বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পুলিশের তদন্তে খুন, আদালতে হাজির ‘নিহত’

  • বিল্লাল হোসাইন, নারায়ণগঞ্জ   
  • ২ অক্টোবর, ২০২০ ১৪:০৬

ঘর ছেড়েছিলেন মামুন নামে একজন। বাবা করেন হত্যা মামলা। পুলিশ অভিযোগপত্রে হত্যার পর শীতলক্ষ্যায় মরদেহ ফেলে দেওয়ার ‘প্রমাণ’ উপস্থাপন করে। চাক্ষুষ সাক্ষীও জোগাড় করা হয়। পরে তদন্তে যুক্ত হয়ে সিআইডি প্রমাণ পাওয়ার কথা জানায় অপহরণের। তাদের কারণে আসামিরা দীর্ঘসময় কাটিয়েছেন জেলে। তবে মামুন ছয় বছর পর আদালতে এসে জানিয়েছেন, তিনি বাবা মায়ের সঙ্গে অভিমান করে বাসা ছাড়েন।

নারায়ণগঞ্জে আরও একটি হত্যা মামলায় পুলিশের তদন্ত প্রক্রিয়াকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। 

মামুন নামে এক যুবকের হত্যার বর্ণনা দিয়ে প্রথমে থানা পুলিশ, পরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি অপহরণের প্রমাণ পেয়ে আদালতে প্রতিবেদন দেয়। শুরু হয় বিচার। তবে ছয় বছর পর আদালতে হাজির হয়েছেন ওই যুবক।

এক মাসের কিছু বেশি সময়ের মধ্যে নারায়ণগঞ্জে দ্বিতীয়বারের মতো একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে।

এবারের ঘটনায় চার বছর আগে মামুনকে অপহরণ করে হত্যার অভিযোগে ফতুল্লা থানায় মামলা করেছিলেন তার বাবা। পুলিশ তদন্ত করে ছয় জনের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ এনে আদালতে প্রতিবেদন দেয়।

কীভাবে হত্যা করা হয়েছে, আদ্যোপান্ত বর্ণনা উঠে আসে তদন্ত কর্মকর্তার জমা দেয়া সেই তদন্ত প্রতিবেদনে। বলা হয়, আসামি আদালতে জবানবন্দি দিতে রাজি।

পুলিশ আদালতে ‘চাক্ষুষ সাক্ষীও’ হাজির করে। বিচারককে তিনি জানান তার চোখের সামনে ‘কীভাবে ঘটনা ঘটিয়েছেন আসামিরা’। 

পরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ আবার তদন্ত করে। আরও ২৩ মাস তদন্ত শেষে তারাও আদালতের কাছে অপহরণের প্রমাণ হাজির করে প্রতিবেদন দেয়। শুরু হয় বিচার।

তবে যাকে খুন করার অভিযোগ, সেই মামুনের আসলে কিছুই হয়নি। তিনি অভিমান করে পালিয়ে গিয়েছিলেন। আর অভিমান কাটলে কয়েক বছর পর ঘরে ফেরেন।

শুনানি চলাকালে মামুন নিজেই বুধবার হাজির হন বিচারকের সামনে। শুরু হয় বাদী ও বিবাদী পক্ষের হট্টগোল। পরিস্থিতি শান্ত করেন আইনজীবীরা।

একই রকম আরেক ঘটনায় সম্প্রতি এক কিশোরীকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগ এনে আদালতে স্বীকারোক্তি দেন নারায়ণগঞ্জের তিন যুবক। পরে জানা যায়, ওই কিশোরী পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছেন। বর্তমানে তিনি বাড়িতে। 

এই ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তা বরখাস্ত হয়েছেন। ঘটনার ব্যাখ্যা চেয়েছে হাইকোর্ট। এর রেশ না কাটতেই দ্বিতীয় ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের আইন অঙ্গনে শুরু হয়েছে তোলপাড়।

মামুন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কেউ অপহরণ করেনি। মামলা আমি করিনি, আমার বাবা করেছে। বাবা-মা আমাকে কাজের কথা বলছে তাই বাবা-মায়ের সঙ্গে অভিমান করে চলে গিয়েছিলাম।’

মামুনের বাবার করা মামলায় প্রধান আসামি তাসলিমা নামে এক পোশাক শ্রমিক। তিনি বলেন, ‘প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল; রাজি হই নাই দেখে তারা আমার উপর অত্যাচার করে। তারপর আমরা ঢাকায় আসি। আমরা ওকে ফোন করি নাই। আমার ভাইবোন কেউ ওকে ফোন করে নাই। তারা মামুনকে অপহরণ ও খুনের অপবাদ দিয়েছে। তারা আমার জীবন থেকে অনেকগুলো বছর নষ্ট করেছে। আমি এর বিচার চাই।’

বাদীসহ সংশ্লিষ্টদের শাস্তি ও ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে আসামিপক্ষ। আইনজীবী এমদাদ হোসেন সোহেল বলেন, ‘তাসলিমাকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা নির্যাতন করে জবানবন্দি নেয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি কোনো তদন্ত না করেই প্রতিবেদন দিয়েছেন, সেই বিষয়ে আদালতকে অবগত করেছি।’

নারায়ণগঞ্জ সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (এসপি) নাসির উদ্দীন বলেন, ‘সিআইডির তদন্তে যদি কোনো গাফিলতি থাকে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

মিথ্যা মামলাকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের সরকারি কৌঁসুলি ওয়াজেদ আলী খোকন। বলেন, ‘মামলার বিষয়ে জেলা ও দায়রা জজ এবং পুলিশের আদালত পরিদর্শককে জানানো হবে। বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোস্তাফিজুর রহমান জানান, মামলাটির সার্বিক তথ্য সংগ্রহ করছেন তারা। পরে বিস্তারিত জানাবেন।

 

যা ঘটেছে

২০১৬ সালে চাঁদপুরের মতলবের আবুল কালাম তার ছেলেকে হত্যার অভিযোগ এনে ফতুল্লা থানায় মামলা করেন। আসামি করা হয় পোশাককর্মী তাসলিমা, তার বাবা রহমত উল্লাহ, ভাই রফিক, খালাতো ভাই সাগর, সোহেল ও ছাত্তার মোল্লাকে।

মামলায় বাদী বলেন, তাসলিমার সঙ্গে তার ছেলের মামুনের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। এ সম্পর্কের জেরে মামুন ২০১৪ সালে নিখোঁজ হন ও ২০১৬ সালের ৯ মে ছেলেকে অপহরণ করে হত্যার উদ্দেশ্যে গুম করা হয়েছে।

পরে ছয় জন আসামিই গ্রেপ্তার হন। তাসলিমা কারাগারে থাকেন সবচেয়ে বেশি, দেড় বছরের মতো। রিমান্ডেও নেয়া হয়। সোহেলের রিমান্ড শেষে ২০১৬ সালের ১৪ মে তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক মিজানুর রহমান আদালতে প্রতিবেদন দেন।

এতে তিনি লেখেন, ‘উক্ত আসামি গত ১০/০৫/২০১৪ তারিখ সকাল অনুমান ৯ ঘটিকার সময় বাদীর ছেলে মামুনকে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ভিকটিম মামুনকে ঘটনাস্থল লামাপাড়াস্থ হাজী সালাউদ্দিন মিয়ার বাড়ির নিচতলার ১২ নম্বর কক্ষের বাসায় ডাকিয়া আনিয়া উল্লেখিত আসামিসহ তাদের সহযোগী অপরাপর আসামিদের নিয়ে কৌশলে শ্বাসরুদ্ধ করিয়া হত্যা করত লাশ গুম করিয়া শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলিয়া দিয়াছে মর্মে তদন্তকালে জানা গেছে।’

আসামি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিতে রাজি হয়েছেন উল্লেখ করেন তদন্ত কর্মকর্তা।

শেষ পর্যন্ত ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেননি সোহেল। তবে পুলিশ আদালতে মাকসুদা বেগম নামে একজনকে হাজির করে। তিনি মামুন হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়ে কীভাবে ঘটনাটি ঘটেছে তার বর্ণনা দিয়ে আদালতে জবানবন্দি দেন।

মামুনের মরদেহ না পাওয়ায় পরে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় সিআইডিকে। 

প্রায় দুই বছর তদন্ত শেষে গত ১৮ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে প্রতিবেদন দেন উপপরিদর্শক জিয়াউদ্দিন উজ্জ্বল। তিনি ছয় আসামির বিরুদ্ধে শুধু অপহরণের অভিযোগ আনেন।

আদালত অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে ফতুল্লার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে পাঠায়। সেখানেই এখন এর বিচার চলছে।

তদন্তের দুর্বলতা নিয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, ‘অপহরণের মামলায় অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হয়। পরে আসামিদের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দির আবেদন করে বিজ্ঞ আদালতে পাঠাই। কিন্তু আসামিরা ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়নি। পরর্তীতে মামলার সাক্ষী মাকসুদা বেগম আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। সেখানে তিনি বলেছেন, আসামিরা মামুনকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে শীতলক্ষ্যা নদীতে লাশ ফেলে দিয়েছে। তবে আমরা মামুনের লাশ পাই নাই ও তাকে উদ্ধারও করতে পারি নাই।’

‘আসামিদের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি করাতে না পারায় উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মামলাটি ডিবিতে হস্তান্তর করে। ডিবি পুলিশও তদন্ত করে মামুনের সন্ধান করতে পারে নাই। পরে পুলিশ হেড কোয়ার্টার থেকে মামলাটি সিআইডিতে পাঠানো হয়। সিআইডি তদন্ত করে মামলার চার্জশিট দিয়েছে।’

অপহরণের প্রমাণ কীভাবে পেলেন, জানতে চাইলে সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা জিয়াউদ্দিন উজ্জ্বল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আসামিরা ফোন করে মামুনকে ডেকে নিয়ে গেছে। তাদের পারিপার্শ্বিক বিষয়ে তদন্ত করা হয়েছে। মামলার একজন সাক্ষী আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনিসহ অন্য সাক্ষীদের পাওয়া তথ্যে চার্জশিট দিয়েছি।’ 

এমন ঘটনা নতুন নয়

আগস্টের শেষেও এমন একটি ঘটনা ঘটে নারায়ণগঞ্জেই। তদন্ত কর্মকর্তা নিজে এখন তদন্তের মুখে।গত ৪ জুলাই একটি কিশোরীকে অপহরণের অভিযোগ এনে মামলার পর পুলিশ রকিব, খলিল ও আব্দুল্লাহ নামে তিন জনকে গ্রেফতার করে।

তারা আদালতে মেয়েটিকে ধর্ষণের পর হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়ার কথা স্বীকার করেন। তবে গত ২৩ আগস্ট কিশোরীটিকে ফিরে পায় তার পরিবার।

বিষয়টি নিয়ে শুরু হয় তুমুল আলোচনা। জামিনে মুক্তি পেয়ে যুবকরা জানান, তাদেরকে রিমান্ডে পেটানো হয়েছে। নির্যাতন থেকে বাঁচতেই পুলিশের শিখিয়ে দেয়া কথা আদালতে বলেন।

পরে জানা যায়, নির্যাতন না করার শর্ত দিয়ে তিন যুবকের স্বজনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলেন তদন্ত কর্মকর্তা শামীম আল মামুন। প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে সে টাকা তিনি ফেরতও দিয়েছেন।

এই ঘটনায় পুলিশের তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায়ের যে অভিযোগ আছে, সেটি আবার সামনে আসে। এই ঘটনায় চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছেন উপপরিদর্শক শামীম আল মামুন। 

এ বিভাগের আরো খবর