বরিশাল নগরীতে ১৩ দিন আগে যাত্রা শুরু করা জনপ্রিয় টেইলারিং ব্র্যান্ড টপ টেনের শোরুমে লুটপাট, ভাঙচুর ও কর্মচারীদের মারধরের ঘটনায় সরাসরি কারা জড়িত, ঘটনার নেপথ্যে কারা, তা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা চলছে জেলাজুড়ে।
কেউ কেউ ফেসবুকে ছবি পোস্ট করে বলছেন, দেখুন হামলাকারী কারা, তাদের পেছনে কারা। তবে হামলার সময় মহানগর ছাত্রলীগের যে নেতার নাম বলা হয়েছিল তিনি বলছেন, ঘটনায় তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তাকে ফাঁসাতেই হামলার সময় তার নাম বলা হয়।
বরিশাল নগরীর প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত সদর রোডে রোববার সন্ধ্যার ওই ঘটনার পর ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের প্রশ্ন- বরিশালে কি আবারও সন্ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি হয়েছে?
এ ঘটনায় ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ক্ষুব্ধ বিশিষ্টজনরা। তারা বলছেন, ঘটনায় যারা জড়িত তাদের পেছনে রাজনৈতিক শক্তি রয়েছে; রয়েছে পুলিশের গাফিলতিও। হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন তারা।
আলোচিত এই ঘটনায় ২১ জনের নাম এবং ২০-২৫ জনকে অজ্ঞাত করে কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা করেছেন টপ টেন শোরুমের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার ইমরান শেখ। তবে কোনো আসামিকেই নতুন করে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি জসীম উদ্দিনের অনুসারী পরিচয়ে লুটপাট করা হলেও ৪০-৫০ জনের দলটি অন্য ছাত্রলীগ নেতাদের অনুসারী বলে ফেসবুকে ছবি পোস্ট করেছেন কেউ কেউ। এরপর শুরু হয়েছে বিতর্ক।
এই ঘটনায় আটক পাঁচজনের মধ্যে রাকিব নামের যুবক বরিশাল সিটি করপোরেশনের যানবাহন ও লাইসেন্স শাখার কর্মচারী। তাকে বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাজীব হোসেন খানের ঘনিষ্ঠ অনুসারী হিসেবে চিহ্নিত করে ফেসবুকে একটি ছবি পোস্ট করেন মাইদুল ইসলাম নামের একজন।
যে ছবিতে রাকিবকে রাজিব হোসেন খানের নেতৃত্বে হওয়া মিছিলে সামনের সারিতে দেখা যায়।
মাইদুল ইসলামের আইডি থেকে পোস্ট করা আরেকটি ছবিতে আটক শাকিলকে বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি আতিকুল্লাহ মুনিমের অনুসারী বোঝানো হয়েছে। পোস্টে লেখা হয়েছে, হামলাকারীরা কাদের অনুসারী সবাই দেখুন।
ফেসবুক থেকে নেয়ারনি খন্দকার ও রাফতার হোসেন রাকিব নামের আইডি থেকেও একই ধরনের পোস্ট পাওয়া গেছে।
রোববারের ঘটনায় ক্ষুব্ধ নগরীর সদর রোডের ফাতেমা সেন্টারের দোকান কর্মচারী সাহাবুদ্দিন মল্লিক।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘হামলা ও লুটপাটকারীরা রাজনৈতিক প্রশ্রয়েই এখানে আসে। বাইরেও লোক ছিল তাদের। টার্গেট পূরণ হওয়ার পর কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে যায়। এর মধ্যে একটি দল নগরীর প্যারারা রোড হয়ে কাটপট্রি থেকে কোতোয়ালি মডেল থানার পাশ থেকে লাইন রোড হয়ে চকের পুল থেকে সটকে পড়ে।
‘অপর একটি দল সদর রোড থেকে ফকির বাড়ি রোডে ঢুকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আরেকটি দল গোড়াচাঁদ দাস ও ঈশ্বর বসু রোডের দিকে চলে যায়। অন্য আরেকটি দল নাজিরপুল হয়ে কাউনিয়া এলাকার দিকে চলে যায়।’
নগরীর এই ব্যবসায়ীর অভিযোগ, টপ টেন শোরুমে হামলাকারীরা সবাই ‘কিশোর গ্যাং’-এর সাবেক সদস্য। এরা বয়সের কারণে ‘তরুণ গ্যাং’-এ পরিণত হয়েছে। এদের নেতৃত্ব বা শেল্টার দিয়ে থাকেন বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা। সন্ত্রাসী কার্যক্রমে এদেরই ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
বরিশালের চিহ্নিত কিশোর গ্যাং ‘আব্বা গ্রুপ’-এর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন জেলা ছাত্রলীগের দুই নেতা। যারা টপ টেনে হামলার নির্দেশনা দেন বলে ফেসবুকে পোস্ট করছেন কেউ কেউ।
টপ টেন-এর বরিশাল ব্রাঞ্চ ম্যানেজার ইমরান শেখ বলেন, ‘হামলাকারীরা বলেছে তারা মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি জসীম উদ্দিনের লোক। এখন পুলিশ তদন্ত করে আসলটা বের করুক।’
বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি জসীম উদ্দিন বলেন, ‘আমার সামর্থ্য নেই সদর রোডের মতো একটি জায়গার শোরুমে ঢুকে এই ঘটনা ঘটানোর। এটা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। আমি এমনিতেই রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ এটা।’
এ ঘটনায় করা মামলার নামধারী আসামিরা হলেন মো. রাকিব, উজ্জ্বল, রাশিদ সাবাব রোহান, শাহাদাৎ হোসেন, শাকিল আহম্মেদ, নিলয় আহম্মেদ রাব্বি, মহিদুল ইসলাম মুহিদ, মো. মিজান, তাজিন, হিরা, শুভ, রানা, সুজন, রনি, রাজু, টিটু, সাব্বির ওরফে নাদিম মাহামুদ হৃদয়, ইকবাল, মোস্তাফিজুর রহমান কামাল, ফাহিম ও সোহান।
এদের মধ্যে ঘটনাস্থল থেকে আটক রাকিব, উজ্জ্বল, রোহান, শাহাদাৎ ও শাকিলকে সোমবার বিকেলে জেলহাজতে পাঠিয়েছে বরিশালের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আনিছুর রহমান।
আটক রাকিব আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ারি মডেল থানার এসআই আশরাফুল ইসলাম।
থানার ওসি নুরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হামলাকারীরা যারই লোক হোক বা যে দলেরই হোক দ্রুত তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।’
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার শাহাবুদ্দিন খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পুলিশ ইতিমধ্যে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। ঘটনাস্থল থেকে নানা আলমত সংগ্রহ করেছে। হামলাকারী যারাই হোক না কেন অতিদ্রুত আইনের আওতায় আনতে কাজ শুরু করা হয়েছে।’
আতঙ্কিত ব্যবসায়ীরা
টপ টেন-এর শোরুমে লুটপাট, ভাঙচুর ও হামলার পর আতঙ্কে আছেন বরিশাল নগরীর ব্যবসায়ীরা। নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।
সদর রোডের ইজি ফ্যাশনের কর্মচারী সজীবুল ইসলাম বলেন, ‘সদর রোডের মতো জায়গায় যদি এ রকম ফিল্মি স্টাইলে লুটপাট, হামলা ভাঙচুর করা হয় তাহলে নগরীর অন্য স্থানের দোকানগুলো কতটা নিরাপদ?’
গির্জা মহল্লা এলাকার ব্যবসায়ী তৌহিদুল রহমান বলেন, ‘চাঁদা না দিলেই হামলা ভাঙচুর- এটা কেমন কথা? বরিশালে কি আবারও সন্ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি হয়েছে? সদর রোডের মতো জায়গায় যদি এই ধরনের ঘটনা ঘটে, তাহলে অন্য শোরুমগুলোতেও যেকোনো সময় এই ঘটনা ঘটতে পারে।’
বাজার রোডের ব্যবসায়ী অলক সাহা বলেন, ‘হামলাকারীরা যারাই হোক না কেন তাদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তা না হলে আজ ওই টপ টেন-এর শোরুমে হয়েছে, কাল তো আমার দোকানে হবে। এ রকম চলতে দেয়া যায় না।
আরও পড়ুন: বরিশালে শোরুমে ‘ডাকাতি’, আটক ৫
‘এর আগে শুনেছিলাম গির্জা মহল্লায় একটি মোবাইলের দোকানে এমনভাবেই হামলা হয়েছিল। কিন্তু কোনো বিচার হয়নি। সন্ত্রাসীরা দুই দিন পরই আবার স্বাভাবিকভাবে চলাচল করছে। র্যাব-পুলিশ যদি এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয় তাহলে এই সমস্যা দিন দিন বাড়বে। এর দায়ভার তাদেরই নিতে হবে।’
সিএন্ডবি রোডের স্যানিটারি ব্যবসায়ী আলতাফ সিকদার বলেন, ‘ওপেনে যারা ৫০-৬০ লাখ টাকার মাল নিয়ে যেতে পারে তারা ক্ষমতাধর সন্ত্রাসী। তাদের পেছনে রাজনৈতিক সাপোর্ট ছাড়া এটা সম্ভব নয়। শুনেছি ছাত্রলীগের লোকজন নাকি এই কাজ করছে। ছাত্রলীগের লোকজন দিয়ে যদি এই হামলা-ভাঙচুর করানো হয় তাহলে তাদের মূলনীতিটা কোথায়?
‘টপ টেন বরিশালে নতুন শোরুম দিয়েই হামলা আর লুটপাটের শিকার হয়েছে। তারা বরিশাল সম্পর্কে কী ভাবছে, সেটা ভাবা উচিত প্রশাসনের। আমরা বরিশালবাসী হিসেবে লজ্জিত। এই হামলাকারীদের বরিশাল ছাড়া করা উচিত। আমরাও এদের কারণে আতঙ্কে রয়েছি।’
ক্ষুব্ধ বিশিষ্টজনরা
এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে গবেষক ও লেখক আনিসুর রহমান খান স্বপন বলেন, ‘হামলা যারাই করুক তাদের রাজনৈতিক পরিচয় বাদ দিয়ে ধরা এবং দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার। এই হামলা ও লুটতরাজের কারণে বরিশালে ব্যবসার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে এরই মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। বরিশালের সবচেয়ে ব্যস্ত জায়গায় এ ধরনের ঘটনা সত্যিই অকল্পনীয়।’
সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন বরিশাল জেলা কমিটির সদস্য সচিব কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, ‘বরিশালের হার্ট বলা হয় সদর রোডকে। সেই সদর রোডের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটিতে এমন ঘটনা সত্যি ভয়াবহতার জন্ম দিয়েছে। আমি মনে করি, পুলিশ প্রশাসনের অযোগ্যতায় এই ঘটনা ঘটেছে।
‘৫০-৬০ জন লোক ঢুকে যদি এই কাণ্ড ঘটাতে পারে তাহলে পুলিশের কাজটা কী? পুলিশ কী করছিল গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কে। আমার ধারণা, এটা কোনো ডাকাতি নয়। এর সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে পুলিশ নিজেদের নিরপেক্ষ প্রমাণ করুক।’