সুনামগঞ্জের শাল্লায় হিন্দু গ্রামে হামলার ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার যে অভিযোগ উঠেছে, সেটি অস্বীকার করেছেন জেলার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান।
হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হকের সমালোচনা করে স্ট্যাটাসের জেরে এই হামলা হয়েছে জানিয়ে তিনি জানান, এখন পর্যন্ত ৩২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জড়িত বাকি সবাইকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।
একটি মামলার প্রধান আসামি শহীদুল ইসলাম স্বাধীনকে রিমান্ডে নিতে আবেদন করা হবে বলেও জানান এসপি।
গত বুধবার শাল্লার নোয়াগাঁওয়ে ৮০টিরও বেশি হিন্দু বাড়িতে হামলা ও লুটপাট হয়। চার দিন পর রোববার নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন সুনামগঞ্জের এসপি।
এই হামলার পর জানা যায়, গত সোমবার হেফাজত নেতা মামুনুল হক শাল্লা লাগোয়া দিরাই উপজেলায় একটি মাহফিলে বক্তব্য রাখেন। সেখানে তিনি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সমালোচনা করে বক্তব্য রাখেন।
এর সমালোচনা করে আবার নোয়াগাঁওয়ের এক যুবক স্ট্যাটাস দিয়ে মামুনুলকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেন। এ নিয়ে উত্তেজনার মধ্যে বুধবার সকালে দিরাইয়ের তিনটি মসজিদে মাইকিং করে স্থানীয়দের জড়ো করে মিছিল নিয়ে শাল্লার উদ্দেশে রওনা দেয় হামলাকারীরা।
শাল্লার ঘটনা নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে সুনামগঞ্জের এসপি। ছবি: নিউজবাংলা
পুলিশ এই জমায়েতের কথা জানত। তবে হেফাজতের স্থানীয় নেতারা তাদের আশ্বাস দেন, কেবল মিছিল করে তাদের সমর্থকরা চলে আসবেন।
কিন্তু তা হয়নি। মিছিলকারীরা রামদাসহ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রওনা হয় আর শাল্লার ওই গ্রামটিতে গেলে তারা উন্মত্তের মতো হামলে পড়ে।
এরপর পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা ওঠে।
তবে এসপি দাবি করেন, পুলিশের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ সত্য নয়। তিনি বলেন, ‘এই সংবাদ (উত্তেজনার) পাওয়ার পর শাল্লা থানার ওসি, ইউএনও ও উপজেলা চেয়ারম্যান উপস্থিত হয়ে উত্তেজিত জনতাকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারেন ঝুমন দাস তার ফেসবুক আইডিতে মামুনুল হকের ছবি বিকৃত করে কুরুচিপূর্ণ স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ওসি ঝুমন দাসকে তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তার করেন এবং আইনানুগ ব্যবস্থার গ্রহণের আশ্বাস দিলে জনতা শান্ত হয়ে ফিরে যায়। তারা আর কোনো উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করবে না মর্মে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে।’
হামলার পরদিন ১৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে শাল্লার ওসি, স্থানীয় প্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপজেলা চত্বরে সরকারি কর্মসূচিতে ছিলেন বলেও জানান এসপি।
তিনি বলেন, ‘আমি ও জেলা প্রশাসক জেলা সদরের জাদুঘরে অনুরূপ সরকারি প্রোগ্রামে থাকাবস্থায় সংবাদ পাওয়া যায় সকাল আনুমানিক ৮টা ৫০ মিনিটে শাল্লার কাশিপুর ও দিরাইয়ের চন্ডিপুর, নাচনী, চন্দ্রপুর এবং ধনপুর গ্রামের ১৪০০ থেকে ১৫০০ উত্তেজিত জনতা দা, লাঠিসোঁটা নিয়ে ঝুমন দাসের বাড়িতে আক্রমণ করার উদ্দেশে রওনা হচ্ছে।
‘তাৎক্ষণিক খবর পেয়ে শাল্লা থানার ওসি ও ইউএনও নোয়াগাঁও গ্রামের দারাইন নদীর উত্তর পশ্চিম পারে অবস্থান করে উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করতে পৌঁছান।’
কয়েক হাজার মানুষ দা-লাঠিসহ মিছিল নিয়ে এসে ভাঙচুর করে ৮৭টি হিন্দু বাড়ি। ছবি: নিউজবাংলা
সুনামগঞ্জ পুলিশের প্রধান জানান, দারাইন নদীর উত্তর-পূর্বপাড়ের অরক্ষিত অংশ দিয়ে সাঁতরে কয়েকজন নোয়াগাঁও গ্রামে প্রবেশ করে। তারা ঝুমন দাস, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বকুল চন্দ্র মজুমদারের ঘরসহ বেশ কিছু ঘরে হামলা ও ভাঙচুর চালায়।
এ সময় পুলিশ আশপাশ থেকে নৌকা জোগাড় করে দারাইন নদী পার হয়ে গ্রামে পৌঁছার আগেই হামলাকারীরা নদী পার হয়ে চলে যায় বলে জানান তিনি।
‘মামুনুলকে নিয়ে স্ট্যাটাসেই এই ঘটনা, শান্ত করার চেষ্টা করেছে পুলিশ’
এসপি বলেন, ১৬ মার্চ সকালে শাল্লার নোয়াগাঁও গ্রামের ঝুমন দাস তার ফেসবুক আইডি থেকে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হককে নিয়ে স্ট্যাটাস দেন।
এর জেরে দিরাই ও শাল্লা থানার কয়েকটি গ্রামের কয়েক শ মুসলিম মসজিদের মাইকে প্রচার করে জড়ো হয়ে আনুমানিক রাত ৮টার দিকে নোয়াগাঁও গ্রামে মিছিল-স্লোগানসহ প্রতিবাদ জানাতে থাকে বলে জানান তিনি।
ওই রাতেই গ্রামের দারাইন বাজারে শাল্লা থানা থেকে একজন এসআই, একজন এএসআই ও সাতজন কনস্টেবল মোতায়েন করা হয় বলেও দাবি করা হয় সংবাদ সম্মেলনে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাহেব আলী পাঠানের নেতৃত্বে জেলা সদর থেকে অতিরিক্ত পুলিশ ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থলে যায়- সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন এসপি।
ইউপি চেয়ারম্যানের করা মামলার প্রধান আসামি শহীদুল ইসলাম স্বাধীন। ছবি: নিউজবাংলা
স্বাধীনকে রিমান্ডে চায় পুলিশ
এই হামলার ঘটনায় মামলা হয়েছে দুটি। একটি মামলা করেছেন হবিবপুরের ইউপি চেয়ারম্যান বিবেকানন্দ মজুমদার। একটি করেছে পুলিশ।
বিবেকানন্দর করা মামলায় প্রধান আসামি শহীদুল ইসলাম স্বাধীনকে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি নিজেকে যুবলীগ নেতা পরিচয় দিলেও জেলা যুবলীগ জানিয়েছে, উপজেলায় ১৪ বছর ধরেই তাদের পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই।
আরও পড়ুন: শাল্লায় হামলা: যেভাবে ধরা যুবলীগের স্বাধীন
শনিবার প্রথম প্রহরে স্বাধীনকে মৌলভীবাজার থেকে আটক করে তদন্ত সংস্থা পিবিআই। তাকে রিমান্ডে পাওয়ার আশা করছেন এসপি।
তিনি বলেন, ‘আমরা আদালতের কাছে রিমান্ড চাইব। কারণ, তাকে আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করার রয়েছে। তবে বিষয়টি যেহেতু এখনও তদন্তাধীন, এর বেশি কিছু আপনাদের বলতে পারব না।’এই মামলায় এখন পর্যন্ত ৩৩ জনকে গ্রেপ্তার করার কথা জানিয়ে এসপি বলেন, ‘জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তার করে সঠিক তদন্ত করে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে অভিযোগপত্র দাখিল করতে পারব বলে আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই।’