তিনি পড়তে ভালোবাসেন। ভীষণ মেধাবী, যাই পড়েছেন, আদ্যোপান্ত জানার চেষ্টা করেছেন। আর জ্ঞানের ক্ষুধা তাকে বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহী করে তুলেছে।
বিচিত্র তার শিক্ষা জীবন। প্রথমে পড়েছেন স্কুলে, পরে মাদ্রাসায়, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ভর্তি প্রথমে ইংরেজি সাহিত্যে, সেখান থেকে পরে বিষয় পাল্টে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে।
মাস্টার্স পাসের পর ইউরোপের দেশ সুইডেনে ইসলামে নারীর ক্ষমতায়নের ওপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেই থেমে যাননি। এর মধ্যে আগ্রহ জন্মে কম্পিউটার প্রযুক্তি নিয়ে পড়বেন। সেভাবে নিলেন প্রস্তুতিও।
আর সেখানেও সফল। ডিগ্রি অর্জন করে এখন কাজ করছেন দেশটির একটি নামকরা আইটি ফার্মে। সেই সঙ্গে আগের বিষয়, ইসলাম নিয়ে লেখালেখি ও গবেষণাও চালিয়ে যাচ্ছেন।
ব্যতিক্রমী শিক্ষা জীবনের এই মানুষটির নাম আব্দুল বাতেন মিয়াজী। কীভাবে তিনি মানবিক বিভাগ থেকে পাস করেও প্রযুক্তিবিদ হয়েছেন, সেই গল্পই তিনি শুনিয়েছেন নিউজবাংলাকে।
গল্পের শুরু চাঁদপুর মতলব উত্তরের আমিয়াপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। এই এলাকাতেই বাড়ি তার। সেই স্কুলে পড়াশোনা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত।
এরপর বাবার ইচ্ছায় ভর্তি হন একই এলাকার বদরপুর আদমিয়া সিনিয়র মাদ্রাসায়। সেখানে তিনি আবার ভর্তি হন প্রথম শ্রেণিতে।
মাদ্রাসায় মিয়াজীর শিক্ষা জীবন শেষ হয়েছে তুলনামূলক দ্রুত। কারণ, তাকে সব শ্রেণিতে পড়তে হয়নি। তিনি এক বছরে দুই প্রমোশন নিয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে ওঠেন। পরের বছরও একইভাবে আবার অটো প্রমোশন পেয়ে ওঠেন পঞ্চম শ্রেণিতে। এরপর মাদ্রাসাশিক্ষার বিশেষ অর্ডিন্যান্স এবং অটো প্রমোশনের কারণে ওঠেন অষ্টম শ্রেণিতে। আর তখনই তার বন্ধুদের সঙ্গে তার পড়াশোনার গ্যাপ কমে যায়।
নবম শ্রেণিতে উঠেই তিনি চলে আসেন ঢাকায়। ভর্তি হন মোহাম্মদপুরের আলিয়া মাদ্রাসা জামেয়া কাদেরারিয়া তৈয়্যবিয়াতে। ১৯৮৬ সালে দাখিল এবং ১৯৮৮ সালে দেন আলিম পরীক্ষা।
এরপর ভর্তি পরীক্ষা দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যথারীতি সেখানেও পাস করেন মিয়াজী। মেধাতালিকায় তার অবস্থান ছিল প্রথম দিকেই।
ইচ্ছা ছিল বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়ার। কারণ, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে জড়িত থাকার সুবাদে সাহিত্য ছিল তার প্রিয় বিষয়।
কিন্তু বাংলায় ভর্তি হতে পারেননি। কারণ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ভর্তি হতে এইচএসসি/আলিমে ২০০ নম্বর থাকতে হয়। কিন্তু আলিম পরীক্ষায় তখন বাংলায় ছিল ১০০ নম্বর। এরপর তিনি সুযোগ পান ইংরেজি সাহিত্যে।
ইংরেজি সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হয়ে তিনি তিন মাস পর বিভাগ পরির্বতন করে যান ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে। স্নাতক শেষ করে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৫ সালে মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ করে সুইডেনের লুন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে যান।
সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শর্ত ছিল প্রথমে এক বছর সুইডিশ ভাষা এবং এরপর আরেকবার মাস্টার্স করতে হবে। তার মাস্টার্সের বিষয় ছিল কম্পারেটিভ রিলিজিয়ন বা তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে।
এরপর তিনি পিএইচডি শুরু করেন ইসলামে নারীর অবস্থান নিয়ে, বিশেষ করে বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন, এনজিওর সঙ্গে ইসলামপন্থি দলগুলোর সংঘর্ষ এবং দেশের প্রচলিত আইনে নারীর মর্যাদা নিয়ে।
সুইডেনে এলেও মিয়াজীর মন সব সময় পড়ে থাকত বাংলাদেশে। তাই প্রতিবছরই তিনি চলে আসতেন বাংলাদেশে, থাকতেন অন্তত তিন মাস। এভাবে চলতে থাকায় পিএইচডি ডিগ্রি শেষ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আর এ সময়ই পিএইচডির প্রতি তার আগ্রহ হারিয়ে যায় এবং ইচ্ছা জাগে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার।
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ক্ষেত্রেও বাংলা সাহিত্যে ভর্তির মতো সমস্যা এসে দাঁড়ায়। কারণ, সেখানে পড়তে লাগে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনার ইতিহাস। কিন্তু তিনি ছিলেন মানবিকে।
তারপরও তিনি ইউনিভার্সিটির মেনটরদের পরামর্শে ভর্তি হন অ্যাডাল্ট এডুকেশনে (বাংলাদেশের উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো)।
এরপর শুরু হয় তার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার যাত্রা। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হলে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথ পড়া ছিল বাধ্যতামূলক। তাই তিনি তিন বিষয়েই ভর্তির চেষ্টা করেন।
কিন্তু এখানেও একই সমস্যা সৃষ্টি হয়। ম্যাথ আর ফিজিক্সে সহজে ভর্তি হলেও কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হতে পারছিলেন না। কারণ সেই আর্টস ব্যাকগ্রাউন্ড। পরে অবশ্য অনেক অনুরোধের পর ভর্তি হন। এখানেও ফলাফলে বাজিমাত করলেন আব্দুল বাতেন মিয়াজী।
এরপর তিনি ভর্তি হন লুন্দ বিশ্ববিদ্যালয়েই লুন্দ টেকনিক্যাল স্কুলে। বিষয় নেন ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি। ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি হওয়ার পর তার শুরু হয় নতুন যুদ্ধ। দিন-রাত ক্লাস আর পড়াশোনা।
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার মাঝেই তিনি ছুটি নিয়ে পিএইচডি করেন। এরপর যোগ দেন একটি প্রজেক্টে রিসার্চ সহযোগী হিসেবে। এরপর চেষ্টা করেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য। কিন্তু নানা জটিলতায় সেই সুযোগ না পেয়ে আবার শুরু করেন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া। কঠোর অধ্যবসায় আর ঐকান্তিক চেষ্টায় ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স শেষ করেন। এরপর যোগ দেন একটি আইটি ফার্মে। সেই থেকে এখনও আছেন আইটি পেশায়।
পেশায় আইটি বিশেষজ্ঞ হলেও মিয়াজী ইসলাম নিয়ে গবেষণাও করছেন। দুই বছরের পর গত রমজানের ঠিক আগেই প্রকাশিত হয় তার পবিত্র কুরআনের বিজ্ঞানময় অনুবাদ ‘ইরফান-উল-কুরআন’ গ্রন্থ। এটি প্রকাশ করে মিনহাজ পাবলিকেশন বাংলাদেশ।
ইরফান-উল-কুরআনের মূল উর্দু অনুবাদক বর্তমান কানাডিয়ান অধ্যাপক ড. তাহির-উল-কাদরী।
ড. মিয়াজীর আরও কিছু ইসলামি বই প্রকাশের অপেক্ষায়। তিনি নিয়মিত লেখালেখি করেন তার নিজস্ব ব্লগ drmiaji.com-এ।