এক বছর আগে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রীকে অপহরণ করে আটকে রেখে ধর্ষণ মামলায় ১৩ মাস জেলে ছিলেন গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের আনারুল ইসলাম। জামিনে বেরিয়ে সেই ছাত্রীকে বিয়ে করার দাবি করছেন তিনি।
অভিযোগ উঠেছে, চিহ্নিত এই মাদক কারবারির সঙ্গে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েটির বিয়ে দিয়েছেন স্থানীয় সাবেক এক ইউপি চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতাসহ ১০ জন।
নিউজবাংলার অনুসন্ধানে জানা গেছে, তারা শালিস বৈঠকে যার হাতে ১৫ বছরের মেয়েটিকে তুলে দেন সেই আনারুলের বয়স ২৯ বছর। দীর্ঘদিন যুবলীগের রাজনীতিতে জড়িত আনারুল এখন সুন্দরগঞ্জের কাপাসিয়া ইউনিয়ন যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক।
তার এই রাজনৈতিক পরিচয় নিউজবাংলাকে নিশ্চিত করেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মমিনুল ইসলাম।
তার দাবি, মেয়েটি নিজের ইচ্ছায় আনারুলের বাড়িতে চলে যায়। পরে তিনিসহ সাবেক চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য ও এলাকাবাসী তাদের বিয়ে দেন। তবে মেয়েটি নাবালক হওয়ায় বিয়ের রেজিস্ট্রি করা যায়নি।
ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মমিনুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মেয়েটা স্বেচ্ছায় তার বাড়িতে গেছে। পরে সবাই মিলে বিয়ে পড়াইছি। পরে ইউএনও মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলে রেজিস্ট্রি করার কথা ছিল।’
বিরক্তির সুরে তিনি বলেন, ‘সারা বছর কি এইটা নিয়ে ন্যাকেট (ঝামেলা) করবে গ্রামবাসী। প্রতি মুহূর্তেই এটা নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে। তার (মেয়ের) বোঝা দরকার ছিল, আমার বয়স হয় নাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের গ্রামের পরিস্থিতি আমরা বুঝি। আইন কী করবে?’
পরে তিনি নিউজবাংলার প্রতিবেদককে আবার ফোন বলেন, ‘ভাই কালকে আমি ইউএনওর সঙ্গে দেখা করব। তার পরামর্শ নিয়ে বিষয়টা কেমনে মিটমাট করা যায় করব। মেয়ের পরিবারকেও সঙ্গে নিব।’
পুলিশ জানিয়েছে, গত বছরের ৭ জানুয়ারি মেয়েটিকে অপহরণ করেন আনারুল। এরপর গাইবান্ধা সদর উপজেলার এক বাড়িতে আটকে রেখে ধর্ষণ করেন। অভিযোগ পেয়ে ১০ জানুয়ারি অভিযান চালিয়ে মেয়েটিকে উদ্ধার এবং আনারুলকে আটক করা হয়। একই দিন সুন্দরগঞ্জ থানায় অপহরণ ও ধর্ষণের মামলা করেন মেয়েটির বাবা। এরপর থেকে কারাগারে ছিলেন আনারুল।
মেয়েটির দিনমজুর বাবার অভিযোগ, আনারুল গত মাসে জামিনে বেরিয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি মেয়েকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যান। এরপর রেজিস্ট্রি ছাড়াই মেয়েটিকে বউ হিসেবে দাবি করছেন। কিছু বলতে গেলে হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছে।
মেয়েটির ভাই অভিযোগ করেন, ধর্ষণ মামলা থেকে বাঁচতে আনারুল তার বোনকে তুলে নিয়ে গেছেন। এখন বলছেন, তাকে বিয়ে করেছেন। কিন্তু তার বোনের বয়স মাত্র ১৫ বছর। স্থানীয় মাতবররা তার বোনকে মাদকসেবীর হাতে তুলে দিলেও তাদের জানানো হয়নি। উল্টো মাতবররা এখন মামলা তুলে নিতে হুমকি দিচ্ছেন।
অভিযোগ রয়েছে, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ মমিনুল ইসলাম, স্থানীয় নবনির্বাচিত ইউপি সদস্য মমিনুল ইসলাম মমিন, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মনজু মিয়া আনারুলের বাড়িতে শালিশ বৈঠক করে মেয়েটিকে তার হাতে তুলে দেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাপাসিয়া ইউপির চেয়ারম্যান জালাল উদ্দীন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মিটিংয়ে আমাকে ডাকা হয়নি। কারা এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে জানি না। কাজটা উচিৎ হয়নি।’
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, আনারুল ১০ বছর আগেও একটি বিয়ে করেন। যৌতুক দাবিতে স্ত্রীকে নির্যাতন করতেন। এ কারণে বিয়ের পরের বছরই তাকে তালাক দেন স্ত্রী।
অভিযোগের ব্যাপারে জানতে আনারুলের মোবাইলে ফোন করলে নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘তাকে (ছাত্রী) জোর করে তুলি আনি নাই। মেয়ে নিজেই বাড়িত আসছে। এর আগেও মেয়েটাই আসছিল। উলটা মামলা দিয়া ১৩ মাস জেল খাটাইছে। এখন মেয়েটাকে বিয়ে করছি। সংসার করতেছি।’
১৫ বছরের মেয়েকে বিয়ে করলেন কীভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিয়ে তো পড়াই নাই। রেজিস্ট্রি করি নাই। মেয়েটা বাড়িত আসছে। তাক কী ফেলাই দেব?’
এক পর্যায়ে হুমকি দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার বিষয় নিয়ে বেশি নাটানাটি (খোঁজ) করবেন না। আমার নামে মামলা আছে। আরও খাব। খাতেই থাকব। তাতে আপনার কী?'
তিনি বলেন, ‘আমার নামে মাদকের দুটে মামলা আছে। তবে জেলে যাইনি। আর বিয়ে করছি- চেহারা দেখে। বয়স দেখে না। আর রেজিস্ট্রি ওই পর্যন্তই।’
আনারুলের দাবি, মেয়েটির বাবা, মা ও ভাই ছাড়া বিয়েতে এলাকার সবাই ছিলেন। তবে তিনি কারও নাম বলতে রাজি হননি।
আনারুলের বিরুদ্ধে মাদকের একাধিক মামলা রয়েছে এবং একটি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সুন্দরগঞ্জের কঞ্চিবাড়ী পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ মোকলেছুর রহমান সরকার।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘মাদক মামলায় আনারুলকে একাধিকবার গ্রেপ্তার করা হয়। জেলও খেটেছে সে।’
আনারুলের বিরুদ্ধে এক বছর আগের অপহরণ ও ধর্ষণ মামলার কথা স্বীকার করে পুলিশ কর্মকর্তা মোকলেছুর বলেন, ‘অপহরণ ও ধর্ষণ মামলায় জামিনে রয়েছেন আনারুল। মেয়েটি যে নতুন করে অপহরণ হয়েছে- এ নিয়ে পরিবার থানায় লিখিত অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
আলোচিত এ ঘটনার পর মেয়েটির খোঁজ নিতে গিয়ে তার দেখা মেলে আনারুলের বাড়িতে।
নিউজবাংলাকে মেয়েটি বলেন, ‘আমার ইচ্ছামতো আমি আসছি। আমি তো খুশি। ওদের কী?’ তিনি জানান, বাবা-মা ও ভাই ছাড়া এলাকার সবাই তাকে আনারুলের হাতে তুলে দিয়েছেন।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ আল মারুফ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মিডিয়ার মাধ্যমে বিষয়টি জেনেছি। যেহেতু এটা পুলিশ কেইস। সে জন্য মেয়ের পরিবারের অভিযোগ লাগবে। অভিযোগ ছাড়া ভ্রাম্যমাণ বা অন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়া হলে ঘটনাটি অন্যদিকে মোড় নিতে পারে।’
এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দেয়ার পরামর্শ দিয়ে সুন্দরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল্লাহিল জামান বলেন, ‘এটা রেগুলার কেইস। অভিযোগ ছাড়া ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে না।’