শিক্ষক-কর্মচারী মিলে বিদ্যালয়টির চাকুরে সাকল্যে চারজন। আর শিক্ষার্থীর সংখ্যাটা ৪৫। তবে এসব শিক্ষার্থীও বলতে গেলে নামেই। কেননা ওদেরকে শিক্ষাদানের জন্য বিদ্যালয়ে দপ্তরি কাম প্রহরী ছাড়া আর কেউই বলতে গেলে উপস্থিত থাকেন না। তিনজন শিক্ষক সপ্তাহে একবার স্কুলে গিয়ে হাজিরাটা দিয়ে আসেন মাত্র। শিক্ষার্থীদের উপস্থিত দেখাতে শিক্ষকরাই ছাত্র-ছাত্রীদের হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে দেন।
এটি নিছক কোনো বানানো গল্প নয়। বাস্তবিক এভাবেই চলছে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত চর কাপাসিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। মা-বাপ ছাড়া সন্তানের মতোই অনাদর-অবহেলার শিকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি।
উপজেলা শহর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে বিদ্যালয়টির অবস্থান হওয়ায় শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজর নেই। বলা যায়, বিদ্যালয়টির ব্যাপারে তাদের কোনো মাথাব্যথাই নেই। এমনকি বিদ্যালয়ের এমন হালের কথা নাকি জানেনই না উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা!
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এমন গা-ছাড়া আচরণের সুযোগ নিয়ে চলেছেন শিক্ষকরা। দপ্তরি কাম প্রহরীও যেন অনেকটা ঠেকায় পড়ে স্কুলে আসেন। কেননা তার রাতে থাকার আবাস এই স্কুল ঘর। শিক্ষকদের এমন চরম দায়িত্বহীনতার খেসারত দিতে হচ্ছে বিদ্যালয়টির কোমলমতি শিক্ষার্থীদের।
সোমবার (৯ অক্টোবর) স্কুলটির ব্যাপারে অভিযোগ শুনে সত্যান্বেষণে যায় নিউজবাংলা। গিয়ে অভিযোগের সত্যতা তো মেলেই, সঙ্গে দেখা যায় আরও কিছু অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা।
বিদ্যালয়ে অনুমিতভাবেই কোনো শিক্ষক বা শিক্ষার্থী ছিলেন না। জাতীয় পতাকা টানানোর ফুরসতও হয়নি দপ্তরির। নির্জনের কোনো হানা বাড়ির মতো পড়ে আছে বিদ্যালয়টি। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ভাঙা ঘরের আসবাবপত্র, কাশিয়ার (এক ধরনের বড় ঘাস) মূল ও অন্যান্য আবর্জনায় ভর্তি।
কাশবনের মাঝে ঘাস আর আবর্জনায় ভর্তি বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। ছবি: নিউজবাংলা
বেলা ১১টার দিকে হেলতে-দুলতে স্কুলে আসেন দপ্তরি। এসে একটি কক্ষ খুলে জাতীয় পতাকা টানান তিনি।
দপ্তরির পিছু পিছু বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় এ প্রতিবেদকের। কোথায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী? বেঞ্চের ওপর রাজ্যের ধূলা, একটি কক্ষের বেঞ্চের ওপর তো স্তূপ করে রাখা হয়েছে ভাঙা টিন, কাঠ আর বাঁশের টুকরো।
একমাত্র অফিস কক্ষটির অবস্থাও তথৈবচ। চেয়ার-টেবিল এলোমেলো। বেশ কিছুদিন যে সেখানে মানুষের পা পড়েনি, মেঝে ও চেয়ার-টেবিলের ওপর জমা ধূলার আস্তর দেখে তা বেশ বোঝা যায়।
শ্রেণিকক্ষে ভাঙা টিন, কাঠ ও বাঁশের টুকরোর স্তূপ। ছবি: নিউজবাংলা
আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা হলে জানা যায়, ২০২১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর হঠাৎ বিদ্যালয়টি পরিদর্শনে আসেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন। ওইদিন বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের অনুপস্থিতি, সামগ্রিক কার্যক্রমে অবহেলা ও বিভিন্ন অসঙ্গিত ধরা পড়ে মন্ত্রীর চোখে। ফলে ‘সাময়িক’ অব্যাহতি দেয়া হয় প্রধান শিক্ষক হুজ্জাজুল ইসলামকে। তবে দু’বছর পেরুলেও প্রধান শিক্ষকের সেই ‘সাময়িক অব্যাহতি’ আজও চলছে।
বর্তমানে এই বিদ্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন সহকারী শিক্ষক নুরুল হুদা সরকার।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি অক্টোবরের ৯ তারিখ পর্যন্ত বিদ্যালয়ে উপস্থিত হননি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নুরুল হুদা। হাজিরা খাতায় এই সময়ের কোনো স্বাক্ষর তার ছিল না। একমাত্র সহকারী শিক্ষক আবু তাহের সরকার অবশ্য অক্টোবরের প্রথম দুদিন হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেছেন। তবে পরের দিনগুলোতে আর সেটা করে ওঠা হয়নি তার।
শিক্ষার্থীদের হাজিরা খাতা খুলে দেখা যায়, বিদ্যালয়টিতে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৫ জন। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে ৬, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ১২, তৃতীয় শ্রেণিতে ১০, চতুর্থ শ্রেণিতে ১০ ও পঞ্চম শ্রেণিতে ৭ জন শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে। ৯ অক্টোবর পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা সবাই বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত।
অফিস ঘরটি ব্যবহার না করায় হচ্ছে মলিন। ছবি: নিউজবাংলা
বিদ্যালয়টি নিয়ে কথা বলতে গেলে এই প্রতিবেদকের ওপর ক্ষোভ ঝাড়েন স্থানীয়রা। তারা জানান, এই বিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষকই নিয়মিত স্কুলে আসেন না। তারা হঠাৎ দুই-একদিন স্কুলে আসেন। এ কারণে শিক্ষার্থীরাও আর স্কুলে যায় না। শিক্ষকরা যদি হঠাৎ আসেন, তাহলে তারা জানবে কীভাবে? ফলে তাদের পড়ালেখা শিকেয় উঠেছে, ঝরে পড়ছে অনেক শিক্ষার্থী। অথচ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে যাতায়াতে লাখ টাকা ব্যয়ে তৈরি করা হয়েছে বড় নৌকা।
বিদ্যালয়ের এমন দুরবস্থার জন্য উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট ক্লাস্টারের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের দায়ী করেছেন স্থানীয় সচেতন ব্যক্তিরা। তারা বলেন, ‘বিদ্যালয়টি পরিচালনায় শিক্ষকদের অনুপস্থিতি, চরম অবহেলা, অনিয়ম ও নানা অসঙ্গিতর অভিযোগে মন্ত্রী যেখানে প্রধান শিক্ষককে অব্যাহতি দিলেন, তারপরও কারও টনক নড়েনি। আগের মতোই অনিয়ম-অবহেলা করে যাচ্ছেন বাকি দুই শিক্ষক।’
দেশের অন্য সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো এই বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির দাবি জানিয়েছেন তারা। ওই এলাকার শিক্ষার্থীদের শিক্ষা অর্জনের পথ সুগম করতে তারা আবারও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
শিক্ষকদের নিয়মিত বিদ্যালয়ে না আসার অভিযোগটি অকপটে স্বীকার করেন বিদ্যালয়ের দপ্তরি কাম প্রহরী তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘স্যারেরা মূলত সপ্তাহে দুই-একদিন বিদ্যালয়ে আসেন। স্কুলটি নদীবেষ্টিত হওয়ায় শিক্ষার্থীরাও এখানে আসতে ভয় পায়।’
সেপ্টেম্বরে স্বাক্ষর থাকলেও অক্টোবরে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করার সময় পাননি শিক্ষকরা। ছবি: নিউজবাংলা
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয় বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নুরুল হুদা সরকারের সঙ্গে। অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করতেই প্রসঙ্গ ঘোরানোর চেষ্টা করেন তিনি। বলেন, ‘আমার চোখে অপারেশন হয়েছে দুদিন হলো। চিকিৎসক আমাকে নড়াচড়া করতে নিষেধ করেছেন।’
তার দাবি, তিনি মৌখিকভাবে’দুই দিনের ছুটিতে আছেন। সহকারী শিক্ষক আবু তাহেরের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ‘বলতে পারছি না’ বলে ফোনের লাইন কেটে দেন তিনি।
এ বিষয়ে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আনোয়ারুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা ছিল না। আসলে আমাকে কেউ জানায়নি।
‘সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে বিষয়টি খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করছি। সত্যতা পাওয়া গেলে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
তবে বিষয়টি নিয়ে গাইবান্ধা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হারুনর রশিদের মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তার মোবাইল নম্বরে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।