বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পরকীয়া নয়, টিকটক-লাইকির জন্য স্বামীকে খুন

  •    
  • ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ২৩:৪৩

সম্প্রতি রাজু মিয়া নামের এক যুবকের হারানো মোবাইল ফোনের অডিও রেকর্ডে জানা গেছে, স্কুলশিক্ষক নাছির হাওলাদারের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। স্ত্রী মিতু তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে প্রেমিক রাজুর সহায়তায় কম্বলচাপা দিয়ে হত্যা করেন। ইচ্ছেমতো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাবাজি এবং টিকটক ও লাইকির ভিডিও তৈরিতে বাধা দেয়ায় এই খুন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ইচ্ছেমতো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাবাজি এবং টিকটক ও লাইকির ভিডিও তৈরিতে বাধা দেয়ায় স্বামী নাসির উদ্দিনকে প্রতিবেশী রাজু মিয়ার সহায়তায় হত্যার পরিকল্পনা করেন ফাতেমা আক্তার মিতু, যাকে তার পরকীয়া প্রেমিক বলা হচ্ছিল।

বরগুনার আলোচিত স্কুলশিক্ষক নাসির উদ্দিনকে হত্যার প্রায় নয় মাস পর ফাঁস হওয়া মিতু ও রাজুর কথোপকথনের অডিও রেকর্ডিং ঘেঁটে এবং তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পেয়েছে নিউজবাংলা।

গত ২৩ মে রাতে বরগুনার নিজ বাড়িতে মারা যান স্কুলশিক্ষক নাসির। মৃত্যুর কারণ হিসেবে তার স্ত্রী ফাতেমা মিতু জানিয়েছিলেন, স্ট্রোক।

নাসির বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের গোলবুনিয়া এলাকার গয়েজ উদ্দিনের ছেলে। গোলবুনিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন ৪৬ বছর বয়সী নাসির। ২৪ বছর বয়সী মিতু বরগুনা সদর উপজেলার আয়লা-পাতাকাটা এলাকার মাহতাব মৃধার মেয়ে।

নাসিরের বড় ভাই জলিল জানিয়েছেন, নাসির-মিতু দম্পতির নুসরাত নামে সাত বছরের একটি মেয়ে ও নাঈম নামে চার বছরের একটি ছেলে রয়েছে। ঘটনার পরপরই সন্তানদের নিয়ে মিতু সব আসবাবপত্রসহ বরগুনার থানাপাড়া এলাকায় বাবার বাসায় চলে যান।

গত ১১ ফেব্রুয়ারি বরগুনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কেএম তারিকুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, সম্প্রতি রাজু মিয়া নামের এক যুবকের হারানো মোবাইল ফোনের অডিও রেকর্ডে জানা গেছে, তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি।

স্ত্রী মিতু তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে প্রেমিক রাজুর সহায়তায় কম্বলচাপা দিয়ে হত্যা করেন। তাকে হত্যার ঘটনায় স্ত্রী ফাতেমা মিতু ও তার প্রেমিক রাজুকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ২০ বছর বয়সী রাজু মিয়া ঢলুয়া ইউনিয়নের গুলবুনিয়া এলাকার বারেক মিয়ার ছেলে।

ওসি বলেছিলেন, ‘চাঞ্চল্যকর এ হত্যার কথা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন মিতু ও রাজু। আদালতেও স্বীকারোক্তি দিয়েছেন তারা। আদালত তাদের কারাগারে পাঠিয়েছেন।’

নাসিরকে হত্যা নিয়ে মিতু ও রাজুর কথোপকথনের ১৩টি অডিও ক্লিপ পেয়েছে নিউজবাংলা। এতে জানা গেছে, ইচ্ছেমতো চলতে এবং টিকটক ও লাইকির ভিডিও তৈরিতে বাধা দেয়ায় স্বামীকে মারতে লোকও ভাড়া করেছিলেন মিতু। এ জন্য ধার করেছিলেন প্রায় ৩০ হাজার টাকা। সেই টাকার পাওনাদারদের চাপে মিতু শঙ্কায় ছিলেন, তারা বাসায় আসলে তো স্বামী নাসির সব জেনে যাবেন। মূলত এই শঙ্কা থেকেই প্রতিবেশী ও দূর সম্পর্কের আত্মীয় রাজু মিয়াকে হত্যার চক্রান্ত করেন মিতু।

স্কুলশিক্ষক নাসির হাওলাদার

রেকর্ডং থেকে জানা যায়, হত্যার ১০ দিন আগে ১২ মে রাজুকে মুঠোফোনে মিতু বলেন, তিনি খুবই সমস্যায় রয়েছেন, সহযোগিতা প্রয়োজন। রাজু সে সহযোগিতার আশ্বাস দিলে মিতু তাকে তার স্বামীকে হত্যার পরিকল্পনার কথা জানান।

পরদিন রাজু ফোন দেন মিতুকে। ১৫ মিনিট ১৯ সেকেন্ডের আলোচনায় তারা হত্যার দিনক্ষণ চূড়ান্ত করেন। কীভাবে হত্যা করা হবে তা নিয়েও আলোচনা করেন তারা। প্রথমে রাজু তাবিজ করে হত্যার পরামর্শ দেন। উত্তরে মিতু বলেন, এর আগেও স্বামীকে হত্যার জন্য তাবিজ-কবজ করে ব্যর্থ হয়েছেন।

একই সঙ্গে হত্যার পরিকল্পনা সফল করতে একাধিক পরিচিত ব্যক্তির কাছে প্রায় ৩০ হাজার টাকা ধার করে খরচ করে ফেলেছেন। ঘুমের ওষুধ বা ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা যায় কি না- এসব নিয়ে কথা বলেন তারা।

এক পর্যায়ে উভয়ে সিদ্ধান্ত নেন, অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খাইয়ে তাকে অচেতন করার পর কম্বলচাপা দিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করা হবে। ১৪ মে তিনবার কথা হয় তাদের। রাজু প্রথমে মিতুকে বুঝিয়ে বলেন, হত্যা না করে ধারদেনার টাকা পরিশোধ করলে হবে কিনা? কিন্তু মিতু রাজী হননি। মিতু বলেন, ‘টাকা শোধ করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। নাসিরকে হত্যা করতেই হবে, নাসির বেঁচে থাকলেই সমস্যা।‘

১৫ মে ফের কথা হয় তাদের। রাজুকে মিতু জানান, ২০ তারিখের আগে পাওনাদারদের টাকা পরিশোধ করতে হবে। এ জন্য রাজুকে দ্রুত আসতে মিতু তাড়া দিতে থাকেন এবং কাজটি (খুন) করতে পারবেন কিনা তার নিশ্চয়তা চান। রাজু তাকে ‘শিগগিরই’ করতে পারবেন বলে নিশ্চিত করেন।

১৬ মে আবারও তাদের কথা হয় এবং পাওনাদাররা টাকার জন্য তাড়া দিচ্ছেন কিনা- তা জানতে চান রাজু। ১৮ মে ১৯ মিনিট ২৫ সেকেন্ড কথা হয় রাজু ও মিতুর। এসময় ফের রাজুকে বাড়িতে আসার জন্য তাড়া দেন মিতু। মিতু বলেন, ‘রাসেল দফাদার নামের এক ব্যক্তির পাওনা টাকা পরিশোধ করতেই হবে। পাওনা টাকার জন্য বাড়িতে এসে জানালে নাসির খুব ঝামেলা বাঁধাবে। তাই যা করার ঈদের আগেই করতে হবে।’

রাজু তখন বলেন, তিনি যেখানে কাজ করেন সেখান থেকে টাকা নিয়ে ‘সময়মতো’ বাড়ি আসবেন। তার পরই হত্যা করা হবে নাসিরকে।

পরিকল্পনা মতো ঈদের আগেই ২৩ মে রাতে অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খাইয়ে নাসিরকে কম্বল চাপা দিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করেন মিতু ও রাজু।

পুলিশ সুপার মুহাম্মদ জাহাঙ্গির মল্লিক ১১ ফেব্রুয়ারি জানিয়েছিলেন, নাসির তার বাবার বাড়িতেই পৃথক কক্ষে স্ত্রী মিতুকে নিয়ে থাকতেন। গত ২৩ মে রাতে নাসির মারা গেছেন বলে হঠাৎ চিৎকার শুরু করেন মিতু। পরিবারের সদস্যদের তিনি জানান, স্ট্রোক করে মারা গেছেন নাসির। তার কথায় বিশ্বাস করে স্বাভাবিক নিয়মেই মরদেহ দাফন করেন স্বজনরা।

হত্যার পর দিন মিতুকে ফোন করে রাজু জানতে চান, সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা। মিতু বলেন, ‘সমস্যা নেই, সব ঠিক আছে।’

এরপর ১১ জুন মিতুকে ফোন করে তার সঙ্গে যোগাযোগ না রাখার কারণ জানতে চান রাজু।

জবাবে মিতু জানান, ঝামেলায় আছেন, যোগাযোগ রাখা সম্ভব নয়।

এর পরের ১৭ মিনিট ২৬ সেকেন্ডের এক রেকর্ডিং শুনে জানা গেছে, কথোপকথনে রাজু মিতুর বিরুদ্ধে কথা না রাখার অভিযোগ আনেন। এক পর্যায়ে মিতু বিরক্ত হয়ে ফোন কেটে দেন।

তাদের ফাঁস হওয়া এসব অডিও রেকর্ড পুলিশের হাতে চলে আসলে ১০ ফেব্রুয়ারি রাতে আটক হন রাজু ও মিতু।

পরের দিন নাসিরের ভাই জলিল বাদী হয়ে বরগুনা থানায় হত্যা মামলা করলে উভয়কে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করে পুলিশ। স্বামী হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় মিতু।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বরগুনা সদর থানার তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মিতুর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অবাধ বিচরণ ছিল। বিশেষ করে টিকটক ও লাইকিতে একাধিক অ্যাকাউন্ট খুলে ভিডিও শেয়ার করতেন তিনি। ভিডিওগুলো তৈরি করতেন ছেলে বন্ধুদের নিয়ে। মিতুর বন্ধুদের আড্ডা ছিল তার স্বামীর বাড়িতেই।

কিন্তু স্ত্রীর এসব কর্মকাণ্ডে ঘোর আপত্তি ছিল নাসিরের। এ নিয়ে প্রায়ই স্বামী-স্ত্রী দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়তেন। রাগ করে স্বামী-সন্তানদের রেখে বরগুনার থানাপাড়া এলাকায় বাবার বাসায় চলে যেতেন মিতু। সেখানে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে টিকটক, লাইকির জন্য ভিডিও তৈরি করতেন মিতু। সন্তানদের কান্নাকাটি সামাল দিতে না পেরে স্ত্রীকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যেতেন নাসির।আরও পড়ুন: প্রেমিকের ফোনের রেকর্ডে বেরিয়ে এল স্বামী হত্যার রহস্য

ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, মিতুর এসব কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করাই নাসিরের সর্বনাশ ডেকে আনে। নাসিরকে হত্যায় একাধিকবার মিতু পরিকল্পনা আঁটেন। হত্যা করতে বিভিন্ন লোককে ভাড়ায় খাটিয়ে দেনায় পড়ে যান মিতু। দেনা পরিশোধের জন্য পাওনাদার চাপ দিলে এক পর্যায়ে তিনি রাজুকে নিয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী স্বামীকে হত্যা করেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বরগুনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (অপারেশন) স্বরজিত চন্দ্র বলেন, ‘তদন্ত চলছে। ঘটনায় জড়িত কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। আমরা সব বিষয় নিয়ে তদন্ত করে শিগগিরই আদালতে প্রতিবেদন জমা দেব।’

মামলার বাদী নাসিরের বড়ভাই জলিল বলেন, ‘৯ বছর আগে নাসির-মিতুর বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে মিতুর চলাফেরা ও আচরণ আপত্তিকর ছিল। এ নিয়ে আমাদের সঙ্গে সম্পর্কেরও অবনতি হয়। ঘটনার দিন মিতুর কাছ থেকে আমার ভাইয়ের স্ট্রোকে মৃত্যুর খবর পাই আমরা। তখন আমাদের কোনো কিছু সন্দেহ হয়নি। তাই স্বাভাবিক নিয়মেই আমরা নাসিরকে দাফন করি।’

বিষয়টি মিতুর বাবা মাহতাব মৃধাকে জানালে তিনি বলেন, তার মেয়ে অনেক উচ্ছৃঙ্খল। মিতুকে পুলিশেও দিতে বলেন তিনি।

এ বিভাগের আরো খবর