রাজধানীর মিরপুরে তিতাসের প্রায় দেড় হাজার গ্রাহকের বিলের টাকা জমা না দিয়ে উধাও হওয়া উমর ফারুকের খোঁজ মেলেনি এখনও। ফারুকের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীরা মিরপুর-২ মডেল থানায় মামলা করার পর তার অবস্থান শনাক্ত করতে চলছে পুলিশের অভিযান।
মিরপুর-২ এর ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে তিন বছর আগে ‘ইন্টার্ন ব্যাংকিং এন্ড কমার্স’ নামে একটি এজেন্ট ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান চালু করেন ফারুক। এলাকার প্রায় দেড় হাজার গ্রাহক নিয়মিত এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের বিল দিচ্ছিলেন।
আকস্মিকভাবে গত ২৩ জানুয়ারি ফারুক উধাও হওয়ার পর জানা যায়, বিপুল সংখ্যক গ্রাহকের গ্যাসের বিল দীর্ঘদিন ধরে বকেয়া। আনুমানিক ১০ কোটি টাকার বিল আত্মসাৎ করে উধাও হয়েছেন তিনি। ফারুক পালিয়ে যাওয়ার পরপরই, বিল বকেয়া থাকা গ্রাহকদের ভবনে গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছে তিতাস।
‘ইন্টার্ন ব্যাংকিং এন্ড কমার্স’ কর্ণধার উমর ফারুকের প্রতারণা নিয়ে গত রোববার প্রতিবেদন প্রকাশ করে নিউজবাংলা।
আরও পড়ুন: জালিয়াতের ‘রাজা’ ফারুক, হতবাক দেড় হাজার তিতাস গ্রাহক
ফারুক গা ঢাকা দেয়ার পর কোথায় আছেন, তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে নানান তথ্য।
মিরপুরে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হলেও উমর ফারুক শ্যামলীর ২ নম্বর সড়কের ৩৫/এফ ৬/এ ভবনের আট তলায় পাশাপাশি দুটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলেন। প্রথম পক্ষের নূপুর ও আট বছরের কন্যা সন্তানকে নিয়ে এর একটিতে থাকতেন ফারুক। পাশের ফ্ল্যাটে ছিল অফিস।
ভবনটির সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২৩ জানুয়ারির এক সপ্তাহ আগে গত ১৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় একটি ট্রাকে করে অফিস ও বাসার সব মালামাল সরিয়ে নেন ফারুক। তার একদিন পর স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ফারুক সে বাসা ছেড়ে চলে যান।
শ্যামলীর বাসা থেকে মালামাল সরিয়ে নিতে আনা ট্রাকের পাশে উমর ফারুকঅনুসন্ধানের একপর্যায়ে নিউজবাংলার প্রতিবেদকের সঙ্গে যোগাযোগ হয় ফারুকের অফিস ও বাসার আসবাপত্র তৈরির কারিগর আলমাসের সঙ্গে। আলমাস জানান, ফারুকের কাছে তারও ৯০ হাজার টাকা পাওনা। বিভিন্ন কাজের মজুরি হিসেবে এই টাকা পান তিনি।
আলমাস জানান, ১৬ জানুয়ারি ফারুক তার মালামাল সরিয়ে নেয়ার সময় সন্দেহবশত ট্রাকের ছবি তুলে রাখেন তিনি। ওই ছবি থেকেই ট্রাক চালক জামালের ফোন নম্বর পায় নিউজবাংলা।
জামালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, সেদিন মালামাল নিয়ে নোয়াখালীর বসুরহাট পেরিয়ে একটি গ্রামে গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন ফারুকের একজন কর্মচারি, তবে তার নাম জানা নেই। গভীর রাত ও অপরিচিত এলাকা হওয়ায় সুনির্দিষ্ট করে গন্তব্যের ঠিকানা বলতে পারেননি জামাল।
এর আগে ফারুকের জাতীয় পরিচয়পত্রের অনুলিপি থেকে নিউজবাংলা জানতে পারে উমর ফারুকের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর কবিরহাটের চাপরাশিরহাটে।
সেখানেও অনুসন্ধান চালিয়েছে নিউজবাংলা। এতে দেখা যায়, চাপরাশিরহাটের আফতাব উদ্দিন মিয়াজি বাড়ি নামে পরিচিত বাড়িতেই বড় হয়েছেন ফারুক। তার চাচাত ভাই আলাউদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নয় ভাইবোনের মধ্যে ফারুক সবার ছোট। ২০১১ সালে সে পাশের কোম্পানীগঞ্জের চরকালী এলাকার নূপুরকে বিয়ে করে।’
নোয়াখালী থেকে ২০১১ সালে একটি মোবাইল ফোন কোম্পানির বিপণন কর্মী হিসেবে চাকরি নিয়ে নারায়ণঞ্জ চলে আসেন ফারুক। তবে তার স্ত্রী ও সন্তান গ্রামের বাড়িতেই ছিলেন। এক বছর আগে তাদের ঢাকায় নিয়ে আসেন ফারুক।
নারায়ণগঞ্জে কিছুদিন চাকরির পর ঢাকা এসে ২০১৬ সালে আরেকটি বিয়ে করেন উমর ফারুক। মিরপুরের পূর্ব আহম্মদনগরের যে ভবনে তিনি ওঠেন সেই ভবনের মালিকের মেয়ে নার্গিস আক্তার তার দ্বিতীয় স্ত্রী।
নিউজবাংলার অনুসন্ধানে জানা যায়, ফারুকের প্রথম স্ত্রী গত এক বছর শ্যামলীর ফ্ল্যাটে থাকলেও দ্বিতীয় স্ত্রী নার্গিস থাকতেন মিরপুরের দক্ষিণ পাইকপাড়ার আরেকটি ফ্ল্যাটে।
সেই ভবনের মালিক সুমন জামান নিউজবাংলাকে জানান, এক বছর আগে সাত তলার একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন ফারুক ও তার স্ত্রী। গত ডিসেম্বরে তারা জানান, ফেব্রুয়ারিতে বাসা ছেড়ে দেবেন। তবে হঠাৎ তড়িঘড়ি করে ২৪ জানুয়ারি দুপুরে তারা বাসা ছেড়ে দেন।
ভবনের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ২৪ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টায় মালামাল সরিয়ে নিতে একটি ট্রাক ও কয়েকজন শ্রমিক নিয়ে আসেন নার্গিস। তাকে সহযোগিতা করেন বোন সুলতানা আকতার।
মিরপুরের দক্ষিণ পাইকপাড়ার ফ্ল্যাট থেকে মালামাল সরিয়ে নিচ্ছেন নার্গিসসিসিটিভি ক্যামেরা থেকে পাওয়া শ্রমিকদের ছবি নিয়ে এলাকায় খোঁজখবর নিয়ে পাশের নতুনবাজারে মালেক নামে এক শ্রমিকের সন্ধান পাওয়া যায়। তিনি জানান, নার্গিসের মালামাল পৌঁছে দেয়া হয়েছে তার মিরপুরের পূর্ব আহম্মদনগরে তার স্বামীর বাসার ঠিকানায়।
উমর ফারুককে ৩১ জানুয়ারি প্রতিবেদন করার সময়ে পূর্ব আহম্মদনগরে নার্গিসের স্বামীর বাসায় গিয়েছিলেন নিউজবাংলার প্রতিবেদক। তবে সে সময় ফারদিন নামে এক তরুণ নিউজবাংলাকে জানান, উমর ফারুক তার সৎ বাবা। তার বাবা মারা যাওয়ার পর নার্গিসকে বিয়ে করেন ফারুক। তারা কোথায় আছেন, সেটি ওই ভবনের কারও জানা নেই।
তবে শ্রমিক মালেক নিউজবাংলাকে মঙ্গলবার নিশ্চিত করেন, ওই ভবনেই নার্গিস মালামাল নিয়ে ২৪ জানুয়ারি প্রবেশ করেছেন।
বিষয়টি নিয়ে আবারও তাই ফারদিনের বক্তব্য জানতে চায় নিউজবাংলা। শুরুতে তিনি আবারও দাবি করেন, নার্গিস সেখানে আসেননি। তবে তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরার পর তিনি স্বীকার করেন, নার্গিস এসেছিলেন, তবে কয়েক দিন পর মিরপুরের পাইকপাড়ায় তার (নার্গিস) সৎ মায়ের বাসায় চলে যান।
এরপর পাইকপাড়ার বাসায় গিয়ে পাওয়া যায় নার্গিস ও তার সৎ ভাই শাহিদুল আলম মিনালকে।
নিউজবাংলাকে নার্গিস বলেন, তিনিও ফারুকের প্রতারণার শিকার। উমর ফারুক মূলত মিনালের বন্ধু। ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জে একটি মোবাইল ফোন কোম্পানির বিক্রয় ও বিপণন বিভাগে কাজ করার সময় মিনালের সঙ্গে ফারুকের পরিচয়।
২০১৫ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজে ব্যবসা করার আগ্রহ জানান ফারুক। এরপর মিনাল তার সৎ বোন নার্গিসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তার স্বামীর বাসার নিচের দোকানটি ভাড়া দিতে অনুরোধ করেন।
নার্গিস জানান, তার প্রথম স্বামী ২০১৪ সালে ব্রেইন স্ট্রোকে মারা যান। সেই ঘরে এক মেয়ে ও ছেলে ফারদিন রয়েছে। একপর্যায়ে নার্গিসের সঙ্গে ফারুকের ঘনিষ্ঠতা হয়, ২০১৬ সালে তারা বিয়ে করেন। ফারুকের প্রথম স্ত্রীর কথা তখন জানতেন না নার্গিস।
সন্তানেরা এ বিয়ে মেনে না নেয়ায় এক পর্যায়ে ওই ভবন ছাড়তে বাধ্য হন নার্গিস ও ফারুক। এরপর ফারুক নার্গিসের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা ধার নিয়ে ২০১৭ সালে বারেক মোল্লার মোড়ে ‘ইন্টার্ন ব্যাংকিং এন্ড কমার্স’ নামে এজেন্ট ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান চালু করেন।
নার্গিস আক্তার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ফারুককে বিয়ে করার এক বছর পর জানতে পারি তার আরেক স্ত্রী আছে। আমাকে বিয়ে করার বিষয়টি তার কাছেও সে গোপন রেখেছে। তার আরও অনেক মেয়ের সঙ্গেও সম্পর্ক ছিল, এ নিয়ে আমাদের প্রায়ই ঝগড়া হতো।’
ফারুকের প্রতারণার বিষয়ে জানতে চাইলে নার্গিস বলেন, ‘আমাকে সবসময় দূরে দূরে রেখেছে, তাই তার ব্যবসা সম্পর্কে কিছুই বুঝতাম না। শুধু জানতাম বিল পরিশোধের এজেন্ট। সব ভালোই চলছিল, দুই অফিসে কয়েকজন কর্মচারী ছিল, কিন্তু মাঝে মাঝে তার (ফারুক) মোবাইলে ফোন আসত গ্রাহকদের। বিল জমা হয়নি এমন অভিযোগ করতেন তারা। পরে ফারুক তা সমাধান করে দিত।
‘গত আগস্ট মাসে ফারুক একবার জানায় তার ব্যবসায় দুই কোটি টাকার ঘাটতি আছে। এ নিয়ে সে চিন্তিত। নভেম্বর মাসে আমাকে বলে আর খরচ দিতে পারবে না, আমি যেন বাসা ছেড়ে নিজের বাড়িতে চলে যাই। আমি তখন আমার ১০ লাখ টাকা ফেরত চেয়েছিলাম, কিন্তু সে আমার টাকা নিয়েও চলে গেল।’
নার্গিস বলেন, ‘২১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় সে হঠাৎ বাসায় এসে বলে, তুমি বাসা ছেড়ে তোমার বাড়িতে চলে যাও। আমি এক সপ্তাহ পর তোমার সাথে দেখা করব, কোথায় যাব জানি না। বলেই চলে যায়। তার দুইদিন পর শুনি সব দোকান বন্ধ করে মানুষের টাকা নিয়ে ফারুক পালিয়েছে। আমি ভয় পেয়ে যাই। তখন মালামাল নিয়ে আমার নিজের বাসায় চলে আসি। এরপর থেকে ভয়ে পালিয়ে আছি।’ ফারুক কোথায় আছেন, কত টাকা নিয়ে পালিয়েছেন তার কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন নার্গিস আক্তার।
নিউজবাংলার অনুসন্ধানে জানা যায়, ২১ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার রাতে উমর ফারুক তার প্রথম স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া এলাকায় বড় বোনের বাড়িতে যান। পরদিন বেলা ১টার দিকে স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে নোয়াখালীর নিজ বাড়ি যাওয়ার কথা বলে তিনি বেরিয়ে যান।
নারায়ণগঞ্জে বোনের বাসায় রেখে যাওয়া ফারুকের মোটরসাইকেল।নারায়ণগঞ্জে ফারুকের বড় বোনের ঠিকানাতেও অনুসন্ধান চালিয়েছে নিউজবাংলা। সেখানকার স্বজনেরা জানান, ফারুক তার স্ত্রী সন্তান নিয়ে নিজের মোটরসাইকেলে (ঢাকা মেট্রো হ- ৪২-৯২৫৮) করে এসেছিলেন, পরদিন বেরিয়ে যাওয়ার সময় সেটি রেখে যান।
ওই দিন বিকেলে ফারুকের স্ত্রী নূপুর তার সন্তানকে নিয়ে নোয়াখালীতে স্বামীর গ্রামের বাড়ি পৌঁছালেও তাদের সঙ্গে ফারুক ছিলেন না। এর তিনদিন পর নূপুর তার বাবার বাড়ি যাওয়ার কথা বলে সন্তানকে ওই বাড়ি ছেড়ে যান।
ফারুকের ভগ্নিপতি জসিম উদ্দিন নিউজবাংলাকে জানান, নূপুর আসলে তার বাবার বাড়িতে যাননি। সন্তানসহ তিনি এখন কোথায়, ফারুকের অবস্থানই বা কী, সেটি তাদের কারও জানা নেই।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন নোয়াখালী প্রতিনিধি মোহাম্মদ সোহেল এবং নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি মোহাম্মদ বিল্লাল হোসাইন।