১০ লাখ টাকা ঋণের বিপরীতে সম পরিমাণ টাকা ব্রোকারেজ হাউজ থেকে ঋণ নিয়ে শেয়ার কিনেছিলেন আবুল কাসেম। তিন মাস ধরে বাড়ছে সুদ, কিন্তু ক্রেতা না পেয়ে শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না।
৩১ জুলাই থেকে পুঁজিবাজারে দ্বিতীয় দফায় যে ফ্লোর প্রাইস দেয়ার পর মাস দুয়েক পুঁজিবাজারে লেনদেন আর সূচকে ছিল চাঙাভাব। কিন্তু পুরো বাজারের ওপর পড়েনি এই চাঙাভাবের প্রভাব। ৩০ থেকে ৪০টি কোম্পানির শেয়ারদর অস্বাভাবিকহারে লাফ দিলেও সেপ্টেম্বরের শেষে একের পর এক কোম্পানি ফ্লোর প্রাইসে আসতে থাকে।
এক পর্যায়ে ফ্লোরে ফেরা কোম্পানির সংখ্যা ছাড়িয় যায় ৩০০টিতে। এর মধ্যে ৭০ থেকে ৮০টির কোনো ক্রেতা থাকে না। ২২০ থেকে ২৩০টি কোম্পানির লেনদেন এতই কম হয় যা ক্রেতা না থাকারই নামান্তর।
এমনও দেখা গেছে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হওয়া ২০টি কোম্পানির তালিকায় আছে, কিন্তু শেয়ার কিনতে অর্ডার বসাননি কেউ। ফ্লোর প্রাইসে মাঝেমধ্যে কেনা হয়েছে কিছু শেয়ার।
এই পরিস্থিতিতে ফ্লোর প্রাইস শেয়ারের দরপতন ঠেকাতে পারলেও মার্জিন ঋণধারীদের ক্ষতি ঠেকাতে পারছে না। এই ক্রেতাহীনতার সময় যত বাড়তে থাকবে, বিনিয়োগকারীর আর্থিক ক্ষতিও তত বাড়বে।
ফ্লোর প্রাইস আরোপের পর সূচক যখন বাড়ছিল তখন মার্জিন ঋণ নিয়ে শেয়ার কিনেছিলেন। সেগুলো বিক্রি করার আগেই শুরু হয় দরপতন, সেই সঙ্গে কমতে থাকে চাহিদা। ফলে সুদের চাপের পাশাপাশি দরপতনের ধাক্কা-দুই দিকেই ক্ষতি হচ্ছে তাদের।
বর্তমানে মূলধন ও মার্জিন ঋণের অনুপাত ১:১ বা প্রতি ১ টাকার বিপরীতে মার্জিন ঋণের পরিমাণ ১ টাকা। অর্থাৎ এক লাখ টাকার বিপরীতে আরও ১ লাখ টাকা ঋণ পাবেন একজন বিনিয়োগকারী।
ধরা যাক, দুজন বিনিয়োগকারীর মার্জিন ছাড়াই ১ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। আরেকজন ১ লাখ টাকার বিপরীতে সমপরিমাণ মার্জিন পেয়ে ২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। কোনো একটি শেয়ার ১০০ টাকা দরে কেনা হলে দুজনের শেয়ারের পরিমাণ দাঁড়ায় যথাক্রমে ১০০০টি ও ২০০০টি।
যদি শেয়ারের কমে যায়, তাহলে মার্জিন ঋণধারীর ক্ষতি হয় দ্বিগুণ। যদি শেয়ারের দর ৮০ টাকায় নামে, তাহলে প্রথম বিনিয়োগকারীর লোকসান হবে ২০ হাজার টাকা। দ্বিতীয় বিনিয়োগকারীর লোকসান হবে ৪০ হাজার টাকা। কারণ, মার্জিন ঋণদাতা কোম্পানিকে পুরো টাকাই দিতে হবে। আর মাসে মাসে এখন বাড়তি টাকা যোগ হবে।
বর্তমানে বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজে মার্জিন ঋণের সুদের হার ১২ থেকে ১৪ শতাংশের মধ্যে। ১৩ শতাংশ সুদের হার ধরে হিসাব করলে মার্জিন ঋণধারী বিনিয়োগকারীকে বার্ষিক সুদ দিতে হবে ১৩ হাজার টাকা।
তাহলে প্রথম মাসে সুদ দিতে হবে ১ হাজার ৮৩ টাকা ৩৩ পয়সা। চক্রবৃদ্ধি হারে পরের ৫ মাসে সুদের পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে ১ হাজার ৯৫ টাকা ৬৬ পয়সা, ১ হাজার ১০৬ টাকা ৯৩ পয়সা, ১ হাজার ১১৮ টাকা ৯২ পয়সা, ১ হাজার ১৩১ টাকা ০৪ পয়সা ও ১ হাজার ১৪৩ টাকা ২৯ পয়সা।
তাহলে মার্জিন ঋণের বিনিয়োগকারীকে ৬ মাসে সুদ দিতে হবে ৬ হাজার ৬৭৮ টাকা ৫৭ পয়সা। এতে তার বিনিয়োগ কমে যাবে সমপরিমাণ।
মার্জিন ঋণের লাভের চেয়ে লোকসানই বেশি হয় বলে মনে করেন ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি রিচার্ড ডি রোজারিও।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এক লাখ টাকার লাভের চেয়ে দুই লাখ টাকার কিনলে লাভ বেশি। সবাই এই হিসাবই করেন। কিন্তু মার্জিন ঋণে বিনিয়োগ করে লাভের চেয়ে লোকসানই বেশি হয়, প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়।’
উদাহরণ টেনে ডিবিএ সভাপতি বলেন, ‘ধরুন কারও কাছে এক লাখ টাকা আছে। সমপরিমাণ ঋণ নিয়ে তিনি ১৩০ টাকা দরে ওরিয়ন ফার্মার শেয়ার কিনেছেন ১৫৩৮টি। বর্তমান দর ৮৩ টাকা। অর্থাৎ এই শেয়ারের বাজারদর নেমে এসেছে ১ লাখ ২৭ হাজার ৬৫৪ টাকায়। বিনিয়োগকারীর লোকসান ৭২ হাজার ৩৪৬ টাকা।
কিন্তু ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান তো এক টাকাও কম নেবে না। শেয়ার বিক্রির পর তারা পুরো টাকাই সমন্বয় করে নেবে। ফলে এই পুরো টাকাই কমবে মূলধন থেকে। তখন মূলধন ২৮ হাজারের নিচে নামবে। এর সঙ্গে যোগ হবে সুদ।
যদি ঋণ না নিয়ে সেই বিনিয়োগকারী ৭৬৯টি শেয়ার কিনতেন, তাহলে তার লোকসান হতো ৩৬ হাজার টাকার কিছু বেশি। এর সঙ্গে সুদের চাপও থাকত না। আবার যতদিন খুশি শেয়ার রেখে দিয়ে কম দামে কিনে কিছু সমন্বয়ও করতে পারতেন।
লোকসান জেনেও কেন ঋণ নেন বিনিয়োগকারীরা- এমন প্রশ্নের উত্তরে রিচার্ড ডি রোজারিও বলেন, ‘লোভ সংবরণ না করতে পেরে বিনিয়োগকারীরা এই ফাঁদে পা দেন।’
তিনি বলেন, ‘জুয়া খেলায় সর্বশান্ত হতে হয় জেনেও কি জুয়া খেলা ছেড়ে দেয়? এখানেও লাভের হিসাব করে কিন্তু লোকসানের কথা মাথায় রাখেন না।
‘আমাদের মার্কেটে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা অনেক। আমাদের হাউজ থেকে লোন দেই না বলে অনেক ক্লায়েন্ট চলে যায়।’
কেমন লোকসানে বিনিয়োগকারীরা
জনতা ব্যাংকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘মার্জিন ঋণে বিনিয়োগ করে বিপদে পড়ে গেছি। শেয়ারদর কমে যাচ্ছে। এর ওপর আবার ইন্টারেস্ট বাড়ছে। সে ক্ষেত্রে ইক্যুইটির ওপর আঘাত আসছে।’
আরও বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেমন ওরিয়ন ফার্মা কেনা আছে ১৪৩ টাকায়। সেটা এখন প্রায় অর্ধেকে আছে। বিক্রি করতে পারছি না। আবারও সুদও বাড়ছে। এটা একটার কথা বললাম।’
খুলনার ব্যবসায়ী জি এম মাহির বলেন, ‘কয়েকটা ইন্স্যুরেন্স কেনা ছিল। ৫৪ টাকা ছিল এখন ৪০ টাকার নিচে।’
বর্তমানে কত লোকসানে আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এক্সাক্টলি বলতে পারছি না। তবে ৩৮ হাজার শেয়ার রয়েছে, এর একটা অংশ মার্জিনে কেনা। লাখ দেড়েক মার্জিনে ছিল। এর মধ্যে আমি কিছু শোধ করেছিলাম। তাতে সব মিলিয়ে শেয়ার প্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকা করে লসে আছি। শেয়ার বিক্রি করতেও পারছি না। এ থেকে উত্তরণের কোনো উপায় আছে কিনা, আমার জানা নাই।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক বিনিয়োগকারী বলেন, ‘আমার যে ইনভেস্টমেন্ট ছিল তা অর্ধেকে চলে এসেছে। লোন সম্পর্কে ভালো ধারণা ছিল না। হঠাৎ করে ব্রোকার থেকে আমাকে বলা হলো, মার্কেট ভালো আছে, লোন নিয়ে ব্যালেন্স করে ফেললে ভালো হবে। আমি জানি না যে মার্কেট এমন হবে। লোন নিয়ে শেয়ার কিনে এখন আমি ধরা।’
‘ধরুন আমি ৫০ টাকা লোন নিয়েছি। যদি তার সুদ ৫ টাকা হয়, সেটা আগেই কেটে নিয়ে ঋণের সঙ্গে যোগ হচ্ছে, অর্থাৎ ৫৫ টাকার ওপর ইন্টারেস্ট কাটছে। চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ বাড়ছে আরকি।’