২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায় ঘোষণার দিন।
ওই রায়ের জেরে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় জামায়াত-শিবিরের হরতালের মধ্যে চলে নারকীয় তাণ্ডব। বামনডাঙ্গা পুলিশ ফাঁড়িতে ঢুকে চার পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় প্রকাশ্যেই। রোববার সেই নির্মম হত্যাকাণ্ডের অষ্টম বছর।
ঘটনার এত বছরেও হয়নি বিচার। বিচারক সংকট ও সাক্ষীদের আদালতে না আসায় বিচারকাজে দেখা গেছে কচ্ছপ গতি।
সেদিনের ঘটনায় নিহত পুলিশ সদস্যরা হলেন সাঘাটা উপজেলার খামার ধনারুহা গ্রামের নাজিম উদ্দিন, রংপুরের পীরগাছার রহমতচর গ্রামের তোজাম্মেল হক, কুড়িগ্রামের রাজারহাটের কিশামত গোবধা গ্রামের হজরত আলী ও বগুড়ার সোনাতলার ঠাকুরপাড়ার বাবলু মিয়া।
জেলা ও দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি) ফারুক আহম্মেদ প্রিন্স জানান, অভিযোগপত্র দেয়ার পর মামলাটি জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালত থেকে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে স্থানান্তরিত হয়েছে। কিন্তু গত এক বছর অতিরিক্ত জেলা দায়রা জজ আদালতে বিচারক নেই।
তিনি আরও জানান, মামলার ৭৪ জন সাক্ষীর মধ্যে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন মাত্র ১৫ জন। সব মিলিয়ে এগোচ্ছে না বিচারকাজ।
পুলিশ ফাঁড়িতে ঢুকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় এই চারজনকে। ছবি: নিউজবাংলা
মামলার এজাহারের বরাত দিয়ে ফারুক জানান, সেই ২৮ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে সুন্দরগঞ্জের কঞ্চিবাড়ি, বেলকা, দহবন্দ, হরিপুর, বামনডাঙ্গা, সর্বানন্দ, রামজীবন ও ধোপাডাঙ্গা ইউনিয়নে সাঈদীর পক্ষে বিক্ষোভ-মিছিল করেন জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা।
তিনি জানান, এ দিন বামনডাঙ্গা বাজার, শোভাগঞ্জ বাজার, ছাইতানতলা বাজার, বামনডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন, রেলের প্রকৌশল অফিস, বামনডাঙ্গা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র, আওয়ামী লীগের কার্যালয়, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয় ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর-লুটপাট চালায় তারা। বামনডাঙ্গা রেলস্টেশনের রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়; কয়েকটি স্থাপনায় দেয়া হয় আগুন।
পিপি ফারুক জানান, ওই দিন দুপুরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পরপরই শুরু হয় জামায়াত-শিবির নেতা-কর্মীদের এলোপাতাড়ি আক্রমণ। তারা বামনডাঙ্গা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে গিয়ে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন। একপর্যায়ে সেখানে থাকা চার পুলিশ সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা করেন।
ওই সময় বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে জিহ্বা কেটে ও চোখ উপড়ে হত্যা করা হয় গংশারহাটের এক আওয়ামী লীগ সমর্থককে।
এ ঘটনায় সুন্দরগঞ্জ থানার তৎকালীন উপপরির্দশক (এসআই) আবু হানিফ বাদী হয়ে ৮৯ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও আড়াই হাজার ব্যক্তিকে আসামি করে সুন্দরগঞ্জ থানায় মামলা করেন।
২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর অধিকতর তদন্ত শেষে সুন্দরগঞ্জ থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোজাম্মেল হক ২৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে গাইবান্ধার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে ৩২ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র জমা দেন।
এই ২৩৫ আসামির মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে গ্রেপ্তারের আগেই। ২২৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও তারা সবাই জামিনে মুক্ত। আর প্রধান আসামি গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের জামায়াত দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল আজিজ ওরফে ঘোড়ামারা আজিজসহ পাঁচজন পলাতক। তারা দেশের বাইরে আছেন।
এই মামলার বিচারকাজ দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য এটিকে জেলা দায়রা জজ আদালতে স্থানান্তর করা প্রয়োজন বলে মনে করেন পিপি ফারুক আহম্মেদ।
চার পুলিশ সদস্যকে হারানোর এই দিনটিকে সুন্দরগঞ্জবাসী ‘কালো দিবস’ হিসেবে প্রতিবছর স্মরণ করে আসছে। ২০১৩ সাল থেকে ‘কালো দিবস উদযাপন কমিটি’ নামে উপজেলা প্রশাসন ও এলাকাবাসীর সম্মিলিত উদ্যোগে বিভিন্ন শোক কর্মসূচি পালন করা হয়।
রোববারও আছে এই কমিটির এমন কিছু কার্যক্রম। আয়োজকরা উপজেলা সদর ও বামনডাঙ্গায় শোক র্যালি, নিহত ব্যক্তিদের স্মৃতিস্তম্ভে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন, আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছেন।