ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এক মামলায় আদালতে রমনা থানা পুলিশের জমা দেয়া অভিযোগপত্রে সুইডেনপ্রবাসী সাংবাদিক তাসনিম খলিল ও আল জাজিরায় সাক্ষাৎকার দিয়ে বিতর্কিত জুলকারনাইন সায়ের খানসহ (সামি) আট আসামির নাম না থাকায় আরও তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এবার তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছে ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইউনিট।
এর আগে ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম তোফাজ্জল হোসেনের আদালতে ৪ ফেব্রুয়ারি অভিযোগপত্র জমা দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রমনা থানার উপপরিদর্শক মোহসীন সর্দার।
এতে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, লেখক মুস্তাক আহমেদ ও রাষ্ট্রচিন্তার সদস্য দিদারুল ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ার কথা জানানো হয়। তাসনিম খলিল, জুলকারনাইনসহ বাকি আট আসামিকে অব্যাহতি দেয়ার আবেদন ছিল অভিযোগপত্রে।
তবে অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম তোফাজ্জল হোসেন অভিযোগপত্রটি পাঠিয়ে দেন বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আসসামছ জগলুল হোসেনের আদালতে। এরপর এই আদালত গত বুধবার মামলার অধিকতর তদন্ত করতে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটকে (সিটিটিসি) নির্দেশ দেয়।
এই আদালতে ২৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে সিটিটিসিকে।
অভিযোগপত্রে নাম আসা ৩ জনসহ মোট ১১ জনের বিরুদ্ধে গত বছরের মে মাসে রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তিনটি মামলা করে র্যাব। অন্য আটজন আসামি হলেন নেত্র নিউজের তাসনীম খলিল, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান, যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সাংবাদিক শাহেদ আলম, জার্মানিপ্রবাসী ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন, হাঙ্গেরিপ্রবাসী জুলকারনাইন সায়ের খান, আশিক ইমরান, স্বপন ওয়াহিদ ও ফিলিপ শুমাখার।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, এই ১১ জন দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে জাতির জনক, মুক্তিযুদ্ধ, করোনাভাইরাস মহামারি সম্পর্কে গুজব রটিয়ে রাষ্ট্র ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন। এ ছাড়া তারা বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে জনসাধারণের মাঝে অস্থিরতা ও বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন।
তবে মামলার তদন্তে আট আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা যায়নি বলে দাবি করছেন রমনা থানা পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। থানার উপপরিদর্শক মোহসীন সর্দার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি সব ধরনের প্রযুক্তিগত সহায়তা নিয়ে তদন্ত করেছি। তবে মিনহাজ মান্নানের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা মেলেনি। আর বাকি সাতজন বিদেশে থাকেন বলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ বা অভিযোগ যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে অভিযুক্তদের সরাসরি যোগসাজস ছিল তা তদন্তে প্রমাণিত।’
পুলিশ যে অভিযোগপত্র আদালতে জমা দিয়েছে, তার একটি অনুলিপি পেয়েছে নিউজবাংলা। সেখানে দেখা যায় মিনহাজ মান্নানের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ না পাওয়ায় তাকে অব্যাহতির সুপারিশ করেছে পুলিশ।
আর তাসনিম খলিল, শাহেদ আলম, আসিফ মহিউদ্দিন, জুলকারনাইন সায়ের খান, আশিক ইমরান, স্বপন ওয়াহিদ ও ফিলিপ শুমাখারকে পলাতক দেখিয়ে ও তাদের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা না পাওয়ার উল্লেখ করে মামলা থেকে অব্যাহতির অনুরোধ করা হয়েছে।
তবে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে তাদের গ্রেপ্তার করা গেলে বা সঠিক নাম-ঠিকানা পাওয়া গেলে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়া হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রমনা থানার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সম্প্রতি আল জাজিরা টেলিভিশনে বিতর্কিত প্রতিবেদন প্রচার হওয়ার পর এই অভিযোগপত্র নিয়ে পুলিশের উপর মহলে তৎপরতা শুরু হয়েছে। আমাদের তরফ থেকে কোনো গাফিলতি হয়েছে কি না, তা সিনিয়রেরা যাচাই করে দেখছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘মামলা করার পর র্যাব তদন্তের দায়িত্ব চেয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে আবেদন করেছিল, তবে সেটি গৃহীত হয়নি। তারপর আমরাও মামলাটির দায়িত্ব সাইবার ক্রাইম ইউনিটে দেয়ার জন্য ডিমএপি হেডকোয়ার্টারে দুবার আবেদন করেছিলাম। আমাদের সেই আবেদনও নাকচ হয়েছিল।’
এই কর্মকর্তা বলেন, ‘চার্জশিট জমা দেয়ার পর আদালত বিস্তারিত তদন্ত করতে ডিএমপির সিটি সাইবার ক্রাইম বিভাগে স্থানান্তর করতে নির্দেশ দিয়েছে। আমরা সে অনুযায়ী সব নথি ডিএমপি কমিশনার কার্যালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার মো. শফিকুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
তবে ডিএমপির সিটির সাইবার অনুসন্ধান বিভাগের উপকমিশনার আফম আল কিবরীয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা আদালতের নির্দেশনা পেয়েছি। সে অনুযায়ী তদন্তকাজ শেষে দ্রুত চার্জশিট দেয়ার চেষ্টা করব। তদন্তাধীন বিষয়ে এর বেশি বলা সম্ভব নয়।’
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে র্যাবের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা প্রাথমিকভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যেসব তথ্য পেয়েছিলাম এজাহারে সেসব উল্লেখ করেছি। পরবর্তী সব দায়িত্ব তদন্ত কর্মকর্তার। তিনিই ভালো বলতে পারবেন বাকি আসামিদের কেন চার্জশিট থেকে বাদ দেয়া হল।’
মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, কার্টুনিস্ট কিশোর, লেখক মুস্তাক ও দিদারুল ভূঁইয়াকে আটকের সময় তিনটি মোবাইল ফোন, একটি পোর্টেবল হার্ডডিস্ক, দুটি কম্পিউটার, ২০০টি সিডি জব্দ করা হয়।
এ মামলায় গ্রেপ্তার মিনহাজ মান্নান ও দিদারুল ভূঁইয়া গত সেপ্টেম্বরে জামিনে মুক্তি পান। তবে কার্টুনিস্ট কিশোর ও মুস্তাক এখনও কারাগারে।