গত এক দশকে জমা দেয়া আয়কর রিটার্নের ওপর অডিট করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর। এতে দেখা গেছে, দুই লাখেরও বেশি আয়কর ফাইলে অনিয়ম হয়েছে। আর এসব ঘটনায় ফাঁকি দেয়া হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার কর।
মূলত, বিভিন্ন ব্যক্তি এবং কোম্পানি প্রকৃত আয় গোপন ও ব্যবসায় লোকসান দেখিয়ে এ বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকি দিয়েছে বলে জানিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড -এনবিআর।
তবে বিশাল অঙ্কের কর ফাঁকি উদঘাটন করা হলেও আদায় হয়েছে খুব কমই। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, অডিটের মাধ্যমে গত এক দশকে যে পরিমাণ কর ফাঁকি দেয়া হয়েছে, তার মধ্যে মাত্র ২৭ শতাংশ আদায় হয়েছে। বাকি ৭৩ শতাংশই অনাদায়ী রয়ে গেছে।
এনবিআর সূত্র বলছে, অডিটের মাধ্যমে যে সব অনিয়ম চিহ্নিত করে কর ফাঁকি উদঘাটন করা হয় তা মানতে নারাজ করদাতারা। তারা সংক্ষুব্দ হয়ে আপিল, ট্রাইব্যুনালসহ প্রচলিত আদালতে শরণাপন্ন হয়েছেন। কিন্তু মামলাগুলোর এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। যে কারণে কর আদায় সম্ভব হচ্ছে না ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মামলা যতদিন নিষ্পত্তি হবে না, ততদিন কর আদায় করা সম্ভব না। ফলে পুঞ্জিভূত কর আরও বাড়বে।’
করদাতা মূলত দুই শ্রেণির। ব্যক্তিশ্রেণি এবং কোম্পানি করদাতা। তবে বেশিরভাগই ব্যক্তিশ্রেণির করদাতা। কোম্পানি করদাতার সংখ্যা কম হলেও এখান থেকে বেশি কর আহরণ হয়। আইন অনুযায়ী, উভয় করদাতাদের নির্ধারিত সময়ে বার্ষিক রিটার্ন জমা দিতে হয়।
সূত্র জানায়, আয়কর রিটার্ন জমা দেয়ার পর দুইভাবে যাচাই –বাছাই করে এনবিআর। একটি হচ্ছে প্রাথমিক বাছাই। রিটার্ন জমা দেয়ার পর প্রক্রিয়াগুলো মোটামুটি ঠিক আছে কি-না, তা দেখা হয়। আরেকটি হচ্ছে অডিট।
তবে বেশির ভাগ রিটার্ন প্রাথমিকভাবে যাচাই-বাছাই করে কর নিরূপণ (অ্যাসেসমেন্ট) করা হয়।
এনবিআর সূত্র বলেছে, প্রতিবছর যে পরিমাণ রিটার্ন জমা পড়ে, তার মধ্য থেকে ২ থেকে আড়াই শতাংশ অডিট করা হয়। এর জন্য একটি নীতিমালা আছে । তার ওপর ভিত্তি করে অডিট হয়।
নিয়ম অনুযায়ী, আগের বছরের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি আয় দেখালে অডিট করা হয় না। তবে সন্দেহজনক আয় হলে ও তার কোনো দালিলিক প্রমাণ না দেখাতে পারলে অডিটের আওতায় আনা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর কমিশনার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সাধারণত উপহার, ঋণ, বিনিয়োগ, গ্রস-প্রোফিট ইত্যাদি বিষয়ে সমস্যা থাকলে অডিট হয়। অনেকক্ষেত্রে করদাতারা প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট রিটার্নে দেখান না। পাশাপাশি আগের বছরের তুলনায় কর পরিশোধ কম করা হয়েছে- এসব ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের সন্দেহ হলে অডিটের আওতায় আনা হয়।’
জানা যায়, যে সব আয়কর ফাইল অডিট করা হবে, তার তালিকা মাঠ পর্যায়ের প্রত্যেক উপ-কর কমিশনারের –ডিসিটি পক্ষ থেকে এনবিআরের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়। ওই তালিকা যাচাই –বাছাই করে রাজস্ব বোর্ড থেকে অনুমোদন দেয়ার পর অডিট হয়।
সূত্র বলেছে, অডিটে কর ফাঁকির ঘটনা ধরা পড়ার পর, করদাতারা যদি মনে করেন, কর্মকর্তা তার প্রতি ন্যায়বিচার করেননি, সে ক্ষেত্রে আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে। প্রথমে আপিল পরে ট্রাইব্যুনালে বিভাগীয় মামলা করতে পারেন। রায় করদাতার পক্ষে না এলে প্রচলিত আদালত অর্থাৎ হাইকোর্টে মামলা করার সুযোগ রয়েছে।
এনবিআরের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হাইকোর্টে রিট করেন করদাতারা। উচ্চ আদালতে মামলার চাপ বেশি থাকায় কর সংক্রান্ত মামলাগুলো নিষ্পত্তি হতে বছরের পর বছর লেগে যায়। যে কারণে আদায় কম হয়।’
সাধারণত দুইভাবে আয়কর রিটার্ন জমা দেয়া হয়। একটি হচ্ছে সর্বজনীন স্বনির্ধারণ পদ্ধতি। অপরটি হচ্ছে সাধারণ পদ্ধতি। তবে বেশির ভাগ করদাতা সর্বজনীন স্বনির্ধারণ পদ্ধতিতেই রিটার্ন দাখিল করেন। এ পদ্ধতিতে করদাতারা নিজ ইচ্ছায় তার আয়-ব্যয় দেখাতে পারেন। কোনো প্রশ্ন ছাড়াই এনবিআর তা মেনে নেয়।
যোগাযোগ করা হলে এনবিআরের সাবেক সদস্য আলমগীর হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের দেশে ব্যক্তিশ্রেণি করদাতার সংখ্যাই বেশি। ফলে এক্ষেত্রে অডিট বেশি হয়। তবে সাধারণত পে –রোল বা বেতনভুক্ত করদাতাদের বেশি অডিট করা হয়’’।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, চলতি করবর্ষে (২০২২-২৩) ২৮ লাখ ৫১ হাজার জন বার্ষিক আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছেন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ দুই থেকে আড়াই শতাংশ অডিটের আওতায় আসবে। এনবিআরের অডিট, ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশনের তৈরি করা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০-১১ করবর্ষ থেকে ২০১৯-২০ করবর্ষ পর্যন্ত মোট ১০ বছরে দুই লাখ ২০ হাজার রিটার্ন অডিটের জন্য নির্বাচন করা হয়।
এর মধ্যে দুই লাখ ১৭ হাজার ৫৭টি রিটার্ন অডিট করে ৩০ হাজার কোটি টাকার কর ফাঁকি উদ্ঘাটন করা হয়েছে। বিদায়ী বছরের অক্টোবর পর্যন্ত আদায় হয়েছে মাত্র ৯ হাজার কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০-১১ করবর্ষে সর্বজনীন স্বনির্ধারণ পদ্ধতিতে রিটার্ন দাখিল হয়েছে ৪ লাখ ৯৫ হাজার ৫২৭টি। এর মধ্যে অডিটের জন্য নির্বাচন করা হয় ১০ হাজার ৯৪টি। এসব রিটার্ন অডিট করে প্রায় দুই হাজার ১৩৫ কোটি টাকা ফাঁকি উদঘাটন বা করা হয়।
২০১১-১২ করবর্ষে রিটার্ন দাখিল হয়েছে ৬ লাখ ৮৯ হাজার ২টি। এর মধ্যে ১৬ হাজার ৮৪০টি অডিট করে প্রায় দুই হাজার ৭১৬ কোটি টাকা ফাঁকি উদঘাটন করা হয়।
২০১২-১৩ করবর্ষে রিটার্ন দাখিল হয়েছে ৮ লাখ ৫৪ হাজার ২৬৬টি। এর মধ্যে ২০ হাজার ৫৮৪টি অডিট করে প্রায় চার হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা ফাঁকি উদঘাটন করা হয়।
২০১৩-১৪ করবর্ষে রিটার্ন দাখিল হয়েছে ৮ লাখ ৮৯ হাজারটি। এর মধ্যে ৩২ হাজার ৩৪৪টি অডিট করে ফাঁকি উদঘাটন কর হয় পাঁচ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা।
২০১৪-১৫ করবর্ষে রিটার্ন দাখিল হয়েছে ৯ লাখ ৪২ হাজার ৫৬৯টি। এর মধ্যে ২০ হাজার ৬৪৩টি অডিট করা হয়। এতে ফাঁকি ধরা পড়ে ৯৬১ কোটি টাকা।
২০১৫-১৬ করবর্ষে রিটার্ন দাখিল হয়েছে ৯ লাখ ৮৫ টি। এর মধ্যে ২২ হাজার অডিটের জন্য নির্বাচন করা হয়। এতে ফাঁকি দেয়া হয় দুই হাজার ৯৮০ কোটি টাকা।
২০১৬-১৭ করবর্ষে রিটার্ন দাখিল হয়েছে ১৩ লাখ ৩৮ হাজারটি। এর মধ্যে ২৪ হাজার ৩৮০টি ফাইল অডিট করে দুই হাজার কোটি টাকার ফাঁকি ধরা পড়ে।
২০১৭-১৮ করবর্ষে রিটার্ন দাখিল হয়েছে ১৫ লাখ ৩৪ হাজার ৬৯৮টি। এর মধ্যে ২৫ হাজার ২৯৪টি অডিট করে ফাঁকি উদ্ঘাটন করা হয় প্রায় তিন হাজার ৩১ কোটি টাকা।
২০১৮-১৯ করবর্ষে রিটার্ন দাখিল হয়েছে ১৭ লাখ ৭ হাজার ১২৪টি। এর মধ্যে ২৬ হাজার ২৩৮টি রিটার্ন অডিট করে ফাঁকি উদ্ঘাটন হয়েছে প্রায় দুই হাজার ২৮৯ কোটি টাকা।
২০১৯-২০ করবর্ষে সর্বজনীন পদ্ধতিতে রিটার্ন দাখিল হয়েছে ১৯ লাখ ৫০ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে অডিট করা হয় ২১ হাজার ৯০৮টি। করফাঁকি উদ্ঘাটন করা হয় তিন হাজার ৩০৯ কোটি টাকা।