যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির নির্বাচনি পরীক্ষার একটি প্রশ্নপত্র ছড়িয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
সৃজনশীল এই প্রশ্নপত্রের প্রথম উদ্দীপকে বলা হয়েছে, ‘রহমান সাহেবের বয়স ৫০ বছর। তিনি সবসময়ই তার ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড নিয়ে টেনশনে থাকেন। একদিন হঠাৎ তার বুকের মাঝখানে কিছুটা বামদিকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করেন এবং প্রচুর ঘামতে থাকেন। দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিলে ডাক্তার তাকে ইসিজি করাতে বলেন এবং আপাতত বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা দেখা থেকে বিরত থাকতে বলেন।‘
এই উদ্দীপকের আলোকে করা প্রশ্নগুলো হচ্ছে-
ক) স্ট্রোক কী?
খ) ধমনী ও শিরার মধ্যে ৪টি পার্থক্য লিখ।
গ) রহমান সাহেবের বুকে এমন ব্যথা হওয়ার সম্ভাব্য কারণ ব্যাখ্যা করো।
ঘ) “প্রতিকার অপেক্ষা প্রতিরোধ উত্তম।"- রহমান সাহেবের সমস্যার আলোকে বিশ্লেষণ করো।
এই উদ্দীপকে বুকে ব্যথার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে স্ট্রোককে ইঙ্গিত ও এটি পরীক্ষায় চিকিৎসকের ইসিজি করানোর কথা বলা হয়েছে। তবে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন স্ট্রোকের সঙ্গে হৃদরোগের সম্পর্ক নেই এবং কেউ স্ট্রোকে আক্রান্ত বলে সন্দেহ করা হলে সেটি ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম বা ইসিজির মাধ্যমে নির্ণয় করা হয় না।
তারা বলছেন হৃদযন্ত্র বিকল বা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট এবং হার্ট অ্যাটাকের বিষয়টি নিশ্চিত হতে ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম (ইসিজি), ইকোকার্ডিওগ্রাম বা ইকোর মতো পরীক্ষা করা হয়। হার্ট অ্যাটাকসহ হৃদযন্ত্রের আরও কিছু জটিলতায় রোগী বুকে ব্যথা অনুভব করতে পারেন। এ ছাড়া গ্যাস্ট্রিকসহ বিভিন্ন কারণেও বুকে ব্যথা হতে পারে, তবে স্ট্রোকের কারণে বুকে ব্যথা অনুভবের সুযোগ নেই।
আমেরিকার অলাভজনক অ্যাকাডেমিক মেডিক্যাল সেন্টার মায়ো ক্লিনিকের তথ্য অনুযায়ী, হৃৎপিণ্ডে রক্তের প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে গেলে বা বন্ধ হয়ে গেলে হার্ট অ্যাটাক হয়। সাধারণত হৃৎপিণ্ডের (করোনারি) ধমনিতে চর্বি, কোলেস্টেরল এবং অন্যান্য পদার্থ জমা হওয়ার কারণে হয় রক্তপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়।
হার্ট অ্যাটাকের সাধারণ লক্ষণের মধ্যে রয়েছে, বুকে চাপ দিয়ে বসা ব্যথা; ব্যথার পাশাপাশি অস্বস্তি যা কাঁধ, বাহু, পিঠ, ঘাড়, চোয়াল, দাঁত বা কখনও কখনও পেটে ওপরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে; ঠান্ডা ঘাম; ক্লান্তি অথবা বদহজম। হার্ট অ্যাটাক হলে হালকা মাথাব্যথা বা হঠাৎ মাথা ঘোরার অনুভূতিও তৈরি হতে পারে। এ ছাড়া, বমি বমি ভাব ও নিশ্বাসের দুর্বলতা দেখা যেতে পারে বলেও জানাচ্ছে মায়ো ক্লিনিক।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল হার্ট, লাংস অ্যান্ড ব্লাড ইনস্টিটিউটের (এনআইএইচ) তথ্য অনুযায়ী, হৃৎপিণ্ড আকস্মিকভাবে রক্ত পাম্প করা বন্ধ করে দিলে সে অবস্থাকে বলা হয় কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। হৃৎপিণ্ডের এই বিকল অবস্থায় মস্তিষ্ক এবং দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। হাসপাতালের বাইরে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে আক্রান্ত প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই কয়েক মিনিটের মধ্যে মারা যান।
কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে আক্রান্ত ব্যক্তির লক্ষণ হলো তিনি হঠাৎ চেতনা হারিয়ে ফেলেন, শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যাহত হতে পারে এবং বাতাসের জন্য তিনি তড়পাতে শুরু করেন; চিৎকার বা ঝাঁকুনিতে সাড়া দেন না এবং ধমনি নিশ্চল হয়ে যেতে পারে।
আর স্ট্রোক সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) বলছে, স্ট্রোককে কখনও কখনও ব্রেন অ্যাটাক হিসেবেও বলা হয়। এমন অবস্থায় মস্তিষ্কের কিছু অংশে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় অথবা মস্তিষ্কের কোনো রক্তনালী ছিঁড়ে যায়। স্ট্রোকের ফলে মস্তিষ্কের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি, দীর্ঘমেয়াদি অক্ষমতা বা এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।
স্ট্রোকের লক্ষণ হিসেবে সিডিসি বলছে, মুখ, বাহু বা পা, বিশেষ করে শরীরের এক পাশ হঠাৎ অসাড় বা দুর্বল হয়ে যেতে পারে; হঠাৎ কথা বলতে সমস্যা হতে পারে; হঠাৎ এক বা দুই চোখেই দেখার সমস্যা তৈরি হতে পারে; হঠাৎ হাঁটতে সমস্যা, মাথা ঘোরা, ভারসাম্য হারানোর মতো অনুভূতি তৈরি হতে পারে বা কোনো হঠাৎ তীব্র মাথাব্যথা হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাক বা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট সম্পূর্ণ আলাদা রোগ, হৃদরোগের সঙ্গে স্ট্রোকের সম্পর্ক নেই এবং স্ট্রোকের কারণে হৃদযন্ত্রজনিত বুকে ব্যথা হওয়ারও কোনো কারণ নেই। স্ট্রোক শনাক্তের জন্য ইসিজি বা ইকোর পরামর্শও দেন না চিকিৎসকরা।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক নাজিবুর রহমান খন্দকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাক বা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট আলাদা বিষয়।’
‘স্ট্রোক হচ্ছে ব্রেনে যদি কোনো সমস্যা হয়; যেমন ধরুন ব্রেনে ব্লাড সাপ্লাই কমে গেল, ব্রেনে ব্লিডিং হলো। এতে রোগীর একদিক প্যারালাইজড হয়ে যায় বা মুখ বাঁকা হয়ে যায়। অনেকে পুরো অজ্ঞান হয়ে যাবে। এটাকে স্ট্রোক বলা হয়।’
ডা. নাজিবুর রহমান বলেন, ‘অন্যদিকে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হচ্ছে হার্ট হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যাবে। ব্রেন স্ট্রোক হলে রোগী সঙ্গে সঙ্গে মারা যান না, তবে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে তার বুকে তাৎক্ষণিক ম্যাসাজ দিতে হয়। রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে মনিটর বসিয়ে কারেন্ট শক দিয়ে হার্টের ফাংশনটা নরমালে আনা গেলে তিনি বাঁচবেন। হার্ট তিন থেকে চার সেকেন্ড বন্ধ থাকলে ব্রেনে ব্লাড সাপ্লাই যাবে না, তখন রোগী সঙ্গে সঙ্গে মারা যাবে।’
কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের সঙ্গে ব্রেনের সম্পর্ক আছে, তবে স্ট্রোকের সঙ্গে হৃদযন্ত্রের কোনো সম্পর্ক নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মূলত হাইপ্রেসার, ডায়াবেটিস এসব কারণে ব্রেন স্ট্রোক হয়।’
তিনি বলেন, ‘ইজিসি, ইকো এগুলো সব হার্টের টেস্ট। এর সঙ্গে স্ট্রোকের সম্পর্ক নেই। স্ট্রোকের জন্য করতে হবে সিটিস্ক্যান বা এমআরআই।’
আলোচিত প্রশ্নটি নিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রশ্নটা সুন্দর হয়নি। রক্তনালী চিকন হয়ে গেলে অথবা ছিঁড়ে গেলে স্ট্রোক হতে পারে। ব্রেন স্ট্রোক হলে রোগী প্যারালাইজড হবে, মুখে খেতে পারবে না।’
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের হেমাটোলজিস্ট বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হার্টের রক্তনালী বন্ধ হয়ে গেলে হার্ট অ্যাটাক হয়। হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস এবং অতিরিক্ত ধূমপানে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।
‘স্ট্রোক হয় ব্রেন অর্থাৎ মস্তিষ্কে। সাধারণত দুই ধরনের স্ট্রোক রয়েছে। একটি মস্তিষ্কের রক্ত জমাটবাঁধা এবং আরেকটি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোক। দুই কারণেই মস্তিষ্কের কিছু অংশ ঠিকমতো কাজ করতে পারে না।’
তবে যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ মনে করছে প্রশ্নপত্রে কোনো ভুল নেই।
প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) মরিয়ম বেগম সোমবার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি প্রশ্ন দেখেছি। এটায় কোনো সমস্যা নেই। এটা বই রিলেটেড।’
স্ট্রোক হৃদযন্ত্র-সম্পর্কিত কোনো রোগ নয় জানানো হলেও তিনি বলেন, ‘বুকে ব্যথা থেকেই তো স্ট্রোক হয়। এইগুলা ফোনে আলাপের মতো বিষয় নয়। আপনি স্কুলে এসে আমার ওই বিষয়ের শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলেন।’