ঘূর্ণিঝড় 'সিত্রাং' কেটে আবহাওয়া ঝলমলে হয়ে উঠলেও পুঁজিবাজারের কালমেঘ সরছে না। আগের দিনের চেয়ে কিছুটা বাড়লেও পুঁজিবাজারে হঠাৎ করে দেখা দেয়া লেনদেনের খরা কাটেনি। গোটা তিরিশেক কোম্পানির শেয়ারে ভর করে বাজারের ওঠানামার যে চিত্র সেটি দেখা গেল আবার।
সপ্তাহের চতুর্থ কর্মদিবস বুধবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বা ডিএসইতে হাতবদল হয়েছে মোট ৭৪১ কোটি ৮০ লাখ ৩৬ হাজার টাকার শেয়ার। তবে কেবল ২০টি কোম্পানিতে লেনদেনে হয়েছে এর ৬৩ শতাংশ বা ৪৭১ কোটি ১৬ লাখ ২০ হাজার টাকা।
আগের দিনের ধারাবাহিকতায় দর হারানো কোম্পানির চেয়ে দর বেড়েছে এমন কোম্পানির সংখ্যা বেশি হলেও ফ্লোর প্রাইসে গড়াগড়ি খাচ্ছে এমন পৌনে তিন শ কোম্পানির শেয়ারে লেনদেনের গতি খুবই কম।
ফ্লোর প্রাইসে থাকা বেশ কিছু কোম্পানির একটি শেয়ারও হাতবদল হয়নি। ২৩৭টি শেয়ারে লেনদেন হয়েছে কেবল ২৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা, যা লেনদেনের শীর্ষে থাকা বেক্সিমকো লিমিটেডের লেনদেনের প্রায় এক তৃতীয়াংশ। এই কোম্পানিতে হাতবদল হয়েছে ৭২ কোটি ২০ লাখ ৬৩ হাজার টাকা, যা মোট লেনদেনের ৯.৭৩ শতাংশ।
এদিন দর বেড়েছে এমন ৭৫টি কোম্পানিতে লেনদেন হয়েছে মোট ৪৬৮ কোটি ৪ লাখ টাকা, আর দর কমেছে এমন ৩৮টি কোম্পানিতে লেনদেন হয়েছে ২০২ কোটি ১০ লাখ টাকা।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের পর দুই দিন যথাক্রমে ২০ ও ১৬ পয়েন্ট সূচক বাড়লেও লেনদেনের এই ভারসাম্যহীনতায় বিনিয়োগকারীর হতাশার যেন শেষ নেই। বিপুলসংখ্যক কোম্পানির শেয়ারের বিক্রয়াদেশ দিন শেষে কোনো কাজেই লাগে না।
বুধবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে যে লেনদেন হয়েছে, তার মধ্যে কেবল এই ২০টি কোম্পানিতেই হয় তার ৬৩ শতাংশের বেশি
এদিন যে লেনদেন হয়েছে, সেটি চাঙা পুঁজিবাজারে এক বা দেড় ঘণ্টার সমান। গত ২৮ জুলাই ফ্লোর প্রাইস দেয়ার পর বাজারে ধীরে ধীরে সূচকের যে উত্থান দেখা গিয়েছিল, তাতে সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে লেনদেন ২ হাজার কোটি টাকার ঘর ছাড়িয়ে যায়, সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে সূচক।
২০ সেপ্টেম্বর লেনদেন ৩ হাজার কোটি ছুঁইছুঁই হয়, হাতবদল হয় ২ হাজার ৮৩২ কোটি ৩০ লাখ ৭৪ হাজার টাকা, যা এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
এ ছাড়াও ৪ ও ৭ সেপ্টেম্বর ২ হাজার ২৯৬ কোটি৩৯ লাখ ২ হাজার ও ২ হাজার ২০১ কোটি ৩৫ লাখ ৩৮ হাজার টাকার লেনদেন হয়। আর ৩১ আগস্ট লেনদেন হয় ২ হাজার ৫ কোটি ৬৯ লাখ ৪৫ হাজার টাকার।
শুরুতে বিনিয়োগকারীরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচার আশা করলেও পরে দেখা যায়, গোটা তিরিশেক কোম্পানিতেই হচ্ছে লেনদেনের সিংহভাগ। আর এক শর কাছাকাছি কোম্পানির শেয়ারের বেচাকেনাই নেই। এই সংখ্যাটি ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে পৌনে তিন শতে গিয়ে পৌঁছেছে। ফ্লোর প্রাইসে নেমে আসার পর এগুলোর ক্রেতা নেই বললেই চলে।
আর ক্রেতা নেই এসব কোম্পানির মধ্যে আছে বাজারের প্রাণভোমরা হিসেবে বিবেচিত মৌলভিত্তির বহু কোম্পানি যেগুলো বছরের পর বছর ধরে বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণীয় লভ্যাংশ দিয়ে আসছিল।
ভালো কোম্পানির ক্রেতা নেই, এই অবস্থায় স্বল্প মূলধনি কয়েকটি কোম্পানিতে ভর করেছেন বিনিয়োগকারীরা। শেয়ারসংখ্যা কম, কিন্তু আগ্রহ বেশি, পরিস্থিতি এমন থাকায় তরতর করে এসব কোম্পানির শেয়ারদর বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে কোম্পানির আর্থিক স্বাস্থ্য, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, কিছুই বিবেচনায় আসছে না।
গত সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস থেকে চলতি সপ্তাহের সোমবার পর্যন্ত টানা চার কর্মদিবসে এসব কোম্পানি অনেকটাই দর হারালেও মঙ্গলবার থেকে আবার ফিরেছে উত্থানপর্বে।
পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক এই অবস্থার পেছনে সবশেষ যে বিষয়টি সামনে এসেছে, সেটি হলো, চেক নগদায়ন। ১১ অক্টোবর স্টক ব্রোকারদের উদ্দেশে জারি করা বিএসইসির এক নির্দেশনায় বলা হয়, চেকের টাকা নগদায়নের আগে তা দিয়ে শেয়ার কেনা যাবে না।
এই নির্দেশনার পরই পুঁজিবাজারে লেনদেন কমতে দেখা গেছে উল্লেখযোগ্য হারে। চেক নগদায়নের এ সিদ্ধান্ত না পাল্টালে পুঁজিবাজারে চাপ আরও বাড়বে বলে স্টক ব্রোকাররা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিকে চিঠি দেয়। গত সপ্তাহের সোমবার বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রচারের পরদিনই পুঁজিবাজারে চাপ বাড়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বুধবার লেনদেনের শুরুর দিকেই আগের দিনের চেয়ে ২ পয়েন্ট সূচক কমে যায়। সারা দিনে সূচক এর চেয়ে নিচে নামেনি। ১০টা ৪ মিনিটে আগের দিনের চেয়ে ২০ পয়েন্ট এবং দিনের সর্বনিম্ন অবস্থান থেকে ২২ পয়েন্ট বেড়ে যায়। সেটাও স্থায়ী হয়নি, ১১টা ১০ মিনিটে ওই অবস্থান থেকে ১৯ পয়েন্ট কমে লেনদেন হতে থাকে।
সূচকের এই বৃদ্ধি ও হ্রাস গোটা তিরিশের কোম্পানির ওপর নির্ভর করেই হচ্ছে গত কয়েক মাস ধরে
তবে এরপর বড় উত্থানের আশা জাগিয়ে আবারও সূচক নিম্নমুখী হয়। দুপুর ১২টা ১৪ মিনিটে সূচক দিনের সর্বোচ্চ অবস্থান ৬ হাজার ৩৫৯ পয়েন্ট চলে যায়, যা আগের দিনের চেয়ে ২৭ পয়েন্ট বেশি। এরপর দরপতনের কারণে সেই অবস্থানে ফিরতে না পারলেও আগের দিনের চেয়ে ১৬ পয়েন্ট বেড়ে লেনদেন শেষ হয়েছে। ডিএসইএক্স অবস্থান করছে ৬ হাজার ৩৪৪ পয়েন্টে।
ফ্লোর প্রাইস গলার কাঁটা?
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সাবেক সভাপতি শরীফ আনোয়ার হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাজারে ডিপ্রেশন চলতেই আছে, আগে এটা কম ছিল এখন গাঢ় হয়েছে। এর কারণ হলো ফ্লোর প্রাইসে চলে গেছে বিপুল সংখ্যক শেয়ার, আর বাড়ছে। ফলে শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না, তাহলে নতুন করে ইনভেস্ট করবেন কীভাবে? ফলে সেক্টরাল মুভমেন্ট হচ্ছে না।’
তিনি যোগ করেন, ‘আর নতুন করে ফান্ড ইনজেক্ট হচ্ছে না, কারণ যেসব ভালো শেয়ার রয়েছে, ভালো ডিভিডেন্ড দিয়েছে কিন্তু সেগুলো থেকে রিটার্ন আসছে, বরং পঁচা শেয়ারের দাম বাড়ার বিষয়টি বারবার গণমাধ্যমে আসছে, তখন নতুন করে বিনিয়োগে আসার সাহস পাচ্ছেন না। এই বাজার এখন বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত নয় বলে মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্ররোচিত হচ্ছেন।’
সূচকে প্রভাব যাদের
৩ দশমিক ১৪ পয়েন্ট সূচক বাড়িয়েছে বিকন ফার্মা। এদিন শেয়ারটির দর বেড়েছে ২ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
সি-পার্লের দর ৮ দশমিক ৯৮ শতাংশ বাড়ায় সূচক বেড়েছে ৩ দশমিক ০৮ পয়েন্ট।
বেক্সিমকো লিমিটেড সূচকে যোগ করেছে ২ দশমিক ০৯ পয়েন্ট। কোম্পানির দর বেড়েছে ১ দশমিক ১১ শতাংশ।
এর বাইরে সূচকে পয়েন্ট যোগ করেছে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন, ইস্টার্ন হাউজিং, জেনেক্স ইনফোসিস, তমিজউদ্দিন টেক্সটাইল, ইসলামী ব্যাংক, জেএমআই হসপিটাল ও নাভানা ফার্মা।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক বাড়িয়েছে ১৫ দশমিক ৭৪ পয়েন্ট।
বিপরীতে সবচেয়ে বেশি ২ দশমিক ৫৮ পয়েন্ট সূচক কমেছে সোনালী পেপারের দরপতনে। কোম্পানিটির দর কমেছে ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১ দশমিক ৮০ পয়েন্ট কমেছে বেক্সিমকো ফার্মার কারণে। শেয়ার প্রতি দাম কমেছে ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
পূবালী ব্যাংকের শেয়ারদর ১ দশমিক ০৮ শতাংশ কমার কারণে সূচক কমেছে শূন্য দশমিক ৭৬ পয়েন্ট।
এ ছাড়াও জেএমআই সিরিঞ্জেস, বিএসআরএম স্টিল, ইউনিলিভার কেয়ার, বাংলাদেশ বিল্ডিং সিস্টেমস, বসুন্ধরা পেপার, লুবরেফ বাংলাদেশ ও আনোয়ার গ্যালভানাইজিংয়ের দরপতনে সূচক কমেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক কমিয়েছে ৭ দশমিক ৪৯ পয়েন্ট।
শীর্ষ ৫ খাত
১৩৪ কোটি ৫ লাখ টাকা বা ১৯.২৭ শতাংশ লেনদেন করে শীর্ষে আগের দিনের মতোই শীর্ষে অবস্থান করছে বিবিধ খাত। খাতটিতে ৫টি কোম্পানির দরবৃদ্ধির বিপরীতে ৬টির লেনদেন হয়েছে অপরিবর্তিত দরে ও ২টির দরপতনে।
ওষুধ ও রসায়ন খাতে লেনদেন হয়েছে ১০৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ৯টি কোম্পানির দরবৃদ্ধির বিপরীতে ১৩টির লেনদেন হয়েছে আগের দরে। দরপতন হয়েছে ৮টির।
তৃতীয় স্থানে রয়েছে প্রকৌশল খাত। ৯৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। ৯টি কোম্পানির দরবৃদ্ধির বিপরীতে ২৩টির লেনদেন হয়েছে আগের দরে। দরপতন হয়েছে ৯টির।
এরপরেই প্রযুক্তি খাতে লেনদেন হয়েছে ৮১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। ৫টির দরবৃদ্ধির বিপরীতে আগের দরে লেনদেন হয়েছে ২টি কোম্পানির। ৩টির দরপতন হয়েছে।
৪৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা লেনদেন করে তালিকার পঞ্চম স্থানে ছিল ভ্রমণ ও অবকাশ খাত। খাতের ৩টি কোম্পানির লেনদেন হয়েছে দর বেড়ে।
এর বাইরে শুধু জ্বালানি খাতেই ৪২ কোটির ওপর লেনদেন হয়েছে। বাকি খাতের লেনদেন ছিল ৩০ কোটির নিচে।
সাধারণ বিমা, বস্ত্র, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিপুল সংখ্যক শেয়ার লেনদেন হয়েছে অপরিবর্তিত দরে, যার প্রায় সবই ফ্লোর প্রাইসে। ২৬টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের লেনদেন হয়েছে ফ্লোর প্রাইসেই।
দরবৃদ্ধির শীর্ষ ১০
সবচেয়ে বেশি ৯.৯৪ শতাংশ দর বেড়েছে ই-জেনারেশনের। শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৫৬ টাকা ৪০ পয়সায়। গতকাল লেনদেন হয় ৫১ টাকা ৩০ পয়সায়।
নতুন তালিকাভুক্ত নাভানা ফার্মার দর ৯.৯২ শতাংশ বেড়ে ৪৬ টাকা ৫০ পয়সায় শেয়ার লেনদেন হয়েছে। গতকাল এটি ৪২ টাকা ৩০ পয়সায় লেনদেন হয়েছিল।
তৃতীয় সর্বোচ্চ ৮.৯৭ শতাংশ দর বেড়েছে সি-পার্লের। আগের দিন ১৫৪ টাকা ৮০ পয়সায় লেনদেনের পরে আজ প্রতিটি শেয়ার হাতবদল হয়েছে ১৬৮ টাকা ৭০ পয়সায়।
এ ছাড়া শীর্ষ দশের পেপার প্রসেসিং, মনোস্পুল ও জেমিনি সি-ফুডের দর বেড়েছে ৮ শতাংশের ওপরে। আর তমিজউদ্দিন টেক্সটাইল, মুন্নু অ্যাগ্রো, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি ও জেনেক্স ইনফোসিসের দর বেড়েছে ৭ শতাংশের ওপরে।
দর পতনের শীর্ষ ১০
এই তালিকার শীর্ষে রয়েছে রংপুর ফাউন্ড্রি। ৫.১৫ শতাংশ দর কমে প্রতিটি শেয়ার সর্বশেষ ১৯৮ টাকা ৬০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে। আগের দিনে লেনদেন হয় ২০৯ টাকা ৪০ পয়সায়।
পতনের তালিকায় পরের স্থানে রয়েছে সোনালী পেপার। ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ দর কমে শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৮২২ টাকা ৮০ পয়সায়। আগের দিনের ক্লোজিং প্রাইস ছিল ৮৬৫ টাকা ৪০ পয়সা।
তৃতীয় সর্বোচ্চ দর হারিয়েছে ইয়াকিন পলিমার। ৪ দশমিক ২৪ শতাংশ কমে শেয়ারটি সর্বশেষ ২০ টাকা ৩০ পয়সায় হাতবদল হয়। আগের দিনে লেনদেন হয়েছিল ২১ টাকা ২০ পয়সায়।
দর কমার শীর্ষ দশে থাকা অন্য কোম্পানিগুলো ছিল: বাংলাদেশ বিল্ডিং সিস্টেমস, বিডিকম, হাক্কানি পাল্প, বিডি ওয়েল্ডিং, জেএমআই সিরিঞ্জেস, কপারটেক ও লুবরেফ বাংলাদেশ।