দুই দিন পতনের পর পুঁজিবাজারে বেড়েছে মূল্য সূচক। সেই সঙ্গে বেড়েছে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারের দর। এর আগে কয়েক দিন সূচক বাড়লেও সিংহভাগ কোম্পানির দর কমছিল আর আগের দিন সিংহভাগ কোম্পানির দর বাড়ার পর কমেছিল সূচক।
তবে পুঁজিবাজার ‘অস্বাভাবিক আচরণ’ থেকে বের হতে পারছে না। সপ্তাহের তৃতীয় কর্মদিবস মঙ্গলবার পুঁজিবাজারে দেখা গেল লোকসানি, দুর্বল সব কোম্পানির শেয়ারদরে উত্থান।
সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে এমন ১০টি কোম্পানির মধ্যে দুটি নেই উৎপাদনে। বছরের পর বছর লভ্যাংশ দিতে পারছে না। একটি আছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যেটি মুনাফায় ফিরলেও লভ্যাংশ দিতে পারবে না, কারণ এর পুঞ্জিভূত আকাশচুম্বি লোকসান।
অন্য একটি কোম্পানি গত এক দশকের মধ্যে দুইবারই সামান্য মুনাফা করে নামমাত্র লভ্যাংশ দিয়েছিল। গত অর্থবছরে শেয়ার প্রতি ১৩ টাকার বেশি লোকসান দেয়ার পর চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে কিছুটা মুনাফা করেছে।
এমন আরও বহু লোকসাানি, বন্ধ বা কোম্পানির রমরমা অবস্থা দেখা গেছে।
এদিন লেনদেনের পুরোটা সময় সূচকের উত্থান-পতন দেখা গেছে। প্রথম ঘণ্টাতেই সূচক আগের দিনের চেয়ে ৩৭ পয়েন্ট বেড়ে যায়। তবে সেটি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। এরপরেও আরও দুইবার উত্থান হলেও সেই ওই পরিমাণ সূচক বাড়েনি।
বেলা ১২টা ৩৫ মিনিটে দিনের সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছে সূচকের অবস্থান হয় ৬ হাজার ৫৬৭ পয়েন্ট, যা আগরে দিনের চেয়ে ৩৭ পয়েন্ট বেশি। এরপরে ক্রমাগত দরপতনে সূচক আগের দিনের কাছকাকাছি চলে যায়, আশঙ্কা তৈরি হয় পতনের।
তবে শেষ পর্যন্ত কিছুটা বেড়ে শেষ হয় লেনদেন। আগের দিনের চেয়ে সূচকে ৯ পয়েন্ট বেশি যোগ হয়েছে।
লেনদেন হওয়া সিকিউরিটিজের মধ্যে দর বেড়েছে ১২৯টির। বিপরীতে ১০৮টির দর কমেছে এবং আগের দরেই লেনদেন হয়েছে ১৪০টির। এই ১৪০টির প্রায় সবগুলোই বেঁধে দেয়া সর্বনিম্ন দর বা ফ্লোর প্রাইসে লেনদেন হচ্ছে।
ইতিবাচক প্রবণতা হিসেবে লেনদেন কিছুটা বেড়েছে। হাতবদল হয়েছে এক হাজার ৪৮০ কোটি ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার। যার আগের দিনের চেয়ে ১১৯ কোটি টাকা বেশি। সোমবার ডিএসইতে লেনদেন হয় এক হাজার ৩৬০ কোটি ৭৪ লাখ ৬ হাজার টাকা।
মঙ্গলবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের চিত্র
ট্রেজার সিকিউরিটিজের শীর্ষ কর্মকর্তা মোস্তফা মাহবুব উল্লাহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাজার ভালোই যাচ্ছে। আমি বলব, গতকালের বাজারটা ভালো ছিল, কারণ গ্রোথের জন্য এরকমটা প্রয়োজন আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাজারে প্রতিদিনই শেষের ঘণ্টাতে ভালো ট্রানজেকশন হচ্ছে। কাঙ্খিত পর্যায়ের যে ট্রানজেকশন, সেই লেভেলে চলে আসছে শেষে পঞ্চাশ মিনিটে।’
তুর্বল শেয়ারের দরবৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ওই ধরনের কিছু শেয়ারের দাম বেড়েছে। সেগুলোতেও তো কারও না কারও ইনভেস্টমেন্ট রয়েছে। তারাও তো কিছু প্রফিট করতে চায়। এটাই স্বাভাবিক।’
দরবৃদ্ধিতে দুর্বল কোম্পানির আধিপত্য
উৎপাদনে নেই অথচ সর্বোচ্চ দর বেড়েছে জুট স্পিনার্সের। তৃতীয় প্রান্তিক শেষে কোম্পানির লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে শেয়ার প্রতি ৩২ টাকা ৫০ পয়সা।
মঙ্গলবার ৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ দর বেড়ে শেয়ারটি সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে ১৯০ টাকা ৭০ পয়সায়। আগের দিনে লেনদেন হয়েছিল ১৭৩ টাকা ৪০ পয়সায়।
গত এক দশকে দুইবার লভ্যাংশ নেয়া সোনারগাঁও টেক্সটাইলের দরও বেড়েছে এক দিনে যতটা বাড়া সম্ভব ততটাই। ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেড়ে লেনদেন হয়েছে ৬০ টাকায়।
গত পাঁচ বছরের মধ্যে শুধু ২০১৯ সালে শেয়ার প্রতি ৩০ পয়সা নগদ লভ্যাংশও দিয়েছিল কোম্পানিটি। সর্বশেষ ২০২১ সালে শেয়ারপ্রতি ১৩ টাকা ৩৫ পয়সা লোকসান হয়েছে। তবে গত মার্চে সমাপ্ত তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত শেয়ার প্রতি ২৪ পয়সা আয় করতে পেরেছে তারা।
৯ দশমিক ৮০ শতাংশ দর বেড়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ঋণ কেলেঙ্কারি ও লোকসানে ডুবে থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন ক্যাপিটাল।
মঙ্গলবার সর্বশেষ শেয়ারটি লেনদেন হয়েছে ১১ টাকা ২০ পয়সায়। আগের দিনে ক্লোজিং প্রাইস ছিল ১০ টাকা ২০ পয়সা।
গত তিন বছর থেকে বড় অংকের লোকসান গুনছে কোম্পানিটি। তার আগের দুই বছর অবশ্য কিছু আয় দেখাতে পেরেছিল।
২০২১ সালে শেয়ারপ্রতি লোকসান দাঁড়িয়েছে ৮ টাকা ৩ পয়সা।
লোকসানি বিডি ওয়েলডিং রয়েছে দরবৃদ্ধির তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে। অথচ ২০১৯ সালের পর থেকে অপারেশনে নেই কোম্পানিটি। ওই বছর শেয়ারপ্রতি ৮ পয়সা লোকসান দিয়েছিল বিডি ওয়েলডিং।
আরেক লোকসানি কোম্পানি আরএমআরএম স্টিলের দর বেড়েছে ৬ দশমিক ১১ শতাংশ। তালিকার ১২ তম স্থানে থাকা কোম্পানিটির গত বছরে লোকসান হয়েছে ৩ টাকা ৭৫ পয়সা।
২০২০ সালের পরে কোনো অপারেশনাল তথ্য নেই সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের। অথচ কোম্পানির দর ৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ বেড়ে সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে ৬৫ টাকা ৪০ পয়সায়।
এ দর বৃদ্ধির শীর্ষ ২০টি কোম্পানির তালিকায় রয়েছে- বিডি ল্যাম্পস, মেট্রো স্পিনিং, সোনালী আঁশ, আইপিডিসি, জেএমআই সিরিঞ্জ, রংপুর ডেইরি অ্যান্ড ফুড, বিডি কম, নর্দার্ন জুট ম্যানুফ্যাকচারিং,জেনেক্স ইনফোসিস, জেমিনি সি ফুড, ইন্ট্রাকো রি-ফুয়েলিং স্টেশন, পেপার প্রসেসিং ও মালেক স্পিনিং।
এর মধ্যে সিংহভাগেরই লভ্যাংশ আসে নামমাত্র। দুই একটি কেবল ভালো কোম্পানি আছে।
দর পতনের শীর্ষ ১০
এই তালিকার শীর্ষে রয়েছে নাহি অ্যালুমিনিয়াম। শেয়ারদর ৬ শতাংশ কমে সর্বশেষ ৮০ টাকা ৫০ পয়সায় লেনদেন হয়।
পতনের তালিকায় পরের স্থানে রয়েছে এসিআই ফর্মূলেশন। ৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ দর কমে লেনদেন হয়েছে ১৮০ টাকা ৫০ পয়সায়।
তৃতীয় সর্বোচ্চ দর হারিয়েছে ইস্টার্ন হাউজিং। ৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ কমে শেয়ারটি সর্বশেষ ৭৯ টাকা ৩০ পয়সায় হাতবদল হয়।
দর কমার শীর্ষ দশে থাকা অন্য কোম্পানিগুলো ছিল- বিকন ফার্মা, ফাস ফাইন্যান্স, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, উত্তরা ফাইন্যান্স, প্রাইম লাইফ ইন্স্যুরেন্স, প্রিমিয়ার লিজিং ও এনার্জি পাওয়ার জেনারেশন।
কোন খাত কেমন
প্রধান খাতগুলোতে দরবৃদ্ধির তুলনায় দরপতনই বেশি ছিল। শীর্ষ পাঁচের একটি খাতেই কেবল ৫০ শতাংশ দরবৃদ্ধি দেখা গেছে।
একদিন বাদেই আবার শীর্ষে চলে এসেছে ওষুধ ও রসায়ন খাত। এ খাতে লেনদেন বেশি বেড়েছে তা নয়, বরং বিবিধ খাতে লেনদেন কমে দ্বিতীয় স্থানে চলে গেছে।
২৯১ কোটি ২৭ লাখ টাকা লেনদেন কমেছে ওষুধ ও রসায়ন খাতে। দরবৃদ্ধি হয়েছে ১২টি কোম্পানির। বিপরীতে দর কমেছে ১২টির। ৬টির লেনদেন হয়েছে আগের দরে।
লেনদেন কমে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বিবিধ খাত। হাতবদল হয়েছে ২৭৫ কোটি টাকা, আগের দিনে এটি ছিল ৩২০ কোটি ১৭ লাখ টাকা।
৬টি কোম্পানির দরবৃদ্ধির বিপরীতে ৫টির পতন ও ২টির লেনদেন হয়েছে আগের দরেই।
পরের অবস্থানে থাকা বস্ত্র খাতের লেনদেন বেড়েছে। হাতবদল হয়েছে ১৩২ কোটি টাকা। ৯টি কোম্পানির দরপতনের বিপরীতে ২৩টির বেড়েছে। ২৭টির দর অপরিবর্তিত ছিল।
চতুর্থ স্থানে রয়েছে প্রকৌশল খাত। শীর্ষ পাঁচের মধ্যে এ খাতেই ৫০ শতাংশ কোম্পানির দরবৃদ্ধি দেখা গেছে। ১৩০ কোটি ১০ লাখ টাকা লেনদেনের দিনে ২১টি কোম্পানির দর বৃদ্ধি, ১১টির দর অপরিবর্তিত ও ১০টির দরপতন হয়েছে।
আর কোনো খাতের লেনদেন ১০০ কোটি ছুঁতে পারেনি।
পঞ্চম অবস্থানে থাকা জ্বালানি খাতে লেনদেন হয়েছে ৭৮ কোটি ৯০ লাখ টাকার। এ খাতে ১২টি কোম্পানির দর কমেছে, ৯টির বেড়েছে ও ২টির অপরিবর্তিত ছিল।
সূচক বাড়াল যারা
সবচেয়ে বেশি ২ দশমিক ০৫ পয়েন্ট সূচক বাড়িয়েছে বেক্সিমকো লিমিটেড। শেয়ারটির দর ১ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়েছে।
ইউনাইটেড পাওয়ারের দর ১ দশমিক ৩২ শতাংশ বাড়ায় সূচক বেড়েছে ১ দশমিক ৯১ পয়েন্ট।
আইপিডিসি সূচকে যোগ করেছে ১ দশমিক ৮৯ পয়েন্ট। কোম্পানির দর বেড়েছে ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ।
এর বাইরে ইউনিলিভার, কোহিনূর কেমিক্যাল, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, আইসিবি, প্রাইম ব্যাংক, জেএমআই সিরিঞ্জ ও স্কয়ার টেক্সটাইল সূচকে পয়েন্ট যোগ করেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক বাড়িয়েছে ১১ দশমিক ১০ পয়েন্ট।
বিপরীতে সবচেয়ে বেশি ২ দশমিক ৪৮ পয়েন্ট সূচক কমেছে বিকন ফার্মার দর পতনে। কোম্পানিটির দর কমেছে ৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১ দশমিক ৫ পয়েন্ট কমেছে স্কয়ার ফার্মার কারণে। শেয়ার প্রতি দাম কমেছে শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ।
আর কোনো কোম্পানি সূচক ১ পয়েন্ট কমাতে পারেনি।
বার্জার পেইন্টসের দর শূন্য দশমিক ৬৩ শতাংশ কমার কারণে সূচক কমেছে শূন্য দশমিক ৮২ পয়েন্ট।
বেক্সিমকো ফার্মা, লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশ, গ্রামীণফোন, এসিআই ফর্মূলেশন, তিতাস গ্যাস, নাহি অ্যালুমিনিয়াম ও আইএফআইসি ব্যাংকের দরপতনে সূচক কমেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক কমিয়েছে ৮ দশমিক ৫৫ পয়েন্ট।