বিভিন্ন দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেছেন খুকৃবির (খুকৃবি) ৩০ জন শিক্ষক। এর মধ্যে রয়েছেন ২৩ জন বিভাগীয় প্রধান, চারজন হল প্রাধ্যক্ষ এবং তিনজন আইকিউএসি সেলের প্রধান।
মঙ্গলবার (৫ ডিসেম্বর) বিকেলে শিক্ষক সমিতির কাছে তারা নিজেদের পদত্যাগের বিষয়টি অবহিত করেন। বুধবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের কাছে পদত্যাগপত্রগুলো জমা দিতে যান।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার খন্দকার মাজহারুল আনোয়ার বলেন, ‘শিক্ষক সমিতি থেকে সবার পদত্যাগপত্র নিয়ে আসা হয়েছিল। এতগুলো পদত্যাগপত্র নিতে ঝামেলা হওয়ায় একটি ফরোয়াডিং লেটার দিয়ে পদত্যাগপত্রগুলো পাঠাতে বলা হয়েছে।’
মঙ্গলবার সকাল থেকে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ করে কর্মবিরতি শুরু করেন শিক্ষকরা। এ নিয়ে শিক্ষকদের দ্বিতীয় দফা আন্দোলন শুরু হয়। এর আগে গত অক্টোবরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা দ্রুত পাওয়ার দাবিতে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রেখে আন্দোলন করেছিলেন তারা। এবার শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে।
শিক্ষকদের দাবি, খুকৃবির চলমান সঙ্কট নিরসনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সুস্পষ্ট কিছু নির্দেশনা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে পাঠানো হয়। ওই নির্দেশনা মেনে নিয়েছিলেন শিক্ষকরা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে ওই নির্দেশনা হুবহু না মেনে নিজেদের মত করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে ৩৮ জন শিক্ষকের পদোন্নতি আটকে গেছে।
খুকৃবির শিক্ষক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক বিদ্যুৎ মাতুব্বর বলেন, ‘৩২ জন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা না মানায় বিভিন্ন পদের ৩০ জনই শিক্ষক সমিতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। ওই পদত্যাগপত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি।’
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নিয়ম বহির্ভূতভাবে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়েছে- এমন অভিযোগে ৭৩ শিক্ষকের চাকরি বাতিলের নির্দেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তদন্তের প্রেক্ষিতে ওই নির্দেশনা দেয়া হয়। গত জুন মাসে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে নিয়োগের ব্যাপারটি পুনরায় তদন্ত করার জন্য আবেদন করেন শিক্ষকরা। আবেদনের প্রেক্ষিতে আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গত ৬ নভেম্বর পুনরায় তদন্তের প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ওই নির্দেশনা পরিপালন করে অগ্রগতি প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য বলা হয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার মধ্যে ছিল- খুকৃবির প্রথম ও সাবেক উপাচার্য মো. শহীদুর রহমান খানের ছেলে-মেয়েসহ ৬ স্বজনের নিয়োগ বাতিল করা। এর মধ্যে একজন শিক্ষক এবং ৫ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছেন।
নির্দেশনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৩ শিক্ষকের নিয়োগ বাতিলের জন্য আগের যে নির্দেশনা ছিল তার মধ্যে শুধু সাবেক উপাচার্যের মেয়ে ছাড়া সবার ক্ষেত্রে তা স্থগিত করা হয়। তবে নিয়োগ বাতিলের সিদ্ধান্ত বাতিল হলেও ২৪ শিক্ষকের পদোন্নতি স্থগিত ও এক শিক্ষকের পদোন্নতি বাতিল, একজন শিক্ষকের পদাবনতি করা হয়। আর অন্য ৪৬ জন শিক্ষক ও ৩ কর্মচারীর নিয়োগের বিষয়ে অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয়।
যে ২৪ জন শিক্ষকের পদোন্নতি স্থগিত রাখা হয়, তার মধ্যে রয়েছেন ২০ জন প্রভাষক ও ৪ জন সহকারী অধ্যাপক। ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর জার্নালে প্রয়োজনীয় সংখ্যক আর্টিকেলের মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কমপক্ষে একটি আর্টিকেল প্রথম লেখক হিসেবে প্রকাশ না হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ওই ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওই নির্দেশনা পুরোপুরি পরিপালন করার দাবি করছেন শিক্ষকরা।
খুকৃবির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওই নির্দেশনা পরিপালনের জন্য তা সিন্ডিকেটের ১৪তম সভায় তোলা হয়। গত ১৮ নভেম্বর ওই সিন্ডিকেট সভা অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় যাদের চাকরি বাতিলের কথা বলা হয়েছিল তারা উচ্চ আদালতে মামলা করেছেন। এ কারণে ওই ব্যাপারটি নিয়ে সিন্ডিকেট সভায় কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। নির্দেশনার অন্য দুটি সিদ্ধান্ত সিন্ডিকেট সভা নিজেদের মতো করে নিয়ে মন্ত্রণালয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন পাঠিয়ে দেয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে খুকৃবির উপাচার্য অধ্যাপক আবুল কাশেম চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম হলো, কোনো কিছু পাস করতে হলে তা সিন্ডিকেট সভায় অনুমোদিত হতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার মধ্যে চারটি ধারা ও চারটি উপধারা ছিল। যে নির্দেশনায় চাকরি বাতিলের কথা বলা হয়েছিল, মামলা থাকায় সেখানে সিন্ডিকেট সদস্যরা কোনো সিদ্ধান্ত দেননি। দুটি নির্দেশনা বাদে অন্য সবগুলো নির্দেশনা হুবহু পরিপালন করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আশিকুল আলমের পদাবনতির ব্যাপারটিতে তদন্তের জন্য নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কারণে তিনি সব শিক্ষকদের বুঝিয়ে পদত্যাগে উদ্বুদ্ধ করেছেন।’
খুকৃবির প্রথম উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক মো. শহীদুর রহমান খান বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে। তার চার বছর মেয়াদে অনুমোদন পাওয়া ৪৪৭ পদের মধ্যে ছেলে-মেয়ে, শ্যালক, ভাতিজাসহ ৪২৬ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়োগ বাড়াতে চার বছরে পাঁচ অনুষদের ৪৩ বিভাগ চালু করা হয়।
নিয়োগে অনিয়ম দেখে ২০২০ সালের ২৪ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন সিন্ডিকেটের পাঁচ সদস্য। চিঠিতে তারা লিখেছিলেন, ‘খুকৃবিতে নিয়োগের শুরু থেকেই অস্বচ্ছতা ও আত্মীয়করণ দেখা যাচ্ছে। বিষয়টির যথাযথ তদন্ত করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়টিকে অদক্ষ জনবল ও আত্মীয়করণের হাত থেকে রক্ষায় ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।’
নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে একের পর এক অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় ২০২০ সালের নভেম্বরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তদন্ত কমিটি করে ইউজিসি। এক বছরের বেশি সময় পর তদন্ত কমিটি ২০২২ সালের ২৩ জানুয়ারি প্রতিবেদন জমা দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ৩ আগস্ট উপাচার্যের ছেলে-মেয়েসহ ৯ স্বজন ও ৭৩ শিক্ষকের নিয়োগ বাতিলের নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়। এর আগে অনিয়ম হওয়ায় কয়েক দফা নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ রাখতে চিঠি দিয়েছিল ইউজিসি।