সুনামগঞ্জের শাল্লার নোয়াগাঁওয়ের মনমোহন দাসের ভাঙা ঘরে লেগেছে নতুন টিন। সূর্যের আলোয় ঝলমলিয়ে উঠছিল সেটি।
মনমোহন দাসের চোখেমুখে তবু রাজ্যের আঁধার। সঙ্গে চাপা ক্ষোভ আর আতঙ্ক।
এই গ্রামে ১৭ মার্চ তাণ্ডব চালিয়েছে আশপাশের গ্রামের হাজারও লোক। ভেঙে দেয়া হয়েছিল ৮৭টি হিন্দুবাড়ি। এর মধ্যে একটি মনমোহনের। তিনি বলেন, ‘এটা কী হলো? এ রকম তো কোনো দিন স্বপ্নেও ভাবিনি। হিন্দু-মুসলমান মিলে কত যুগ ধরে আমরা একসঙ্গে বসবাস করে আসছি। কোনো বিভেদ ছিল না। অথচ আজ কী হলো?’
তিনি তবু বাড়িতেই আছেন। তবে বাড়ি ফিরতে এখনও ভয় পান কেয়া চৌধুরী। মনমোহনের পাশের ঘরের রঞ্জনা চৌধুরীর মেয়ে তিনি। পড়েন সুনামগঞ্জ কলেজে।
যেদিন হামলা হয়, সেদিন দুপুরে ভয়ে তাকে সুনামগঞ্জ শহরে মামার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন রঞ্জনা। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে এখন বাড়ি আসতে চায় না। বাড়ি ফিরতে ভয় পায়। কেবল বলে, তারা যদি আবার আসে।’
মনমোহন দাসের ভাঙা ঘরে লেগেছে নতুন টিন। ছবি: নিউজবাংলা
হামলার দিন গ্রাম ছেড়ে বোনের বাড়ি চলে যান শাল্লা কলেজ থেকে এ বছর এইচএসসি পাস করা পান্না রানী দাস। তিনিও ভয়ে বাড়ি ফিরতে চাচ্ছেন না বলে জানালেন তার বড় বোন সোনালী রানী দাস।
এই গ্রামেরই মায়া দেবীর ছেলে অয়ন। নোয়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। হামলার পর থেকে প্রতি রাতে ঘুমের মধ্যেই ভয়ে কেঁদে ওঠে সে। ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে ওঠে বলে, ‘মা, এরা আবার আইছে।’
ছেলের এমন কান্নায় ভয় পেয়ে যান মা মায়াও। ছেলেকে সান্ত্বনা দেন। তারপর বুকে জড়িয়ে রাখেন।
বুধবার নোয়াগাঁও গ্রামে গিয়ে কথা হয় তাদের সঙ্গে।
সারা দেশ যখন ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালনে ব্যস্ত, সেদিন সকালে নোয়াগাঁও গ্রামে মিছিল নিয়ে এসে হামলা চালায় কয়েক হাজার সশস্ত্র লোক। তারা আসে আশপাশের গ্রামগুলো থেকে, মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে।
হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হকের সমালোচনা করে এক যুবকের স্ট্যাটাসের জের ধরে এই হামলা চালানো হয়। হিন্দুধর্মাবলম্বী যে যুবক ওই স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন তার বাড়ি নোয়াগাঁওয়ে।
আগের রাতেই হামলার ভয়ে ঝুমন দাশ নামের ওই যুবককে পুলিশের হাতে তুলে দেন গ্রামবাসী। তবু সেই আক্রোশে ভেঙে দেয়া হয় গ্রামের অন্তত ৮৭টি হিন্দুবাড়ি। ভাঙচুরের পর প্রতিটি বাড়ি থেকে লুট করে নেয়া হয় মূল্যবান জিনিসপত্র। ভাঙচুর করা হয় সাতটি মন্দির।
এই গ্রামের হিন্দুদের ৮৭টি বাড়িঘর ভেঙে দেয়া হয়। ছবি: নিউজবাংলা
হামলার পর থেকে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা প্রতিদিনই পরিদর্শনে যাচ্ছেন সেখানে। তারা গ্রামবাসীর প্রতি জানাচ্ছেন সহমর্মিতা, জোগাচ্ছেন সাহস। তবু ভয় কাটছে না গ্রামবাসীর।
নোয়াগাঁও গ্রামে যাওয়ার পর গ্রামবাসীরা রীতিমতো টানাটানি শুরু করে দেন। প্রথমে তারা ভাবেন আগন্তুকেরা সরকারি সংস্থার কেউ হয়তো। অনেকে ভাবেন, সহায়তা এসেছে বোধ হয়।
হামলায় নিজেদের ক্ষয়ক্ষতির চিহ্নগুলো দেখাতে শুরু করেন সবাই। কেউ নিয়ে আসেন নিজেদের ক্ষতবিক্ষত হাঁড়িপাতিল। কেউবা দেখান ভেঙে চুরমার হওয়া বাদ্যযন্ত্র।
গ্রামের পুরোহিত অসীম চক্রবর্তী নিয়ে যান টিনের একটি ছোট্ট ঘরে। গ্রামবাসীর কাছে এটি ‘বিপদনাশিনী মন্দির’। হামলাকারীরা মন্দিরের মূর্তিগুলো চুরমার করে দিয়েছে।
এই গ্রামেই বাড়ি স্থানীয় হবিবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিবেকানন্দ দাসের। তার ঘরটিও টিনের। চেয়ারম্যান বাড়িতে নেই। তার স্ত্রী দিপালী মজুমদারের সঙ্গে কথা হয়।
তিনি বলেন, ‘আমাদের আলমারি ভেঙে সব সোনাদানা নিয়ে গেছে। ভয়ে বাথরুমে লুকিয়েছিলেন আমার জা। বাথরুমের দরজা ভেঙে তাকে বের করে এনেছে।’
হামলাকারীরা ভেঙে দেয় এই ছোট্ট মন্দিরটিও। ছবি: নিউজবাংলা
বলতে বলতেই বাথরুমের ভাঙা দরজা দেখান তিনি।
রঞ্জনা চৌধুরী, যার মেয়ে ভয়ে বাড়ি আসতে ভয় পায়, তিনি বলেন, ‘সেদিন বাচ্চারাও লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলায় এসেছিল। তারা সবাই আশপাশের গ্রামের। আমাদেরই প্রতিবেশী। হামলার সময় স্বাধীন মেম্বার উঠানের চেয়ার বসে বিড়ি ফুঁকছিল। আমরা হাওর থেকে সব দেখতে পাচ্ছিলাম।
‘আমার ঘরের চুলা ভেঙেছে। হাঁড়ি ভেঙেছে। ঘরে গরু বিক্রির টাকা ছিল, সেটা নিয়ে গেছে। আমাকে একেবারে সর্বস্বান্ত করে গেছে।’
কথা বলার সময় ক্ষোভে বিস্ফোরিত হয়ে ওঠে রঞ্জনা চৌধুরীর চোখ। বলেন, ‘এ রকম লুটপাট করছে জানলে আমি নিজেই লাঠি নিয়ে তাদের ঠেকাতে বের হতাম। তাতে মারা গেলেও শান্তি ছিল। সব হারিয়ে এখন বেঁচে থেকে কি লাভ?’
নোয়াগাঁও হাওরবেষ্টিত শাল্লা উপজেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম। বর্ষায় নৌকা আর শুষ্ক মৌসুমে মোটরসাইকেলই এখানকার বাহন। হাওরের ফসলরক্ষার জন্য যে বাঁধ তৈরি হয়েছে, সেটিই এখন সড়ক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
সড়ক না থাকলেও গ্রামে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ। গ্রামের পাশেই পল্লী বিদ্যুতের সাব-স্টেশন নির্মিত হচ্ছে। গ্রামে পাকাঘর তেমন নেই। প্রায় প্রতিটি ঘরই টিনের, যার মধ্যে বেশির ভাগ ঘরই ভাঙাচোরা। সবকিছুতে দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট।
হামলার ক্ষত এখনও স্পষ্ট ওই গ্রামের ঘরগুলোতে। ছবি: নিউজবাংলা
গ্রামের কিছু তরুণের হাতে স্মার্টফোন থাকলেও বয়স্করা এখনও ইন্টারনেট, ফেসবুক এসবের সঙ্গে পরিচিত নন।
ফেসবুকে যে স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে হামলার কথা বলা হচ্ছে সে বিষয়ে জানতে চাইলে গ্রামের গৃহবধূ ঢলি রানী দাস বলেন, এ কয়দিন হলো তিনি ফেসবুক শব্দটা শুনছেন।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ফেছবুক কিতা জানি না। অনেকে এর কথা কইতে হুনলাম। ঝুমনে ওনো বুলে (ওখানে নাকি) কিতা লেখছে।’
এইটুকু বলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন ঢলি। ফেসবুক সম্পর্কে কিছু জানতে চান বোধ হয়।
কোনো উত্তর না পেয়ে আবার নিজে থেকেই বলতে শুরু করেন, ‘হামলার ঠিক আগে আমরা পাশের হাওরে গিয়ে লুকিয়েছিলাম। সেখান থেকে হামলার শব্দ শুনেছি। এখনও সেই শব্দ কানে ভাসে। এখনও ভয়ে গা শিউরে ওঠে।’
হামলার পর সরকারসহ বিভিন্ন সংগঠন থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। ভাঙা ঘরগুলো পুনর্নির্মাণেও সহায়তা করেছে সরকার।
এখন বিচার চায় গ্রামবাসী।
গ্রামবাসীর চোখেমুখে এখনও আতঙ্ক। ছবি: নিউজবাংলা
গ্রামের গৃহবধূ সুধা রানী দাস বলেন, ‘সাহায্য অনেক পেয়েছি। কিন্তু আমরা সাহায্য নয়, বিচার চাই। নিরাপত্তা চাই।’
নোয়াগাঁওয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহমর্মিতা জানাতে সিলেট থেকে বুধবার গিয়েছিলেন নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ‘দুষ্কাল প্রতিরোধে আমরা’ এর সংগঠক আব্দুল করিম কিম।
মামুনুলকে নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া ঝুমন দাশের ঘরে যান তিনি। ঝুমন দাশের মুক্তির জন্য তার পরিবারের দাবির সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মামুনুল হকের সমালোচনা করলে কাউকে কেন গ্রেপ্তার করতে হবে? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সবারই সমালোচনা করার আধিকার আছে। ঝুমনকে অন্যায়ভাবে জেলে রাখা হয়েছে।’
কিমের সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা বিশ্বজিত চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘নোয়াগাঁওয়ে হামলার পর হামলাকালীরা মিছিল নিয়ে শাল্লা সদরের দিকে গিয়েছিল। সেখানে একটি প্রাচীন মন্দিরে হামলার চেষ্টা করেছিল তারা। আমরা সবাই জড়ো হয়ে তাদের প্রতিহত করি। এখানে হামলার ব্যাপারে আগে থেকে জানলে তাদের প্রতিহত করা যেত।’
গ্রাম থেকে বের হওয়ার পথে দেখা হয় একাত্তরের যুদ্ধ দেখা বৃদ্ধ সাবিত্রী বালার সঙ্গে। লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটাহাঁটি করছিলেন তিনি।
সাবিত্রী বলেন, ‘একাত্তরের সময় একবার বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলাম। এইবার আবার ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালাতে হলো। স্বাধীন দেশে কেন নিজ বাড়িঘর ছেড়ে ভয়ে পালাতে হয়? আমাদের অপরাধ কি?’
তার পাশে থাকা অনিল দাস বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময়ও একবার দিরাইয়ের নাচনি ও চণ্ডীপুরের রাজাকাররা নোয়াগাঁওয়ে হামলা করেছিল। তখন চারজন রাজাকারকে ধরে হত্যা করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। এবারও হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছে নাচনি ও চণ্ডীপুর গ্রামের লোকজন।’
নোয়াগাঁও পরিদর্শনে যাওয়া দলে ছিলেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জহিরুল হক শাকিল। তিনি বলেন, ‘এই হামলা একাত্তরের হামলা থেকে ভিন্ন কিছু না। এই হামলায় যতটা না জানমালের ক্ষতি হয়েছে তার চেয়ে বেশি হয়েছে মানসিক ক্ষতি, বিশ্বাসের ক্ষতি।’
নোয়াগাঁও থেকে ফেরার পথে পড়ে ধারণ বাজার। এই বাজারের একটি মন্দির একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়েছে হামলাকারীরা। সেটি দেখিয়ে স্থানীয় ছাত্রনেতা অরিন্দম চৌধুরী বলেন, ‘এখন বলা হচ্ছে জলমহাল নিয়ে বিরোধ থেকে নোয়াগাঁও গ্রামে হামলা হয়েছে। জলমহাল নিয়ে বিরোধ হলে এই মন্দিরে হামলা হবে কেন?’
তার মত, এটা স্পষ্টতই সাম্প্রদায়িক হামলা।
গ্রামবাসী এখন হামলার ঘটনার বিচার ও নিরাপত্তা চায়। ছবি: নিউজবাংলা
হামলার ঘটনার পর দুইটি মামলা হয়। তাতে বুধবার পর্যন্ত ৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এদের মধ্যে পাশের দিরাই উপজেলার নাচনি গ্রামের ইউপি সদস্য শহিদুল ইসলাম স্বাধীনকে ৫ দিনের এবং ২৯ জনকে ২ দিনের রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ।
শাল্লা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজমুল হক বলেন, ‘এই হামলার সঙ্গে জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তারে পুলিশ সর্বোচ্চ তৎপরতা চালাচ্ছে। এ্ররই মধ্যে ৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ৩০ জনের রিমান্ডও চলছে। জিজ্ঞাসাবাদে আরও যাদের নাম পাওয়া যাবে, তাদেরও গ্রেপ্তার করা হবে।’
তিনি জানান, নোয়াগাঁও গ্রামবাসীর নিরাপত্তায় গ্রামেই একটি অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প করা হয়েছে। সেখানে সার্বক্ষণিক দায়িত্বে আছেন ১৫ জন পুলিশ। এ ছাড়া গ্রামে র্যাবও একটি অস্থায়ী ক্যাম্প করেছে।