প্রায় সব দাবি পূরণ, সেই সঙ্গে অর্থনীতি নিয়ে তৈরি হওয়া উদ্বেগ কেটে যেতে থাকার পর পুঁজিবাজারে উত্থান অব্যাহত রয়েছে। ৯ কর্মদিবসের মধ্যে এক দিন সংশোধন কাটিয়ে নতুন করে যেন প্রাণ পেয়েছে বাজার।
আগের সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে ৭৪ পয়েন্ট সূচক বৃদ্ধির দিন বছরের দ্বিতীয় সেরা লেনদেনে হাতবদল হয়েছিল ১ হাজার ৭৭৭ কোটি ৪৫ লাখ ২৭ হাজার টাকা।
নতুন সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে সকাল সাড়ে ৯টায় লেনদেন শুরু হতেই বিপুল পরিমাণ শেয়ার কেনাবেচা শুরু হতে দেখা যায়। ২ ঘণ্টার মধ্যে ১ হাজার ৪৬১ কোটি টাকার বেশি শেয়ার হাতবদলেই বোঝা যাচ্ছিল চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি সর্বোচ্চ লেনদেন ১ হাজার ৯৭৬ কোটি ৮৮ লাখ ৫৩ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
বেলা দেড়টার আগেই আগের দিনের লেনদেন ছাড়িয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত তা চলতি বছর প্রথমবারের মতো ছাড়িয়ে যায় ২ হাজার কোটি টাকার ঘর। এরপর ছাড়িয়ে হয় ২ হাজার ১০৫ কোটি ১৪ লাখ ১৫ হাজার টাকা।
এর চেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছিল প্রায় ১১ মাস আগে ২০২১ সালের ৭ অক্টোবর, যেদিন লেনদেন হয়েছিল ২ হাজার ৪৯৭ কোটি ২০ লাখ ৪৬ হাজার টাকা।
দিন শেষে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সার্বিক সূচক গত ১৯ জুনের পর সর্বোচ্চ অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। এই সূচক এখন ৬ হাজার ৪০১ পয়েন্ট, যা সেদিন ছিল ৬ হাজার ৪০৬ পয়েন্ট।
দিন শেষে সূচক বেড়েছে ৪৬ পয়েন্ট, যা একসময় বেড়েছিল ৮৬ পয়েন্ট। দুপুর ১২টা ১৭ মিনিটে সূচক যখন ৬ হাজার ৪৪১ পয়েন্টে ছিল এবং তা ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী ছিল, তখন ধারণা করা হচ্ছিল তা সাড়ে ৬ হাজার পয়েন্ট ছাড়াবে।
তবে সে সময় লেনদেনের গতি কিছুটা কমে এবং এরপর শেয়ারগুলো কিছুটা দর হারাতে থাকার পর লেনদেন আবার বাড়ে শেষ দিকে।
বেলা শেষে বেড়েছে ২১৯টি কোম্পানির দর, কমেছে ১০২টির আর অপরিবর্তিত ছিল ৬১টির।
রোববার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে একপর্যায়ে ৮৬ পয়েন্ট সূচক বেড়েছিল। শেষ বেলায় এসে সেখান থেকে কিছুটা কমে
বিনিয়োগকারীরা সবচেয়ে বেশি শেয়ার কিনেছেন বস্ত্র খাতে। লেনদেন ছাড়িয়েছে ৩০০ কোটির বেশি। আরও তিনটি খাতে লেনদেন হয়েছে ২০০ কোটি টাকার বেশি। এগুলো হলো ওষুধ ও রসায়ন, প্রকৌশল ও বিবিধ খাত।
দেড় শ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে আর্থিক খাতে। সাধারণ ও জীবন বিমা মিলিয়ে লেনদেন হয়েছে ১৩০ কোটি টাকার বেশি। আর শতকোটি টাকার ছুঁইছুঁই লেনদেন হয়েছে ব্যাংক খাতে।
সূচক বৃদ্ধিতে কোনো একক খাতের প্রধান্য ছিল না। তবে দীর্ঘদিন পর ১২টি কোম্পানির দর দিনের দর বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমা ছুঁয়ে হাতবদল হতে দেখা গেছে।
খাতভিত্তিক সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শেয়ারের দর বেড়েছে সাধারণ বিমা খাতে। দীর্ঘদিন পর ভালো দিন গেছে ব্যাংকে। প্রকৌশল এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতেও দেখা গেছে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা।
ওই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে বাজার সংশোধন শুরু হলেও বড় মূলধনি কিছু কোম্পানির হাত ধরে সূচক বাড়ছিল। তবে অক্টোবরের সেই দিন থেকে তাও কমতে তাকে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যে মতভেদ, বছর শেষে বিনিয়োগ সমন্বয়সহ নানা কারণে বাজার যখন চাপে, তখন গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ হামলার পর শুরু হয় ধস।
যে সূচক ৮ হাজার পয়েন্টের দিকে ছুটছিল, একপর্যায়ে তা ৬ হাজারের নিচে নেমে আসে। তবে চলতি মাস থেকেই বাজারের ঘুরে দাঁড়ানো শুরু।
ফ্লোর প্রাইস, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগসীমা গণনা পদ্ধতি শেয়ারের ক্রয়মূল্যে হিসাব করাসহ নানা কারণে বিনিয়োগকারীরা এখন অনেকটাই নির্ভার। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর অর্থনীতি নিয়ে যে আতঙ্কে পুঁজিবাজারে ক্রমাগত দরপতন হচ্ছিল, তার মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পুঁজিবাজার নিয়ে রক্ষণশীল নীতি পরিবর্তনের আভাস বিনিয়োগকারীদের সাহস দিচ্ছে।
ট্রেজার সিকিউরিটিজের চিফ অপারেটিং অফিসার মোস্তফা মাহবুব উল্লাহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাজারে একটা ফান্ডের ইনজেকশন লক্ষ করা যাচ্ছে। আমি এটাকে বলি, মৌসুমি ফান্ড। এক্সপোর্ট-ইমপোর্টে বেশ কিছু রেস্ট্রিকশনের কারণে ওইদিকে ব্যবসার সুযোগ সংকুচিত হয়ে এসেছে। যার কারণে ব্যবসায়ীরা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে এসেছেন। কারণ, ব্যবসায়ীরা টাকা ফেলে রাখবেন না।’
তিনি মনে করেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের পুঁজিবাজারবান্ধব সিদ্ধান্ত, ফ্লোর প্রাইস এসব কারণেই যদি বাজার ভালো হয়ে থাকত, তাহলে সেটা আরও আগেই হতো। কিন্তু সেটা দেখা যায়নি। চলমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণে অন্য অনেক সেক্টরে বিনিয়োগের সুযোগ কমে আসায় ফান্ডটা পুঁজিবাজারে চলে এসেছে।’
পুঁজিবাজারের এই উত্থান নিয়ে এখনই স্বপ্ন দেখতে চান না মোস্তফা। বলেন, ‘‘এখন পর্যন্ত ভালোই যাচ্ছে, তবে বলব না যে, বাজার ভালো। এই সপ্তাহটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি লেনদেন এই সপ্তাহের গড় লেনদেন ১৪ শ থেকে ১৫ শ কোটির মধ্যে হয়, তাহলে বলা যায় বাজার বেশ ভালোভাবে ফিরল।’
সূচক বাড়াল যারা
সবচেয়ে বেশি ৬ দশমিক ৩১ পয়েন্ট সূচক বাড়িয়েছে গ্রামীণফোন। শেয়ারটির দর শূন্য দশমিক ৬৩ শতাংশ দর বেড়েছে।
পূবালী ব্যাংকের দর ২ দশমিক ৬৫ শতাংশ বাড়ায় সূচক বেড়েছে ২ দশমিক ৩২ পয়েন্ট।
আইসিবি সূচকে যোগ করেছে ১ দশমিক ৯৫ পয়েন্ট। কোম্পানির দর বেড়েছে ১ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংক, ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স, আইএফআইসি ব্যাংক, স্কয়ার ফার্মা, বেক্সিমকো লিমিটেড, বসুন্ধরা পেপার ও বার্জার পেইন্টস সূচকে পয়েন্ট যোগ করেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক বাড়িয়েছে ২২ দশমিক শূন্য ২ পয়েন্ট।
বিপরীতে সবচেয়ে বেশি ৭ পয়েন্ট সূচক কমেছে বিকন ফার্মার দরপতনে। কোম্পানিটির দর কমেছে ৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২ দশমিক শূন্য ৬ পয়েন্ট কমেছে লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশের কারণে। কোম্পানির শেয়ারের দর কমেছে ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
আইপিডিসি ফাইন্যান্সের দর ৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ কমার কারণে সূচক কমেছে ২ দশমিক শূন্য ৩ পয়েন্ট।
এ ছাড়া বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, তমিজউদ্দিন টেক্সটাইল, ওয়ালটন হাইটেক, অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ, বেক্সিমকো ফার্মা ও প্যারামাউন্ট টেক্সটাইলের দরপতনে সূচক কমেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক কমিয়েছে ১৫ দশমিক ১২ পয়েন্ট।
দর বৃদ্ধির শীর্ষ ১০
এই তালিকার সবগুলোই দর বৃদ্ধির সার্কিট ব্রেকার ছুঁয়ে লেনদেন হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি ৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ দর বেড়েছে কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজের। আগের দির দর ছিল ৪৩ টাকা ১০ পয়সা, সেটি এখন দাঁড়িয়েছে ৪৭ টাকা ৪০ পয়সায়। এক দিনেই বেড়েছে ৪ টাকা ৩০ পয়সা।
আরএসআরএম স্টিল দর বৃদ্ধির তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে ছিল। এটির দর ৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ বেড়ে লেনদেন হয়েছে ২৩ টাকা ২০ পয়সায়। আগের দিনের দর ছিল ২১ টাকা ১০ পয়সা।
৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ দর বাড়া মালেক স্পিনিং রয়েছে তালিকার তৃতীয় স্থানে। সর্বশেষ শেয়ারটি লেনদেন হয়েছে ৪০ টাকা ১০ পয়সায়। আগের দিনে ক্লোজিং প্রাইজ ছিল ৩৬ টাকা ৫০ পয়সা।
দর বৃদ্ধির তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে বসুন্ধরা পেপার, মেট্রো স্পিনিং, উত্তরা ফাইন্যান্স, ইস্টার্ন হাউজিং, ঢাকা ডায়িং, বাংলাদেশ বিল্ডিং সিস্টেমস ও আমান ফিড।
প্রতিটির দরই ১০ শতাংশের কাছাকাছি বেড়েছে।
আরও দুটি কোম্পানির দর ৯ শতাংশের বেশি, দুটির দর ৭ শতাংশের বেশি, চারটির দর ৬ শতাংশের বেশি, ১০টির দর ৫ শতাংশের বেশি, ১৫টির দর ৪ শতাংশের বেশি, ২৭টির দর ৩ শতাংশের বেশি বেড়েছে। ২ শতাংশের বেশি বেড়েছে ৩৭টির দর।
দরপতনের শীর্ষ ১০
আগের কার্যদিবসের মতোই দরপতনের শীর্ষে রয়েছে সোনারগাঁও টেক্সটাইল। আজ শেয়ারটির দর ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ কমে লেনদেন হয়েছে ৬৪ টাকা ৭০ পয়সায়। বৃহস্পতিবার ৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ দর কমে ক্লোজিং প্রাইস ছিল ৭১ টাকা ৫০ পয়সা।
ঋণ কেলেঙ্কারি ও লোকসানে ডুবে থাকা ইউনিয়ন ক্যাপিটাল দরপতনের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। শেয়ারটির দর ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ কমেছে। শেয়ারটির ক্লোজিং প্রাইজ দাঁড়িয়েছে ১২ টাকা ৪০ পয়সায়।
তৃতীয় সর্বোচ্চ দর হারিয়েছে পেপার প্রোসেসিং। ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ কমে শেয়ারটি সর্বশেষ ২৫০ টাকা ৮০ পয়সায় হাতবদল হয়।
এই সব কটি কোম্পানির দর গত এক সপ্তাহে ৫০ শতাংশের কাছাকাছি বেড়েছিল।
এ ছাড়া দর কমার শীর্ষ দশে ছিল যথাক্রমে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স, বিকন ফার্মা, মনোস্পুল, ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স, প্রাইম ফাইন্যান্স, কেঅ্যান্ডকিউ এবং তমিজউদ্দিন টেক্সটাইল।