বাংলাদেশের টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথে তিনটি বাধা চিহ্নিত করেছে উন্নয়ন সংস্থা বিশ্বব্যাংক। এই বাধাগুলো দূর করতে সংস্কার কার্যক্রম জোরালো না হলে ২০৩৫ থেকে ২০৪১ সালের মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশে নেমে যেতে পারে। আর মোটামুটি ধরনের সংস্কার হলে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ হবে। আর ভালো রকম সংস্কার হলে সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে।
অন্যদিকে সংস্কার না হলে দেশটির মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির গতিও কমে যাবে বলে পূর্বাভাস দিয়ে বিশ্বব্যাংক বলেছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির ইতিবাচক ধারা ধরে রাখতে বিশ্বের শীর্ষ প্রবৃদ্ধির দেশগুলোর মতো বাংলাদেশকে প্রবৃদ্ধির কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে হবে।
বাংলাদেশের পেক্ষাপটে বিশ্বব্যাংক যে তিনটি বাধা চিহ্নিত করেছে, সেগুলো হচ্ছে- বাণিজ্য প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হ্রাস, দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ আর্থিক খাত এবং ভারসাম্যহীন ও অপর্যাপ্ত নগরায়ণ। এ তিন বাধা দূর করতে পারলে বাংলাদেশের উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হবে এবং ভবিষ্যতে প্রবৃদ্ধি আরও টেকসই হবে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
বৃহস্পতিবার বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ‘দ্য কান্ট্রি ইকোনমিক মেমোরন্ডোম- চেঞ্জ অব ফেব্রিক’ শীর্ষক প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণে এসব কথা বলা হয়েছে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। আয়োজনের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটানের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর ডানডান চেন।
এতে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন অর্থনীতির বিশ্লেষক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এবং বর্তমান জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ নোরা ডিহেল। প্যানেল আলোচক ছিলেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান এবং এসবিকে টেক ভেঞ্চারস এবং এসবিকে ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান সোনিয়া বশির কবির।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, `বিশ্বব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কথা বলেছে। এটা ঠিক যে, আকাশে কালো মেঘ আমরা দেখতে পারছি। তবে আমরা আশা করি, এই কালো মেঘ থেকে ঝড় আসবে না। কেননা, ঝড় কারও জন্যই মঙ্গল হবে না। লাঠিসোঁটা দিয়ে দ্রব্যমূল্য বা মুদ্রাস্ফীতি কমানো যাবে না। এগুলোর জন্য কাজ করতে হবে, বসে আলোচনা করতে হবে। আমরা একটি বিশ্বমানের রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠতে চাই এবং সেই বিবেচনায় আমাদের বিশ্বমানের আচরণে গড়ে উঠতে হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাণিজ্য প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হ্রাস, দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ আর্থিক খাত এবং ভারসাম্যহীন ও অপর্যাপ্ত নগরায়ণ বাংলাদেশের টেকসই প্রবৃদ্ধি অজনের পথে প্রধান বাধা। এই তিনটি বাধা দূর করতে পারলে উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হবে এবং ভবিষ্যতে প্রবৃদ্ধি আরও টেকসই হবে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, কয়েক দশক ধরে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি সেরা প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশগুলোর একটি হলো বাংলাদেশ। কিন্তু এতে আত্মতুষ্টিতে ভোগার কারণ নেই। অর্থনীতির তেজিভাব কখনো স্থায়ী প্রবণতা নয়। দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি সব সময় উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে। তবে কয়েকটি দেশ দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। শীর্ষ ১০-এ থাকা দেশগুলোর মাত্র এক-তৃতীয়াংশ দেশ পরের দশকেও উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। গত এক দশকে (২০১০-১৯) যেসব দেশ শীর্ষ ১০-এ ছিল, সেসব দেশ আগের দশকে শীর্ষ ১০-এ ছিল না।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে বিশ্বব্যাংক কিছু সুপারিশ করেছে। যেমন রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশের শুল্ক-করহার অন্য দেশের তুলনায় বেশি, যে কারণে বাণিজ্য সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ব্যাংক খাত সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক বলেছে, ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংক খাতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে। কিন্তু দেশের আর্থিক খাত অতটা গভীর নয়। গত চার দশকে আর্থিক খাতের উন্নতি হলেও এখনো তা পর্যাপ্ত নয়। অন্যদিকে আধুনিক নগরায়ণই বাংলাদেশের পরবর্তী ধাপের উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই ভারসাম্যপূর্ণ আধুনিক নগরায়ণের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
পরিকল্পনামন্ত্রী মান্নান বলেন, ‘বন্ধু হিসেবে বিশ্বব্যাংক আমাদের বেশকিছু প্রস্তাবনা দিয়েছে। আমরা এই প্রতিবেদনের প্রস্তাবগুলো দেখব; তারপর সেখান থেকে পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যবস্থা নেব। বিশেষ করে তারা কয়েকটি কথা বলেছে, যেমন আমরা কাপড়ের ওপর নির্ভরশীল, ব্যাংকিং সেক্টরে আমাদের কিছু সমস্যা আছে। তবে আমাদের একটা লেভেল আছে এবং আমরা আরও উন্নতি করতে চাই।’
‘দেশে বর্তমানে রাজনৈতিক কিছু সমস্যা আছে, এটা অস্বীকার করার কিছু নেই। তবে প্রধানমন্ত্রী বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন এবং এর ফল আমরা হাতে হাতে পেয়েছি। প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, খাদ্য ঘাটতি কমেছে, প্রত্যেক ঘরে বিদ্যুৎ গেছে, সাক্ষরতা বেড়েছে। সারা বাংলাদেশে এপার থেকে ওপারে যাবেন, একটা ফেরি পার হতে হবে না। এগুলো কি চিন্তা করার মতো বিষয় নয়? সুতরাং যেসব বিষয়ে বিশ্বব্যাংক বলেছে, আমরা তা করছি এবং চালিয়ে যাব।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের বর্তমান জিডিপি হচ্ছে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। এই অবস্থা চলতে থাকলে এটি ক্রমেই নিচের দিকে যাবে। ২০২১ থেকে ’২৫ সাল পর্যন্ত গড়ে এটি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ থাকবে। ২০২৬-৩০ সালের মধ্যে আরও কমে ৬ দশমিক শূন্য শতাংশে আসবে। ২০৩১ থেকে ’৩৫ সালে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ, এমনকি ২০৩৬-৪১ সালে এটি ৫ শতাংশে নেমে আসবে। তবে মডারেট রিফর্ম অর্থাৎ আরওে কিছুটা ভালোভাবে গেলে ২০২১ থেকে ’২৫ সাল পর্যন্ত গড়ে এটি ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হবে। ২০২৬ থেকে ’৩০ সালের মধ্যে হবে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০৩১ থেকে ’৩৫ সালে ৬ দশমিক ২ শতাংশ এবং ২০৩৬ থেকে ’৪১ সালে এটি ৫ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে আসবে।
আর জোরালো সংস্কার অর্থাৎ অর্থনীতির চাকা আরও শক্তিশালী হলে ২০২১ থেকে ’২৫ সাল পর্যন্ত গড়ে এটি ৭ শতাংশ। ২০২৬ থেকে ’৩০ সালের মধ্যে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০৩১ থেকে ২০৩৫ সালে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ২০৩৬-৪১ সালে এটি ৭ দশমিক ৫ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াবে।
প্রতিবেদনের বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান আরও বলেন, ‘টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য সরকার কাজ করে যাচ্ছে। এ প্রতিবেদনে যেসব চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়েছে সেগুলো আমরা সমাধানে উদ্যোগ নিচ্ছি। তবে সবগুলো একসঙ্গে হবে না। আকাশে কালো মেঘ দেখতে পায়, আমরা আশা করব কালো মেঘ থেকে ঝড় আসবে না। ঝড় কারোর জন্যই মঙ্গল হবে না। এটা সবার জন্যই অমঙ্গল হবে।’
‘আজকে আবারও বলছি, আমাদের সবাইকে আলোচনার পথে আসতে হবে। সভ্যতা-ভভ্যতার পথে আসতে হবে। একটা বিশ্বমানের রাষ্ট্র হিসেবে আমরা এটাকে প্রতিষ্ঠা করতে চাই। সেই বিবেচনায় আমাদের বিশ্বমানের আচরণও করতে হবে। আমি বিনয়ের সঙ্গে সব মহলের রাজনীতিবিদদের বলব, আসুন আলোচনা করি।’
তিনি বলেন, ‘সড়কে লাটিসোঁটা নিয়ে দ্রব্যমূল্য কমানো যাবে না। লাটিসোঁটা দিয়ে মূল্যস্ফীতি বা মুদ্রাস্ফীতিও কমানো যাবে না। মূল্যস্ফীতি কমাতে গেলে বসে কথা বলতে হবে, আমাদের মিলেমিশে কাজ করতে হবে।’
ব্যাংকিং খাত নিয়ে এম এ মান্নান বলেন, ‘ব্যাংকি খাতের সমস্যা আছে। এগুলো মোকাবিলা করব। আমরা এগুলো সমাধান করব। আমাদের সংস্কার করতেই হবে, আমাদের ভোটাররা এটা চাই। পলিটিক্যাল কিছু বিষয় আছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।’
এক যুগে দেশের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘জোর কদমে হাঁটতে পারব না, তবে কদম সামনে যাবেই। আমরা সঠিকপথে আছি, শেখ হাসিনার কৌশল দেশের জন্য কল্যাণ হচ্ছে। শেখ হাসিনার কৌশল মানেই দেশের কল্যাণের জন্য। শেখ হাসিনার কৌশলের ফল আমরা হাতে হাতে পেয়েছি। দেশে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, খাদ্য ঘাটতি কমেছে, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ গেছে। খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে, সাক্ষরতার হার বেড়েছে আর কটা বলব।’
‘সারা বাংলাদেশ এপার-ওপার করতে পারে সেতু হয়েছে, কালভার্ট হয়েছে। শ্যামগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জ, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া গাড়ি চালিয়ে যাবেন একটা খালও আপনার জন্য সমস্যা না, সবখানে সেতু। এটা আমরাই করেছি।’