আগের দিন আইএমএফের সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির বৈঠক নিয়ে উৎকণ্ঠা ও প্রফিট টেকিংয়ের কারণে পুঁজিবাজারে পতনের পর মঙ্গলবার লেনদেনের শুরুটা হয়েছিল আশা জাগানিয়া, তবে শেষ পর্যন্ত সূচক পতনের সঙ্গে হতাশ হতে হল বিনিয়োগকারীদের।
প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বা ডিএসইতে দরপতনের সংখ্যা বেশি হলেও দরবৃদ্ধিও হয়েছে কাছাকাছি সংখ্যায়। তবে যেসব শেয়ারের দাম বেড়েছে সেগুলো সূচকে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারেনি।
লেনদেন শুরুর ১৯ মিনিটেই ২৩ পয়েন্ট বেড়ে যায় সূচক। দিনের মধ্যভাগ পর্যন্ত একই হারে সূচক বেড়ে লেনদেন হয়েছে। বেলা ১১টা ৩৪ মিনিটে ২৫ পয়েন্ট বেড়ে সূচক দিনের সর্বোচ্চ ৬ হাজার ৪১৮ পয়েন্টে দাঁড়ায়। এরপর থেকে ক্রমাগত দরপতনে দিনের সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে ৪৪ পয়েন্ট কমে সূচক সর্বনিম্ন অবস্থানে চলে যায়। তবে শেষ মুহূর্তের সমন্বয়ে আগের দিনের চেয়ে ৮ পয়েন্ট কমে লেনদেন শেষ হয়।
দিন শেষে প্রধান সূচক ডিএসইএক্স অবস্থান করছে ৬ হাজার ৩৮৪ পয়েন্টে।
লেনদেন হওয়া সিকিউরিটিজের মধ্যে দর বেড়েছে ৬৮টির, বিপরীতে কমেছে ৭৪টির। অন্যদিকে অপরিবর্তিত দরে লেনদেন হয়েছে ২২০টির, যার দু-একটি বাদে বেশিরভাগই ফ্লোর প্রাইসে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
গত সপ্তাহের বুধবারের পরে ফ্লোরপ্রাইসে লেনদেনের সংখ্যা এটাই সর্বোচ্চ। বুধবার ফ্লোর থেকে বের হয়ে আসার প্রবণতা শুরুর আগের দুই দিন ২৩২টি করে কোম্পানি লেনদেন হয়েছে ফ্লোর প্রাইসে। বুধবার সেটি নেমে আসে ২১৬টিতে। এরপর বৃহস্পতিবার ২০২টি, রোববার ২০৮টি ও সোমবার এই সংখ্যাটা ছিল ২১৩।
সূচক কমলেও লেনদেন বেড়েছে কিছুটা। হাতবদল হয়েছে ১ হাজার ৪৯৪ কোটি ৫৪ লাখ ৮৯ হাজার টাকার শেয়ার, বন্ড ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ইউনিট, যা আগের দিনের চেয়ে ২৫৮ কোটি ৮৯ লাখ ৪৩ হাজার টাকা কম। সোমবার লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ২৩৫ কোটি ৬৫ লাখ ৪৬ হাজার টাকার।
আগে কী হয়েছিল
৩১ জুলাই থেকে ফ্লোর প্রাইস কার্যকরের পর ৩০টির মতো শেয়ারের দরবৃদ্ধির ওপর ভর করে সূচকের উত্থান হলেও এর প্রভাব সমভাবে পড়েনি পুঁজিবাজারে। মৌলভিত্তিরসহ আড়াই শ’র বেশি কোম্পানির লেনদেন হতে থাকে ফ্লোর প্রাইসে।
এরই মধ্যে ১১ অক্টোবর ব্রোকারেজ হাউজে চেক জমা দিয়ে নগদায়নের আগে শেয়ার কেনা যাবে না বলে বিএসইসির নির্দেশনায় আরেক মোড় নেয় পুঁজিবাজার। ৩০ অক্টোবর সেই সিদ্ধান্ত পাল্টালেও দরপতন থামেনি পুঁজিবাজারে।
নতুন ইস্যু হিসেবে সামনে আসে আইএমএফ থেকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার আশায় সংস্থাটির সঙ্গে সরকারের বৈঠক ইস্যু।
আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি পুঁজিবাজারে কোনো ধরনের বাইরের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে। বর্তমানে দরপতন ঠেকাতে ‘ফ্লোর প্রাইস’ নামে সব শেয়ারের সর্বনিম্ন দর বেঁধে দিয়ে যে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে, সেটি নিয়ে আইএমএফ কথা তুলতে পারে, এমন শঙ্কার কথা বলাবলি হতে থাকে।
শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস আলোচ্যসূচিতে নেই-নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে এ বিষয়টি জানানোর পর ১ নভেম্বর পুঁজিবাজারে সূচকের উত্থান ঘটে, তবে বিপুলসংখ্যক কোম্পানির শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে আটকে থাকে।
পরের দুই কর্মদিবসে ফ্লোর ভেঙে শেয়ারগুলো বের হয়ে আসার প্রবণতা দেখা দেয়। বৃহস্পতিবার ২২ কর্মদিবস পরে লেনদেন দেড় হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করে, তবে রবি ও সোমবার ফের বিনিয়োগকারীদের আলোচনায় ছিল আইএমএফ ও বিএসইসির বৈঠকের বিষয়টি, যার প্রভাব দেখা যায় লেনদেনে।
সোমবার আইএমএফের সঙ্গে বিএসইসির বৈঠকে কোনো নেতিবাচক খবর না থাকায় মঙ্গলবার যেমন ইতিবাচক পুঁজিবাজারের প্রত্যাশা ছিল, শুরুতে তার দেখা মিললেও শেষ হয় হতাশায়।
সতর্ক থাকার আহ্বান
লেনদেনের পর্যালোচনা সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন ট্রেজার সিকিউরিটিজের শীর্ষ কর্মকর্তা মোস্তফা মাহবুব উল্লাহ। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বাজার কোনোদিকে যায়নি, আনুপাতিক হারে ছড়ায়নি। সামনে ডিভিডেন্ড-সংক্রান্ত রেকর্ড ডেটসহ আরও অনেক কিছু আছে, এ রকম পরিস্থিতিতে অনেক সময় মার্কেট পোলারাইজেশনের মধ্যে থাকে, এ কারণেও এমন হতে পারে। আবার উল্টোও হতে পারে, হয়তো মার্কেট পজের দিকে যাচ্ছে।’
তিনি যোগ করেন, ‘তবে মঙ্গল ও বুধবারের লেনদেন আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এখনও আছে। দেখা যাক, ঘুরেও যেতে পারে।’
সূচকে প্রভাব যাদের
বেশি ২ দশমিক ৩২ পয়েন্ট সূচক কমেছে বসুন্ধরা পেপারের দরপতনে। কোম্পানিটির দর কমেছে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২ দশমিক ২৯ পয়েন্ট কমেছে লাফার্জ হোলসিমের কারণে। শেয়ারপ্রতি দাম কমেছে ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
ইস্টার্ন হাউজিংয়ের দর ৯ দশমিক ০২ শতাংশ কমার কারণে সূচক কমেছে ১ দশমিক ৮৪ পয়েন্ট।
এ ছাড়া জেএমআই হসপিটাল, সি-পার্ল, এডিএন টেলিকম, বিকন ফার্মা, লুবরেফ বাংলাদেশ, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন ও ওরিয়ন ইনফিউশনের দরপতনে সূচক কমেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক কমিয়েছে ১৪ দশমিক ৯৬ পয়েন্ট।
বিপরীতে ১ দশমিক ৭৫ পয়েন্ট সূচক বাড়িয়েছে সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট। এদিন শেয়ারটির দর বেড়েছে ১৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ।
আইএফআইসি ব্যাংকের দর ২ দশমিক ৬১ শতাংশ বাড়ায় সূচক বেড়েছে শূন্য দশমিক ৮৮ পয়েন্ট।
মালেক স্পিনিং সূচকে যোগ করেছে শূন্য দশমিক ৮৬ পয়েন্ট। কোম্পানির দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
এর বাইরে সূচকে পয়েন্ট যোগ করেছে ইউনিক হোটেল, শাহজালাল ব্যাংক, আল-আরফাহ ইসলামী ব্যাংক, সোনালী পেপার, জেনেক্স ইনফোসিস, ওরিয়ন ফার্মা ও সিটি ব্যাংক।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক বাড়িয়েছে ৮ দশমিক ১৩ পয়েন্ট।
শীর্ষ ৫ খাত যেমন
আগের দিনের মতোই শীর্ষ রয়েছে প্রযুক্তি খাত। লেনদেন হয়েছে ২০৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা, যা আগের দিনে ছিল ২৪৩ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।
১টি করে কোম্পানির লেনদেন হয়েছে দরবৃদ্ধির ও আগের দরে। ৯টি কোম্পানির দরপতন হয়েছে।
১৯৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা লেনদেন করে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ওষুধ ও রসায়ন খাত। আগের দিনে লেনদেন ছিল ১৭৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকা।
৫টি কোম্পানির দরবৃদ্ধির বিপরীতে ১৯টির লেনদেন হয়েছে অপরিবর্তিত দরে, ৭টির দরপতনে।
তৃতীয় স্থানে রয়েছে কাগজ ও মুদ্রণ খাত। ১৫৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকা লেনদেনের দিনে খাতের ১টি করে কোম্পানির দরবৃদ্ধি ও অপরিবর্তিত দরে লেনদেন হয়েছে। আর ৪টির দরপতন হয়েছে।
সেবা ও আবাসন খাতে লেনদেন হয়েছে ১১১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ৩টির দরবৃদ্ধি ও ১টির দরপতনে লেনদেন হয়েছে।
পঞ্চম স্থানে থাকা প্রকৌশল খাতে লেনদেন হয়েছে ১০৩ কোটি ১০ লাখ টাকা, যা আগের দিনে ছিল ৯৫ কোটি ১০ লাখ টাকা। ১১টি কোম্পানির দরবৃদ্ধির বিপরীতে ২৩টির লেনদেন হয়েছে অপরিবর্তিত দরে। ৭টির লেনদেন হয় দর কমে।
দরবৃদ্ধির শীর্ষ ১০
সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ দর বেড়ে সামিট অ্যালায়েন্স পোর্টের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৩৬ টাকা ৭০ পয়সায়, যা আগের দিনে লেনদেন হয়েছিল ৩২ টাকা ২০ পয়সায়।
তালিকার দ্বিতীয় স্থানে ছিল শমরিতা হসপিটাল। ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ দর বেড়ে শেয়ারটি হাতবদল হয়েছে ৯১ টাকা ৯০ পয়সায়। আগের দিনের দর ছিল ৮৩ টাকা ৬০ পয়সা।
চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের দর ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ বেড়ে ২১ টাকা ২০ পয়সায় শেয়ার বেচাকেনা হয়েছে। আগের দিনের সমাপনী দর ছিল ১৯ টাকা ৩০ পয়সা।
এ ছাড়া দরবৃদ্ধির দশে ছিল- মালেক স্পিনিং, অ্যাপেক্স ফুডস, জেমিনি সি-ফুড, ইনডেক্স অ্যাগ্রো, এনার্জিপ্যাক পাওয়ার, কপারটেক ও ইয়াকিন পলিমার।
দরপতনের শীর্ষ ১০
সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ০১ শতাংশ কমে ইস্টার্ন হাউজিংয়ের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১২১ টাকা ১০ পয়সা, যা আগের দিনে লেনদেন হয়েছিল ১৩৩ টাকা ১০ পয়সায়।
ইন্দোবাংলা ফার্মার দর ৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ কমে ১৭ টাকা ২০ পয়সায় প্রতিটি শেয়ার লেনদেন হয়েছে। পূর্বের দর ছিল ১৮ টাকা ৯০ পয়সা।
৮ দশমিক ৪৭ শতাংশ দর কমে এডিএন টেলিকমের শেয়ার বেচাকেনা হয়েছে ১৩০ টাকা ৬০ পয়সায়। আগের দিনের দর ছিল ১৪২ টাকা ৭০ পয়সায়।
এ ছাড়াও পতনের তালিকায় শীর্ষ দশের মধ্যে ছিল- লুবরেফ বাংলাদেশ, জেএমআই হসপিটাল, সিনোবাংলা ইন্ডাস্ট্রিজ, বসুন্ধরা পেপার, আমরা টেকনোলজিস, ইনফরমেশন সার্ভিসেস ও ই-জেনারেশন লিমিটেড।