বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোয় জোড়াতালি

  •    
  • ১৮ জুন, ২০২২ ০৮:১৩

বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলো পরিদর্শন শেষে যে প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে, যেখানে ৮০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানই নীতিমালা পরিপূর্ণভাবে মানছে না। এর মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ নীতিমালা মানতে প্রায় শতভাগ ব্যর্থ হয়েছে।

দেশে ৭২টি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের অধিকাংশই চলছে জোড়াতালি দিয়ে। কলেজগুলোতে শিক্ষক কম। প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ নেই। অবকাঠামোও দুর্বল। পাঠদান ও চিকিৎসাসেবা দীর্ঘদিন ধরে সংকটে।

সরকার এসব সমস্যা নিরসনে তাগাদা দিলেও মেডিক্যাল কলেজগুলো কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের এক জরিপ প্রতিবেদনে সম্প্রতি এ চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি শিগগিরই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হবে। তবে হাসপাতালগুলো চাইলে এই সংকট নিরসনে কিছুদিন সময় নিতে পারবে।

প্রতিবেদন তৈরির জন্য গত বছরের ১৩ অক্টোবর তথ্য চাওয়া হলেও মাত্র ২৮ প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকিগুলো পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেয়নি। যারা দিয়েছে, তাদের অনেকের নাজুক পরিস্থিতি দেখা গেছে। কলেজগুলোতে জোড়াতালির পাঠদানে মান নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও রোগীদের আস্থা অর্জনে এগুলো ব্যর্থ হচ্ছে।

বেসরকারি মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজে প্রতি ১০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক থাকার বাধ্যবাধকতা রেখে গত বছরের ৩ মে একটি নতুন আইনের খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। গত ৩০ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ‘বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজ বিল-২০২২’ সংসদে তোলেন। বিলটি পরীক্ষা করে সংসদে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়।

ওই বিলে বলা হয়েছে, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ বা ডেন্টাল কলেজের কোনো বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষকের সংখ্যা সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমোদিত পদের ২৫ শতাংশের বেশি রাখা যাবে না। এসব কলেজে অন্তত ৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের জন্য মেট্রোপলিটন এলাকায় কমপক্ষে দুই একর এবং ডেন্টাল কলেজের জন্য এক একর জমি থাকতে হবে।

অন্য এলাকায় এই জমির পরিমাণ চার একর ও দুই একর হতে হবে। এই জমি সংশ্লিষ্ট কলেজের নামে নিরঙ্কুশ, নিষ্কণ্টক, অখণ্ড ও দায়মুক্ত হতে হবে। মেডিক্যাল কলেজ বা ডেন্টাল কলেজ এবং এর অধীন পরিচালিত হাসপাতাল কোনোভাবেই ইজারা বা ভাড়া নেওয়া জমিতে বা ভবনে স্থাপন করা যাবে না।

এই বিল পাস না হওয়া পর্যন্ত বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলো ২০১১ সালের একটি নীতিমালার অধীনে পরিচালিত হচ্ছে।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি মোট ১০৭টি মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে। এগুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য মোট আসন সংখ্যা ১০ হাজার ৬৯৭টি। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ৪ হাজার ৩৫০ এবং বেসরকারি ৭০টি কলেজে ৬ হাজার ৩৪৭টি আসন রয়েছে।

বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোর হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া অধিকাংশের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, শিক্ষক, শিক্ষা উপকরণ, উন্নত মানের ল্যাবরেটরি, শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শেখানোর সুবিধা পর্যাপ্ত নেই। ফলে এগুলো থেকে পাস করা চিকিৎসকদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

কী আছে প্রতিবেদনে?

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিদর্শন প্রতিবেদনের কিছু তথ্য নিউজবাংলার হাতে এসেছে। সেখানে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর তেজগাঁওয়ে বেসরকারি এম এইচ শমরিতা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল পরিদর্শনে যায় অধিদপ্তর। এ পরিদর্শনের আলোকে চলতি বছরের এপ্রিলে একটি মতামত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।

সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ স্থাপন ও পরিচালনা নীতিমালা ২০১১ অনুযায়ী কলেজটি বেশ কিছু আবশ্যকীয় শর্তাবলি পূরণ করেনি। কলেজের একাডেমিক কার্যক্রমের জন্য ৯৫ হাজার বর্গফুট ফ্লোর স্পেস, হাসপাতালের জন্য ৮৫ হাজার বর্গফুট ফ্লোর স্পেস, কলেজ ও হাসপাতালের জন্য ১১৭ দশমিক ৫ শতাংশ জমি এবং ৪১৩টি শয্যার কথা বলা হলেও বাস্তবে এগুলোর ঘাটতি আছে।

এ ছাড়া বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) অধিভুক্তি হালনাগাদ থাকা বাধ্যতামূলক হলেও ২০১২ সালের পর থেকে তা করা হয়নি। ৫৮ শতাংশ বেড অকুপেন্সি ঘাটতিসহ প্রায় সব বিভাগে শিক্ষক, ল্যাব, শ্রেণিকক্ষের সরঞ্জাম, লাইব্রেরির আসন এবং সার্ভিস রুলের ঘাটতি রয়েছে।

পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে যেসব ঘাটতি রয়েছে তা পূরণ করা হয়নি বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে। এসব ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও হাসপাতালটি শিক্ষার্থীর আসন সংখ্যা বাড়ানোর আবেদন করেছে।

প্রতিবেদনে ২০২১ সালের ২৫ নভেম্বর বেসরকারি কিশোরগঞ্জের আবদুল হামিদ মেডিক্যাল কলেজ পরিদর্শনের যে মূল্যায়ন তুলে ধরা হয়েছে, তাতে বলা হয়, সেখানে ৫০ হাজার বর্গফুট ফ্লোর স্পেস এবং হাসপাতালে ১ লাখ ২ হাজার বর্গফুট ফ্লোরস্পেস থাকার কথা থাকলেও তা পাওয়া যায়নি। কাগজে-কলমে রোগীর চিকিৎসার জন্য ২৬০টি শয্যা, ৪৮ শতাংশ বেড অকুপেন্সি, দুটি গ্যালারি, ১২টি টিউটরিয়াল রুম থাকার উল্লেখ থাকলেও এগুলোয় ঘাটতি আছে। কলেজের নামে এক কোটি টাকার স্থায়ী আমানত ও পর্যাপ্ত শিক্ষকের ক্ষেত্রেও ঘাটতি পাওয়া গেছে। ফলে ছয় মাসের মধ্যে এসব শর্ত পূরণ করে পরবর্তী শিক্ষাবর্ষের কার্যক্রমের সুপারিশ করা হয়েছে।

মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর প্রতিষ্ঠিত শ্যামলীর বেসরকারি ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ পরিদর্শন করা হয় ২০১৯ সালের ২৭ এপ্রিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ স্থাপন ও পরিচালনা নীতিমালা না মেনে ভাড়া বাড়িতে কলেজ ও হাসপাতাল কার্যক্রম চালাচ্ছে। আলাদা ক্যাম্পাসে কলেজ ও হাসপাতালে করা হয়েছে। সেখানেও ফ্লোরস্পেস ও জমির ঘাটতি রয়েছে। একইভাবে বিএমডিসির অধিভুক্তি হালনাগাদ, শিক্ষক সংকট, প্রয়োজনীয় বেড অকুপেন্সি রেট, টিউটরিয়াল কক্ষ, গ্রন্থাগারের আসন পর্যাপ্ত নেই। প্রতিষ্ঠানটি ৫০ আসনের মেডিক্যাল কলেজের উপযোগী না হওয়ায় ৯০ আসন থেকে কমিয়ে ন্যূনতম ৫০ আসনে রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। এই অবস্থার উন্নতি না হলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।

২০১৯ সালের ১৩ মে মহাখালীর ইউনিভার্সাল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫০টি আসনের বিপরীতে নীতিমালা অনুযায়ী এই প্রতিষ্ঠানটিও সুযোগ-সুবিধা তৈরি করতে পারেনি। বিগত বছরগুলোতে পর্যাপ্ত ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করতে পারেনি। ফলে কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থী ভর্তিতে আসন বাড়ানোর জন্য অনুমোদন চাইলেও তা দেওয়া হয়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে তিন মাসের মধ্যে মেডিক্যাল কলেজের ১১৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ জমি, শিক্ষক বৃদ্ধি, ক্লাসরুম পরিবর্তন, সার্ভিস রুলের ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে পারলে পরবর্তী শিক্ষাবর্ষের অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে। না হলে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

একই বছর ধানমন্ডি এলাকায় বেসরকারি জয়নুল হক সিকদার উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজে পরিদর্শন প্রতিবেদনে ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে ১১০ জন শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয়। পরে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে কলেজটি পরিদর্শন করা হয়। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ নীতিমালা অনুযায়ী প্রতি ৫০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে কলেজে ১ লাখ বর্গফুট জায়গা প্রয়োজন। এ হিসাবে শুধু ওই শিক্ষাবর্ষের ১১০ জন শিক্ষার্থীর জন্য ২ লাখ ২০ হাজার বর্গফুট ফ্লোরস্পেস দরকার। কিন্তু পরিদর্শন করে দেখা যায়, কলেজটিতে জায়গাসহ ৯৫ হাজার বর্গফুট ফ্লোর স্পেস ঘাটতি রয়েছে। একইভাবে হাসপাতালের কার্যক্রমে ৮৫ হাজার বর্গফুট ফ্লোর স্পেস ঘাটতি আছে।

ফলে ফ্লোরস্পেস বাড়ানো, বিএমডিসির অধিভুক্তি হালনাগাদ, হাসপাতালের লাইসেন্স নবায়নের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ, মিউজিয়াম হতে টিউটরিয়াল রুম পৃথককরণ, গ্রন্থাগারের আসন বাড়ানো ও একাডেমিক পরিবেশের দৃশ্যমান উন্নয়নের শর্তসাপেক্ষে পরবর্তী শিক্ষাবর্ষের অনুমোদনের কথা বলা হয়েছে। ১০০ আসনের বিপরীতে বর্তমান আসন বৃদ্ধির সুপারিশ সম্ভব নয় বলেও উল্লেখ্য করা হয়েছে। পরিস্থিতির উন্নয়ন না হলে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের একাধিক কর্মককর্তা জানান, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ নিয়ে যে প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে, যেখানে ৮০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানই নীতিমালা পরিপূর্ণভাবে মানছে না। এর মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ নীতিমালা মানতে প্রায় শতভাগ ব্যর্থ হয়েছে।

অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. এ কে এম আহসান হাবিব বলেন, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসা শিক্ষা ও সেবার মান উন্নয়নে দফায় দফায় চিঠি দিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য জানানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কয়েক বছরে সাতটি মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তি স্থগিত করা হয়েছে। কিন্তু কলেজগুলো বিভিন্ন সময় উচ্চ আদালতে রিট করে কার্যক্রম চালাচ্ছে। অধিদপ্তর একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশনা দিলেও বিভিন্ন সময় উচ্চপর্যায়ে তদবির চালিয়ে যাচ্ছে। তবে অনেক কলেজ চিকিৎসা শিক্ষাদানে বেশ ভালো করছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও চিকিৎসাসেবা আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক ডা. রশীদ ই মাহবুব বলেন, ‘দেশে আশির দশক থেকে শুরু করে প্রায় ৪০ বছর ধরে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ নিয়ে কথা হচ্ছে। কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য আইন লাগে, যা আজ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। আইন না থাকায় কোনো রকমে একটি নীতিমালা দিয়ে এগুলো পরিচালিত হচ্ছে। ‘ফলে সরকারিভাবে অনুমোদন নিয়ে অধিকাংশই নামকাওয়াস্তে পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম পরিদর্শনে বিএমডিসি, বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকার রয়েছে। এগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ও বিএমডিসির লাইসেন্স ছাড়া প্রায় সব জায়গা প্রশ্নবিদ্ধ। শিক্ষক, অবকাঠামো, মাননিয়ন্ত্রণ কোনোটাই সঠিকভাবে হচ্ছে না। এতে করে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জন করলেও সবাই পেশা জীবনে তা প্রয়োগ করতে পারছে না, দক্ষ হচ্ছে না। প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকা ছাড়া এটা সম্ভব নয়। এ জন্য আইন করে মান নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দিতে হবে।’

এ বিভাগের আরো খবর