ খুনের বিচারের বিচারের রায় কার্যকরের অপেক্ষোয় আছি আমরা সাতটি পরিবার।’
নিহত তাজুল ইসলামের বাবা বলেন, ‘সাত বছর ধরে অনেক দুঃখ-যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছি। আমার সংসারে ছেলেটাই ছিল উপার্জনক্ষম। তাকে হত্যার পর থেকে তার মা অসুস্থ হয়ে বাড়িতে পড়ে আছে। তার ইচ্ছে ছেলে হত্যার বিচার দেখে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করবে। কিন্তু এখনও রায় কার্যকর হয়নি। দেশে করোনা পরিস্থিতির কারণে হয়তো কার্যক্রম হচ্ছে না। আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ করব আপিল বিভাগে মামলার শুনানি যেন দ্রুত করা হয়।’
সাত খুনের ঘটনায় নিহত গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী নুপুর আক্তার বলেন, ‘আমার মেয়ের বয়স এখন সাত বছর। জন্মের আগেই তার বাবাকে খুন করা হয়েছে। এখনও খুনিদের শাস্তি হয়নি। সাত বছরে আমাদের কেউ সহযোগিতা করেনি। যার স্বামী নেই, তার কাছে কিছুই নেই। তবু শেষ বিচারের রায় শোনার অপেক্ষায় আছি।’
আলোচিত ওই হত্যাকাণ্ডের দুইটি মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেন খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শুরু থেকে একটি পক্ষ এ মামলার কার্যক্রম বিলম্ব করতে চেয়েছে। কিন্তু বিচারিক আদালত দ্রুত মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ করেছে। হাইকোর্টেও মামলার রায় হয়েছে কিন্তু আপিল বিভাগে মামলার কার্যক্রম বিলম্ব হচ্ছে। আমি মনে করি, রাষ্ট্রপক্ষ গুরুত্ব দিলে আপিল বিভাগে দ্রুত মামলার শুনানি হতে পারে। এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায়ের অপেক্ষা করছে সারা দেশের মানুষ।’
সাত খুনের পূর্বাপর
মামলার বিবরণে বলা হয়, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুরে আদালত থেকে প্রাইভেট কারে বাড়ি ফিরছিলেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন ও গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম। পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের খানসাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের সামনে থেকে সাদাপোশাক পরা র্যাব সদস্যরা তাদের অপহরণ করে। আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহীম পেছন থেকে এ চিত্র মুঠোফোনে ভিডিও করলে ওই র্যাব সদস্যরা তাদেরও ধরে নিয়ে যায়। তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীর শান্তির নগর এলাকা থেকে সাতজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
মরদেহগুলো হাত-পা বাঁধা ছিল, পেটে ছিল ফাঁড়া। ১২টি করে ইটভর্তি সিমেন্টের দুইটি করে বস্তা বেঁধে দেয়া হয় প্রতিটি মরদেহের সঙ্গে। মরদেহগুলোর মুখ ছিল ডবল পলিথিন দিয়ে মোড়ানো।
এ ঘটনায় ওই রাতে নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের স্ত্রী বিউটি বেগম মামলা করেন। পরে আরেকটি মামলা করেন আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল।
এ দুই মামলায় নূর হোসেনসহ র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
প্রায় এক বছর পর ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল নূর হোসেন, র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুইটি মামলায় নূর হোসেনসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। ১২৭ সাক্ষীর মধ্যে ১০৬ জন সাক্ষ্য দেয় আদালতে।
২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি সকালে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন আলোচিত ৭ খুন মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে নূর হোসেন, র্যাবের চাকরিচ্যুত অধিনায়ক লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, উপ-অধিনায়ক মেজর (অব.) আরিফ হোসেন ও ক্যাম্প ইনচার্জ লে. কমান্ডার (অব.) এম এম রানাসহ ২৬ জনের ফাঁসির আদেশ দেয় আদালত। বাকি ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়।
পরে মামলাটি যায় হাইকোর্টে। ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট নূর হোসেন ও র্যাব-১১-এর সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখার আদেশ দেয় হাইকোর্ট। অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়। সব শেষ আপিল বিভাগে রয়েছে মামলাটি।