সঙ্গীনিকে নিয়ে রিসোর্টে সময় কাটিয়ে স্ত্রীর সাহচর্য থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন হেফাজত নেতা মামুনুল হক।
৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের রিসোর্ট-কাণ্ড মোহাম্মদপুরের কাদেরাবাদ হাউজিংয়ের বাসায় বসে ফেসবুক লাইভে দেখেন মামুনুলের স্ত্রী আমিনা তাইয়্যেবা। রিপোর্টের সঙ্গীনি জান্নাত আরা ঝর্ণাকে তার নামে পরিচয় করিয়ে হেফাজত নেতার মিথ্যা সেদিনই ধরা পড়েছে তার কাছে।
ওই বিকেলেই সেই বাসা ছেড়ে চার সন্তানকে নিয়ে বের হয়ে যান তিনি। পাঁচ দিন তার কোনো খোঁজই ছিল না। বৃহস্পতিবার তিনি দুই সন্তানকে নিয়ে বাসায় আসেন, তবে সামান্য সময়ের জন্য। জরুরি কিছু কাজ সেরে কিছুক্ষণ পরেই আবার বের হয়ে যান।
রিসোর্ট-কাণ্ডে মামুনুলের সংসারে এই ‘অশান্তি’ নিয়ে এর আগেও সংবাদ প্রকাশ হয়েছে গণমাধ্যমে। ফেসবুক লাইভে এসে স্ত্রীর কাছে ‘সীমিত’ সত্য গোপনে কথিত ধর্মীয় অধিকার নিয়ে বক্তব্য রেখে তুমুল সমালোচিত হলেও স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি।
ঘটনার আট দিনের মাথায় মামুনুলের সেই বাসায় গিয়ে ফটক ভেতর থেকে তালাবদ্ধ অবস্থাতেই দেখা যায়।
কাদেরাবাদ হাউজিংয়ের এক নম্বর সড়কের সাত নম্বর বাড়িটির ফটকে বেশ কয়েকবার ডাকাডাকি করলে বেশ খানিকটা পরে আসেন নিরাপত্তারক্ষী ইকবাল হোসেন।
-‘ভাবি (মামুনুল হকের স্ত্রী) যে চলে গিয়েছিলেন, তিনি কি ফিরেছেন?’
এমন প্রশ্ন করলে ইকবাল বলেন, ‘দুই দিন আগে আসছিল।’
-দুই দিন আগে বলতে?
-‘বৃহস্পতিবার।’
-সঙ্গে কি ছেলেরা ছিল?
-‘দুই ছেলে সঙ্গে ছিল।’
-তারপরে কী হয়েছে? উনি কি এখন আছেন বাসায়?
-‘না, সেই দিনই চলে গেছে।’
-চলে যাওয়ার সময় কি জিনিসপত্র নিয়ে গেছেন?
-‘আমি দেখি নাই।’
-উনি কোথায় গেছেন, বলে গেছেন?
-‘না, এইটা বলতে পারি না।’
-কোথা থেকে এসেছেন, সেটা কি বলেছেন?
-‘না, সেটাও বলেনি।’
মামুনুল হক সেই ঘটনার পর বাসায় ফিরেছেন কি না, এমন প্রশ্নে মামুনুলের বাড়ির দারোয়ান ইকবাল হোসেন বলেন, ‘না, ফিরেনি।’
তার সঙ্গে কথা বলার সময় ভেতর থেকে কেউ একজন চিৎকার করছিলেন, ‘কে আসছে কে আসছে।’
এই চিৎকার শুনে দারোয়ান ভেতরে চলে যান।
৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের রিসোর্টে জান্নাত আরা ঝর্ণাকে নিয়ে অবরুদ্ধ হওয়ার পর থেকে এই বাড়িটিতে মামুনুল হকের অনুসারী ও স্বজনরা নিরাপত্তা বাড়িয়েছেন। গণমাধ্যমকর্মীরা সেখানে গেলে তাদের সঙ্গে কথা না বলে ‘এখান থেকে চলে যান’- এই জাতীয় কথাবার্তা বলছেন।
নিউজবাংলার দুই কর্মী গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর বাসাটিতে গেলে মামুনুল হকের ভাগনে পরিচয় দিয়ে একজন দুইজনের পরিচয়পত্র দেখতে চান। পরিচয়পত্র নিয়ে ফটকের ভেতরে গিয়ে কিছুক্ষণ পরে এসে বলেন, ‘এ বিষয়ে কেউ কথা বলবে না। আপনারা চলে যান। এখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন না।’
এর মধ্যে মামুনুলের আরও একজন প্রেমিকার তথ্য গণমাধ্যমে আসার পর তিনি সেই মেয়ের ভাইকে ডেকে তাকেও গোপনে বিয়ের কথা জানিয়েছেন। এ বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেছেন ওই নারীর ভাই।
সেদিনই বাসা ছাড়েন তাইয়্যেবা
৩ এপ্রিল রিসোর্টে যাওয়ার দিন সকালে মামুনুল এই বাসা থেকে বের হন একা।
ফেসবুকে রিসোর্ট-কাণ্ডের লাইভ শুরু হওয়ার পর তার ছেলেদের নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যান তার স্ত্রী।
ঝর্ণার নাম, ঠিকানা, বাবার নামের বিষয়ে মামুনুল যে অসত্য বলেছিলেন, সে বিষয়ে হেফাজত নেতা পরে বলেছেন, ভয় পাওয়ার কথা।
তবে তার প্রকৃত স্ত্রী আমিনা তাইয়্যেবার সম্পর্কে পরিপূর্ণ তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। যদিও এর আগে মামুনুল একটি ওয়াজে বলেছিলেন, তার স্ত্রী একজন সেনা কর্মকর্তার মেয়ে।
তাইয়্যেবার বাবার বাড়ি কোথায়, ঢাকায় তাদের অবস্থান আছে কি না, এই কয় দিন তিনি সেখানেই আছেন নাকি অন্য কোথাও গেছেন, এ বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।
মামুনুল গত শুক্রবার গভীর রাতে ফেসবুক লাইভে এসে ঝর্ণার অবস্থান কেরানীগঞ্জের ঘাটারচরে জানালেও তাইয়্যেবার অবস্থান কোথায় সেটি জানাননি।
মামুনুল হকের বড় ভাই হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির ও কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারাসিল আরাবিয়ার মহাসচিব মাহফুজুল হকের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি কল ধরেননি।
রিসোর্টে যা হয়েছে, ফোনালাপে যা জানা গেছে
রিসোর্টে মামুনুল যে ঝর্ণাকে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেটি প্রথমে জানা যায়নি। তিনি নিবন্ধন বইয়ে সঙ্গীনির নাম লেখেন আমিনা তাইয়্যেবা। স্থানীয়রা অবরুদ্ধ করার পরও এই নামই বলেন। দাবি করেন তার শ্বশুরের নাম জাহিদুল ইসলাম, বাড়ি খুলনায়।
তবে সেদিন পুলিশকে ঝর্ণা তার নাম জানিয়ে বলেন বাড়ি ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায়, বাবার নাম অলিয়র রহমান। পরে তার বক্তব্যের সত্যতাও পাওয়া যায়।
রিসোর্ট থেকে হেফাজত কর্মীরা ছিনিয়ে আনার পর মামুনুল ও ঝর্ণা ফেরেন আলাদা গাড়িতে। তবে ঝর্ণা কোথায়া যাচ্ছেন, সেটি তার জানা ছিল না। এটি পরে ফাঁস হওয়া একটি টেলিফোনালাপে জানা গেছে।
সেই রাতে মামুনুল হক তার চার ভাইকে নিয়ে ফেসবুক লাইভে এসে দাবি করেন, ঝর্ণা জনৈক শহীদুল ইসলামের স্ত্রী ছিলেন। আড়াই বছর আগে তার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর তারা বিয়ে করেন।
এরপর মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া মাদ্রাসায় জরুরি বৈঠক করে হেফাজত নেতারা এই কথিত বিয়েকে ‘বৈধ’ বলে ঘোষণা দেন।
তবে মামুনুলের দাবির সত্যতা নিয়ে যেসব প্রশ্ন উঠেছে, সেগুলোর বিষয়ে হেফাজতে ইসলামের নেতারা বা মামুনুলের ভাইরা কোনো জবাব দেননি।
সোনারগাঁয়ের রিসোর্ট-কাণ্ডের পরেই মামুনুল সেখান থেকে তার স্ত্রী আমিনা তাইয়্যেবাকে ফোন করে যেসব কথা বলেছেন, তা ফাঁস হয়ে গেছে ফেসবুকে। সে সময় অবশ্য এই ফোনালাপের সত্যতা বিষয়ে কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছিলেন না। পরে মামুনুল ফেসবুক লাইভে এসে কার্যত সত্যতা স্বীকার করে নেন।
ফোনালাপে তাইয়্যেবাকে বলেন, ‘পুরা বিষয়টা আমি তোমাকে সামনে আইসা বলব।…এই মহিলা যে ছিল সাথে সে আমাদের শহীদুল ইসলাম ভাইয়ের ওয়াইফ। বুঝছ? তুমি একটা ওখানে অবস্থা এমন তৈরি হয়ে গেছে ওখানে ওই কথা বলা ছাড়া ওখানে ওরা ই করে ফেলছিল আমাকে, বুঝছ?’
পরে আরেকটি কথোপকথন ফাঁস হয়, যা ছিল ঝর্ণা ও মামুনুলের মধ্যকার। সেখানে ঝর্ণা জানান, তিনি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তার মায়ের একটি বন্ধ মোবাইল নম্বর দিয়েছেন। আর অন্য একজন যখন তাকে কোথায় বিয়ে হয়েছে জিজ্ঞেস করেছে, তখন তিনি বলেছেন, এটা জানেন না। মামুনুলের সঙ্গে কথা বলে নেবেন।
আরও একটি কথোপকথন ফাঁস হয় যা হয়েছিল মামুনুলের বোন ও তাইয়্যেবার মধ্যে। মামুনুলের বোন ভাবিকে বলেন, কেউ যদি তাকে ফোন করে, তাহলে যেন বলেন, তিনি বিয়ের অনুমতি দিয়েছেন এবং তার শাশুড়ি এই বিয়ের আয়োজন করেছেন।
এরই মধ্যে মামুনুলের রিসোর্টের সঙ্গীনির বড় ছেলে ফেসবুক লাইভে এসে মামুনুলের বিরুদ্ধে কথা বলেন। তিনি তার মায়ের সঙ্গে বাবার সংসার ভাঙার জন্য মামুনুলকে দায়ী করেন।
মামুনুল গত শনিবার ফেসবুক লাইভে এসে বলেন, তার সঙ্গে তার স্ত্রীদের এবং স্বজনদের মধ্যকার ফোনালাপ ফাঁস করে তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার ভঙ্গ হয়েছে। তিনি এ নিয়ে মামলা করবেন।
তাইয়্যেবার কাছে অসত্য তথ্য দেয়ার যুক্তি দেখিয়ে তিনি দাবি করেন, ইসলামে স্ত্রীদের সঙ্গে সীমিত পরিসরে সত্য গোপন করার সুযোগ রয়েছে।
ঝর্ণা কোথায়
সেই রাতের ঘটনাপ্রবাহের পর ঝর্ণাকে আর পাওয়া যায়নি। তিনি ঢাকার নর্থ সার্কুলার রোডে যে বাসায় সাবলেট থাকতেন, সেখানে তিনি ফেরেননি।
গত শুক্রবার রাতে মামুনুল ফেসবুক লাইভে এসে জানান, ঝর্ণা কেরানীগঞ্জের ঘাটারচরে একটি মাদ্রাসার পেছনে জনৈক হাজি সাহেবের বাসায় আছেন। সেখানে তিনি নিরাপত্তাহীনতায় আছেন। সরকার যেন তার নিরাপত্তায় ব্যবস্থা নেয়।
ঝর্ণার বড় ছেলে আবদুর রহমান তার নর্থ সার্কুলার রোডের সেই বাসায় গিয়ে মাকে পাননি। পরে শনিবার রাতে ঢাকার পল্টন থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন।
জিডির তদন্ত করছেন পল্টন থানার এসআই মঞ্জুরুল হাসান খান। ঝর্ণার কোনো সন্ধান পাওয়া গেছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাকে (ঝর্ণা) পাওয়া যাচ্ছে না এভাবে জিডিতে উল্লেখ করেন নাই। তার বাসায় যে তিনটি ডায়েরি পাওয়া গেছে সেগুলোর ব্যাপারে বলা হয়েছে।
বলা হয়েছে কয়েক দিন ধরে ঝর্ণার সঙ্গে তার ছেলের যোগাযোগ হচ্ছে না। ছেলে সাধারণ জিডিতে তার মা এবং নিজের জীবনের নিরাপত্তা চেয়েছেন।
এ বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, জানতে চাইলে মঞ্জুরুল আর কিছু না বলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ জানান।
পরে পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিকের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
মামুনুল কোথায়?
মামুনুল হক গত দুটি ফেসবুক লাইভ করেছেন মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া মাদ্রাসা থেকে। এখানেই তিনি শিক্ষকতা করেন। মাদ্রাসাটি তার বাসার কাছেই।
বাসা ছেড়ে মাদ্রাসায় অবস্থানের কারণ জানতে শনিবার মাদ্রাসাটিতে গেলেও হেফাজত নেতার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
মাদ্রাসার একজনের সঙ্গে কথা বলতে গেলে পরিচয় জানতে চান তিনি। পরিচয় দিলে তিনি উঠে চলে যান। যাওয়ার সময় বলেন, ‘মাদ্রাসায় হুজুর আছে কি না, আমি জানি না।’
অবশ্য রোববার মোহাম্মদপুর থানায় করা সাধারণ ডায়েরিতে কথিত তৃতীয় স্ত্রীর ভাই মো. শাহজাহান জানিয়েছেন, শনিবার তাকে মামুনুল এই মাদ্রাসাতেই ডেকে নেন। দাবি করেন, তিনি তার বোনকে বিয়ে করেছেন।