কঠিন বছর শেষে নতুন বছরে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়ানোর যে প্রত্যাশার কথা বলাবলি হচ্ছিল, ঘটছে তার উল্টো ঘটনা। শেয়ার কেনায় নেই একেবারেই আগ্রহ। বরং ২০২০ সালে করোনার আঘাতের পর পুঁজিবাজারে যে স্থবিরতা নেমে এসেছিল, সেই স্মৃতি ফিরেছে।
বছরের প্রথম দিন লেনদেনের খরা দ্বিতীয় দিনেও বজায় থাকার পর এটা স্পষ্ট হয়ে উঠে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানিক, সব বিনিয়োগকারীরাই শেয়ার না কিনে অপেক্ষায় থাকার নীতি নিয়েছে।
রোববার লেনদেন ছিল ১৭৮ কোটি ৪২ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। পরের দিন সেটি নামল আরও তলানিতে। টেনেটুনে পার করতে পারল না দেড় শ কোটি টাকাও।
সব মিলিয়ে লেনদেন হয়েছে ১৪৬ কোটি ৫১ লাখ ৯ হাজার টাকা। কয়েক মাস আগে লেনদেনের শীর্ষে থাকা একটি কোম্পানিতেই এর চেয়ে দ্বিগুণ টাকার শেয়ার হাতবদল হতে দেখা যায়।
আবার এই দেড়শ কোটি টাকার মধ্যে ৯৪ কোটি ৩৯ লাখ ৫৪ হাজার টাকাই হাতবদল হয়েছে টপ টোয়েন্টির ২০টি কোম্পানিতে। লেনদেন হওয়া বাকি ৩০৯টি কোম্পানিতে হাতবদল হয়েছে ৫০ কোটি টাকার কিছু বেশি।
কেবল ২৬টি কোম্পানির লেনদেন এক কোটি টাকার সীমা অতিক্রম করতে পেরেছে আর ১০ লাখ টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে কেবল ৬৪টি কোম্পানিতে। সব মিলিয়ে এক লাখ টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে ১২৯টি কোম্পানিতে।
এর চেয়ে কম লেনদেন ছিল প্রায় আড়াই বছর আগে ২০২০ সালের ৭ জুলাই। সেদিন হাতবদল হয় ১৩৮ কোটি ৫৬ লাখ ৫৫ হাজার টাকা।
সে সময় দেশে চলছিল করোনাভারাসজনিত বিধিনিষেধ। ওই বছরের ৮ মার্চ ভাইরাসের সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়ার পর বাজারে নামে ধস। ২৫ মার্চ থেকে বিধিনিষেধে বন্ধ হয়ে যায় পুঁজিবাজার। এর আগেই সব শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্য বা ফ্লোর প্রাইস দিয়ে কৃত্রিমভাবে দর ধরে রাখা হয়।
মে মাসে বিধিনিষেধ শিথিলের পর পুঁজিবাজারে লেনদেন চালু হয়। এরপর কোনো দিন এক শ কোটির নিচে, কোনো দিন এক শ কোটি ছাড়িয়ে লেনদেন চলতে থাকে।
করোনার আবার ফিরে আসার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে চীনের কারণে। সেখানে ব্যাপক সংক্রমণের কথা প্রচার হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধজনিত কারণে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা। অর্থনৈতিক মন্দা আসছে, এ কথা বলাবলি হচ্ছে সারা বিশ্বেই।
যদি সত্যি সত্যি মন্দা আসে, তাহলে রপ্তানির কী হবে, দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি রেমিট্যান্সে এমনিতেই ভাটা, তা আরও কমে গেছে রিজার্ভের কী হবে- ইত্যাদি নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে চার দিকে। এর মধ্যে আবার নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে বিরোধে আবার ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের পরিস্থিতি ফেরার আশঙ্কা।
সব মিলিয়ে পরিস্থিতি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য সুখকর নয়। আর এই পরিস্থিতিতে দেশে দেশেই পুঁজিবাজারে দরপতন দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে অবশ্য দরপতন ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে কৃত্রিমভাবে।
৩৯২টি কোম্পানির মধ্যে প্রায় অর্ধেক কোম্পানির শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্য বেঁধে দেয়া আছে। ১৬৮টি কোম্পানির সর্বনিম্ন মূল্য বা ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়া হলেও দিনে দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা এক শতাংশে ঠিক করার কারণে বহু শেয়ারের দরপতন আসলে সম্ভব নয়, আর কমলও তা কমতে পারবে নগণ্য। কৃত্রিমভাবে দর ধরে রাখতে গিয়েই লেনদেনে খরা বলে ধারণা করা হচ্ছে।
শেয়ারদর পতনে বাধার কারণে ৭টির দর বৃদ্ধির বিপরীতে ১৫৮ কোম্পানির দরপতনের সূচক তেমন কমতে পারেনি। ১৬৪টি কোম্পানি হাতবদল হয়েছে আগের দিনের দরে। এর সবগুলোই ফ্লোর প্রাইসে রয়েছে।
এদিন ৬০টি কোম্পানির একটি শেয়ারও হাতবদল হয়নি।
যেসব কোম্পানির দর বেড়েছে, তার মধ্যে নতুন তালিকাভুক্ত ইসলামিক কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স গত ১৮ ডিসেম্বর থেকে লেনদেন শুরুর পর প্রতিদিনই সর্বোচ্চ দরে লেনদেন হচ্ছে। ১০ টাকার শেয়ারদর বেড়ে হয়েছে ৩৩ টাকা ৯০ পয়সা।
বাকি ৬টি কোম্পানির মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২.৫৫ শতাংশ বেড়েছে বিডিওয়েল্ডিংয়ের দর। তৃতীয় অবস্থানে থাকা শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের দর ১.০৬ শতাংশ বেড়েছে। বাকি একটির দরও এক শতাংশ বাড়েনি।
সবচেয়ে বেশি দরপতন হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবগুলোই ফ্লোর প্রাইসে। গত ৩১ জুলাই থেকে এগুলোর দর অস্বাভাবিক হারে বাড়ছিল। দর হারাতে থাকলেও এখনও তা ফ্লোরের চেয়ে অনেক বেশি আছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৭.৪৯ শতাংশ দর হারিয়েছে ফ্লোর আরোপের পর এক শ টাকা থেকে এক হাজার টাকায় উঠে যাওয়া ওরিয়ন ইনফিউশন। কোম্পানিটির সর্বোচ্চ দর থেকে ৫০ শতাংশ কমে এখন নেমে এসেছে ৪৯১ টাকায়।
ফ্লোর প্রাইস দেয়ার পর ১৪৫ টাকা থেকে ৪৬৩ টাকায় উঠে যাওয়া মনোস্পুল পেপারের দর কমেছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭.০৭ শতাংশ। দাম নেমে এসেছে ২৫৮ টাকায়।
এক শতাংশের বেশি দর হারানো সম্ভব এমন কোম্পানির মধ্যে আরও একটির দর ৬ শতাংশের বেশি, তিনটির দর ৫ শতাংশের বেশি, ৪টির দর ৩ শতাংশের বেশি, ১০টির দর ২ শতাংশের বেশি এবং ১০টির দর কমেছে এক শতাংশের বেশি।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সূচকের অবস্থান এখন ৬ হাজার ১৭৭ পয়েন্ট, যা গত ১৪ আগস্টের পর সর্বনিম্ন। সেদিন সূচক ছিল ৬ হাজার ১৭৫ পয়েন্ট। ২৮ জুলাই সূচক ছয় হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে যাওয়ার পর ফ্লোর আরোপ হলে সে সময় শেয়ারদর এবং সূচক বাড়ছিল। এক পর্যায়ে ৬ হাজার ছয় শ পয়েন্ট ছুঁয়ে ফেলে। আবার উল্টো যাত্রা শুরু হয়েছে।
ট্রেজার সিকিউরিটিজের শীর্ষ কর্মকর্তা মোস্তফা মাহবুব উল্লাহ নিউজবাংলাকে বলেন, 'নতুন আঙ্গিকে পুঁজিবাজার দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে, এবং সবাই অপেক্ষাতেই আছে। ফাইনান্সিয়াল ক্রাইসিস বা লিকুইডিটি ক্রাইসিস এবং ফ্লোর তুলে নিলে কী হবে সেই ভাবনাটাও কিছুটা কাজ করছে।‘
ফ্লোর তুলে নিলে কী হবে এই ভাবনাও কাজ করছে বলেও মনে করেন তিনি। বলেন, ‘তবে সেই ভাবনার চেয়ও বেশি সংকট ফান্ডের। কারণ, ২০২০ সালের করোনার মধ্যেও আমরা ফ্লোর প্রাইজ দেখেছি, সেই সময়টাতেও ফ্লোর থাকার পরেও ফান্ড ফ্লো এসেছিল, বাজার ঊর্ধ্বমুখী ছিল। কিন্তু এখন সেটা নেই। এখন ইস্যু হচ্ছে ক্যাশ ফ্লো বা মানি ফ্লো। মানি ফ্লো আসলেই যে কোনো পয়েন্ট থেকে মার্কেট ঘুরে দাঁড়াবে।’